somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাসির ভাই....

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গভীর বোধ আবেগ আর অনুভূতি যখন একই ধারায় এসে মিলিত হয় তখন আমার ভেতরে প্রচন্ড লেখালেখির চাপ জাগে।কোন ভাবেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারিনা।ইদানিং খুব বেশি স্মৃতি কাতরতায় ভুগছি।জীবনের গভীর শূন্যতায় প্রিয় মুখখুলো যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন ফেরারী অশ্রুর শেষ বিন্দুটিও বেদনা জাগিয়ে যায়।

সপ্তম শ্রেনীর কোন এক দুঃসহ রাতের কথা।প্রচন্ড ক্ষিদে আর তৃষ্ণায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছি।একশো তিন ডিগ্রী জ্বরে বা
রো বছরের একটি ছেলে নাকাল হয়ে পরে আছে।নিজেকে হঠাত্‍ করে খুব অসহায় মনে হল।ছোট বেলার কথা মনে পরে গেল।জ্বর হলে মা সাড়ারাত মাথার কাছে বসে থাকতেন।ভাত খেতে পারতামনা বলে আউশ চালের ঝাউ রেঁধে দিতেন।ক্যাডেট কলেজের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে গভীর ভাবে অনুভব করলাম মায়ের শুন্যতা।কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম।রাতে ডিনারের জন্য ক্যাডেট কলেজের গতানুগতিক ম্যানু।হঠাত্‍ করে অনুভব করলাম চোখের পাতা অকারনে ভিজে যাচ্ছে।খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিছানায় শুতে যাচ্ছি এমন সময় কে যেন ডাকলো।এই ক্যাডেট খাবেননা?
পেছনে তাকিয়ে দেখি ডাইনিং হলের বাটলার নাসির ভাই।আমি কিছুটা ভয় জড়ানো কন্ঠে বললাম খেতে ভালো লাগছেনা।মুখ তেতো হয়ে গেছে।প্লিজ নাসির ভাই আপনি কাউকে বলবেননা।ক্লাস সেভেনের বয়সটা এমন ছিল যে হাউস বেয়ারাকে দেখলেও ভয় লাগতো।নাসির ভাই গম্ভীর গলায় বললেন 'এখানে যদি আপনি না খান তবে কেউ জোড়াজুড়ি করবেনা।তবে শরীরের দুর্বলতা কাটাতে খেতে হবে।আমি নাসির ভাইর দিকে তাকালাম।মোটামুটি বয়স্ক লোক।চেহারায় আভিজাত্যের ছোঁয়া।আমি বললাম নাসির ভাই কলেজের খাবার ভালো লাগেনা।আগে জ্বর হল আম্মা আউশ চাল দিয়ে পায়েশ কিংবা ঝাউ রেধেঁ দিতেন।কথাটা বলার পরে হঠাত্‍ লক্ষ করলাম চোখ থেকে টপাটপ পানি পড়ছে।

পরের দিনের কথা।জ্বর তখনো একশ এর ঘরে।হাসপাতালের বিছানায় উপুর হয়ে আছি।হঠাত্‍ দেখি নাসির ভাই।আমাকে বললেন একটু বাইরে শুনে যানতো।বাইরে গেলাম।নাসির ভাই তার সাদা ইউনিফর্ম এর ভেতর থেকে কি যেন বের করলেন।আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন এই বাটিটা নিয়ে ভেতরে যান।তাড়াতাড়ি করুন।কেউ দেখে ফেললে বিপদ।
বাটিটা নিয়ে হাসপাতালের ডাইনিংয়ে গেলাম।আনন্দে চোখে পানি চলে আসল।দেখি বাটির একপাশে পায়েশ তার ওপড় কয়েকটা পিঠা।গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম।ভাবলাম এই জিনিসটা আমার জন্যে আনতে তাকে কতটা মেহনত করতে হয়েছে।

