somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহাম্মক সমাচার ও একজন রজত আলি

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্রাচে ভর দিয়ে যে যুবক হাঁটে রাজপথে
খোলা চুল উড়ে যার খরতপ্ত প্রবল বাতাসে
সে তো সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি আমাদের, পঙ্গুতায় অসহায়!

বাংলাদেশ
তাঁকে তুমি খোলা চোখে দ্যাখো, ভালোবাসো
ভুল করে করুণা কোরো না।




রজত আলি ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছে আরিচা ফেরিঘাট এলাকায়, এক হাতে কাঠের ভারী ক্রাচ অন্য হাতে বাচ্চাদের কিছু বই। এই ফেরিঘাটেই তাঁর ৪১ বছর। ফেরিঘাটের প্রতিটি ফেরী-পলটুন তাঁর খুবই আপন। শত ঘাত প্রতিঘাতেও ফেরিঘাট তাঁকে ছেড়ে যায় নি। এই ফাঁকেইতো তাঁকে ছেড়েছে অনেকেই। তাঁর বৃদ্ধ বাবা তাঁকে ছেড়ে গেল হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে নি বলে, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী কুলসুম তাঁকে ছেড়ে গেল দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে, গেল বছর মাও ছেড়ে গেল বাবার মতো করেই। তাঁর চোখে কোনো অশ্রু ছিল না যেটা লুকানো খুব কষ্টকর হতো, তেমন কোনো বেদনার চিহ্নও দেখে নি তাঁর পাড়া প্রতিবেশী কেউ। সবার ধারণা তাঁর হাসি কান্নার অনুভূতি ৪১ বছর আগে গুলি খেয়ে কয়েকদিন যখন অজ্ঞান ছিল তখনি গেছে। তারপর থেকে কেউ তাঁকে হাসতে দেখ নি কিংবা কাঁদতে দেখে নি কখনো।


রজত আলির বড় ছেলে কনক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কারো অনুগ্রহে নয় রজত আলির ঘাম ঝরানো স্নেহের পরশ মেখেই। কনকের জন্য নিজের পরিশ্রম ছাড়া কোটা নামক কোনো আশীর্বাদও ছিল না। এই ছেলেকে নিয়েই রজত আলির পৃথিবী। এ ছেলের জন্যই হয়তো ফেরিঘাটকে আঁকড়ে ধরে আরও কয়েক বছর কাটিয়ে দেবে। এ ফেরিঘাট তাঁকে আপন করলেও মানুষগুলো তাঁকে আপন করতে পারে না। কোনো মাঝবয়সী ব্যক্তিকে যখন বাচ্চার জন্য বই কিনে নিয়ে যেতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখুনি হয়তো অযথা কটু কথা শুনিয়ে দেয় রজত আলিকে, কোনো বৃদ্ধাকে যখন তার নাতনির জন্য একটি বই কিনে নিয়ে যেতে বলে একই আচরণ পায়। এদেশের মানুষগুলো বড়ই আজব সুন্দর করে কথা বলতেও পারে না। ফেরিতে উঠতে নামতেই পায়ের উপর পা ফেলে ঝগড়া লাগায় ফেরির কয়েকটা প্রহরী। প্রতিবাদ করলেই মা-বাপ তুলে ভয়ানক গালাগালি। এই ফেরি যেন তাদেরই রাজ্য। তাদের কথামতো রাজ্য চলবে। তাদের মতে’র বাইরে গেলেই সবাই মিলে কুকুরের মতো তেড়ে আসে।