পরের বছরের কথা।আমি তখন ক্লাস এইটে।মোটামুটি একটু ভাব নিয়ে চলতে শুরু করেছি।টেবিলে কারনে আকারনে জুনিয়রের ফল্ট ধরি।একদিন ব্রেক ফাস্টের কথা।দিনটি ছিল শনিবার।চিরাচরিয়ত নিয়ম অনুযায়ী ম্যানু ছিল ব্রেড বাটার জেলি।ক্যাডেট দের কাছে একপ্রকার অখাদ্য।ইতোমধ্যে সিনিয়রদের কিছু অভিনব পন্থাও আয়ত্ত করে ফেলেছি।তখন নিয়ম ছিল কেউ খাবার নষ্ট করলে তার নাম নোট হত।এবং যথার্থ জরিমানা এবং পানিশমেন্ট খেতে হত।সিনিয়ররা তাই ব্রেড পকেটে নিয়ে একাডেমির টয়লেটে ফেলে দিতেন।আমিও মোটামুটি তাই করতাম।কিন্তু সমস্যা হল সেদিন কী মনে করে adjutant স্যার এলেন।আমার প্লেটের ওপর তখন একটা ব্রেড।বাকী দুটো পকেটে।স্যার ডাইনিংয়ে ঢুকে সরাসরি আমাদের টেবিলের দিকে আসা শুরু করলেন।খাওয়া তখনো শুরু হয়নি।স্যার এসে আমাকে বললেন 'হোয়ার ইজ ইউর ব্রেড?
আমার মুখখানা শুকিয়ে গেল।কাঁচুমাচুঁ করে বললাম 'শর্ট স্যার. . .
স্যার কিছু না বলে মেস ও আই সি কে বললেন 'কল বাটলার. . . .
নাসির ভাই দৌড়ে এলেন।আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে এডজুটেন্ট বললেন 'ওর ব্রেড কোথায়?ক্যাডেট কলেজে ঘাস কাটতে এসেছো?স্যার নাসির ভাইর কলার ধরে ধাক্কা দিলেন।অসহায় নাসির ভাই শুধু মাথা নিচু করে বললেন 'সরি স্যার. . . . .

এরপর নাসির ভাইকে প্রায়ই এড়িয়ে চলতাম।ভীষন ছোট মনে হত নিজেকে।এক ধরনের লজ্জাবোধ থেকে জন্ম নিল তার প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধা।এর দু বছর পরের কথা।এস এস সি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।প্রথম দিন।কলেজের ট্রেডিশান অনুযায়ী সব স্যারদের কাছে বললাম।সবাই যখন পরীক্ষার হলে ঢুকবে আমি তখন দেখলাম দূরে নাসির ভাই দাঁড়িয়ে আছে।একবার ভাবলাম তার কাছে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করি।বয়সে যদিও সে আমার বাবার বয়সী।কিন্তু দ্বিধা সংশয় আর সামাজিক সংকীর্নতাকে এড়াতে পারলাম না।তার সাথে চোখাচুখি হলে চোখ নামিয়ে ফেললাম।

এস এস সি ভ্যাকেশনের মাঝামাঝি সময় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরলাম।আবার সেই জ্বর একশোর ঘরে।বিছানায় বসে সেদিন গভীর ভাবে মনে পরল সপ্তম শ্রেনীর কথা।সাথে নাসির ভাইয়ের মুখটি।কিছুদিন পর এস এস সির রেজাল্ট দিল।গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম।ভাবলাম এবার কলেজে গিয়ে নাসির ভাইয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করবো।

ক্লাস ইলেভেন হিসেবে কলেজে যোগদান করলাম জুনের পনের তারিখ।কলেজে ঢুকে বেশ আনন্দ নিয়ে ডাইনিংয়ে গেলাম নাসির ভাই এর সাথে দেখা করতে।পথে হক ভাইকে বললাম নাসির ভাইকে কোথায় পাবো?
হক ভাই অবাক বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন 'কেন তুমি জানোনা নাসির ভাইতো গত মাসে ক্যান্সারে মারা গেছেন?

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।হাউসে এসে খুব কাঁদলাম।খুব।আমার কান্না দেখে আমার সবচেয়ে পুরনো রুমমেট তানভীর বলল ধূর বোকা।এলেভেনে এসে কেউ ক্লাস সেভেনের মত কাঁদে. . . . . .
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×