রজত আলির নিজেরও কিছু সমস্যা আছে। সে সবাইকে জ্ঞান দিতে চায়। নিজে যা চিন্তা করে এটাই তার কাছে সঠিক। এটাকে সে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য লেগে থাকে দিনের পর দিন। এইতো সেদিন কদম আলি আর হাতেম মিয়াঁর ফল বিক্রির জায়গা নির্ধারণ নিয়ে ফেরিঘাটের প্রহরীদের সাথে সারাদিন ঝগড়া করলো। কতজন তাঁকে ‘খানকি-মাগীর পুত’ বলে গালি দিল, কিছুই তাঁকে দমাতে পারে না। কতজন তাঁকে গায়ে পড়ে স্বভাব পরিবর্তন কিংবা অন্য জায়গায় ফেরি করতে বলে, সে যায় না। সে শুধু কথায় কথায় মানুষকে আহাম্মক বলে। এটা তাঁর মুদ্রাদোষ, এটা বলা ছাড়া থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে নিজের মরা বাপকেও আহাম্মক বলে উঠে। কবে থেকে এভাবেও আহাম্মক বলা শুরু তাও কেউ জানে না।


৭ই মার্চ ১৯৭১ সে রেসকোর্স ময়দানে ছিল, সেখানে সে মুক্তিকামী জনতার ঢেউ এর ভেতর দেখেছিল এক মূর্তিমান ঈশ্বরের। যে একটু নতুন দেশ পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল। সেদিনের ঈশ্বরের কথা আজো তার কানে বাজে,

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।




ঈশ্বরের আহ্বানে যুদ্ধের প্রথম দিকেই আখাউরা দিয়ে সীমানা পাড়ি দেয়, লাঠিখেলার শিল্পী রজত আলি সীমানা পেরিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে হাজির হয় কোন এক ক্যাম্পে। সীমানা পাড়ি দেয়ার সময়ই নিজেকে প্রথম আহাম্মক গালি দেয়, কেনো গালি দিল অজানা। মুক্তি সংগ্রাম সীমানা ছাড়ে বলে কি তাঁর কোনো অভিমান।


ট্রেনিং শেষে রজত আলি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর উপর। শৌর্য-বীর্য রণকৌশলে সে অনন্য। সহজেই প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে কমান্ডার এর। যুদ্ধের সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব এসে যেতো তাঁর কাঁধে। সফল সমর তারকা রজত আলি তেজ দীপ্ত চরনে এগিয়ে যেতো। এভাবেই কোনো এক সম্মুখ সমরে শত্রু সেনার বুলেট এসে লাগে রজত আলির উরুতে। রজত আলির যুদ্ধ থামে না যতক্ষণ জ্ঞান থাকে। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জেগে দেখে সে একটি ময়লা বিছানায় শুয়ে আছে, বাম পাটি আর উরু থেকে আর শরীরের সাথে সংযুক্ত নেই। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আহাম্মক শব্দটি।


রজত আলি হাসপাতালের বিছানায় থাকতে থাকতেই এক শুভ্র-পুত দিনে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারও তিনমাস পর ক্র্যাচে ভর দিয়ে ফিরে আসে মুক্ত স্বদেশে। তারপর এই ফেরিঘাটেই বীরের নির্বাসন। কেউ আর খোঁজ করে নি কখনো, খোঁজ করার প্রয়োজনও মনে করে নি। রজত রাতের ৩০ লক্ষ নক্ষত্র হারিয়ে গেল এক রজত আলির অন্তর্ধানে আর কি আসে যায়!! রজত আলিও কখনো তাঁর পা বিসর্জনের প্রতিদান চায় নি রাষ্ট্রের কাছে। মায়ের জন্য কিছু করে তাঁর প্রতিদান ভোগ করা রজত আলির কাছে নিতান্তই অধর্ম। এই পাপে সে নিজেকে পাপী করতে চায় নি। রজত আলি চায়, ঈশ্বরের বানীর সত্যতা। সাত কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীন হবে। সাত কোটি মানুষের মুক্তির জন্য সে শহীদ হতেও প্রস্তুত ছিল।


তখন থেকে রজত আলির আহাম্মক গালি দেয়ার ফ্রিকুয়েন্সি বাড়তে থাকে। তাঁর ভেতরে প্রতিনিয়ত নানা দ্বন্দ্ব কাজ করে। দেশ শত্রুমুক্ত হল কিন্তু মানুষ কী স্বাধীন হল! রজত আলি খুব বেশি শিক্ষিত ছিল না, নতুবা গ্রামসি’র মতো বলে উঠত তবে কি মুক্তিযুদ্ধ ‘পেসিভ রেভুলেশান’!! মুক্তিযুদ্ধের ফসল মানুষের ঘরে ঘরে পৌছবে এটাইতো ছিল রজত আলির স্বপ্ন। তবু ধৈর্য ধরে রাখে যেহেতু ঈশ্বর এখনও মাথার উপর আছেন। ঈশ্বরের সব কাজ তাঁর পছন্দ হয় এমনটি নয়, তবুও ঈশ্বরকে ঘিরে তাঁর স্বপ্ন আবর্তিত হয়। কোন এক কৃষ্ণ রাতে, শ্রাবণ মেঘের আঁধারে ঈশ্বরের মহাপ্রয়াণ ঘটে সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রিক দুর্বৃত্তের হাতে। রজত আলি কাঁদার চেষ্টা করলো, কান্না আসে না বুকটা ফেটে যেতে চাচ্ছে। সম্ভবত সেদিনই রজত আলির কান্না-হাসির ক্ষমতা লুপ্ত হয়, কেননা এই ফাঁকে তাঁর কখনো কান্নার উপলক্ষ আসে নি। মুখ থেকে শুধু একটা শব্দ বের হয় আহাম্মক।


৪১ বছরে রজত আলি যতবার আহাম্মক উচ্চারণ করেছে ততবার পানি খায় নি। একগুঁয়ে রজত আলি এখনো সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। তাঁর ধারণা কনকদের শিক্ষিত প্রজন্ম এদেশকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত করবে। মাঝে মাঝে ঘাটের অন্য ফেরিওয়ালা, প্রহরী কিংবা তাঁর ক্রেতাদের মাঝেও এ স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে দিতে চায়। স্মৃতিকাতর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি ঘটনাও বলে ফলে। মানুষ তাঁর কথায় বিরক্ত হয়। সেদিনতো ঘাটের এক প্রহরী মুখের উপর বলে দিল “ তুই বেটা বাচ্চাদের বইয়ে দুই একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প পইড়া নিজেরে মুক্তিযোদ্ধা বানাইছস, তোর পাতো কাঁটা গেছে লঞ্চ ডাকাতির পর পুলিশের গুলি খাইয়া” । রজত আলি ভাবে, আজকাল ফেরিঘাটের প্রহরীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দেয়। মুক্তিযোদ্ধা এতোই সস্তা- মুক্তিযুদ্ধ এতোই সস্তা!! নিজেকেই নিজে আহাম্মক গালি দেয়।


যে যুদ্ধ করেছিল সে মুক্তিযোদ্ধা
যে যুদ্ধ করে নাই সেও মুক্তিযোদ্ধা

ওসমানীর কাগজ পেয়েছিল যে সে মুক্তিযোদ্ধা
যে সই দিয়েছিল নিজের কাগজে সেও মুক্তিযোদ্ধা

যে ভেবেছিল যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী সে মুক্তিযোদ্ধা
আমেরিকা এসে যাবে ধরে নিয়েছিল যে সেও মুক্তিযোদ্ধা

এক পাও উড়ে গেছে যার কমলাপুরে সে মুক্তিযোদ্ধা
খঞ্জের গলায় কষছে ফাঁসির রজ্জু যে সেও মুক্তিযোদ্ধা

নয় মাস দৈনিক লিখেছে পাকিস্থানে যে সে মুক্তিযোদ্ধা
রায়ের বাজার গড়ে লাশের পর লাশ ফেলছে যে সেও মুক্তিযোদ্ধা

শুনি বাংলাদেশ (ব্রিটিশ) তামাক কোম্পানি
সিঙ্গার সেলাইকল সত্যি শুনি বিশ্বব্যাংক সেও মুক্তিযোদ্ধা

একদিন নিশ্চয় শুনব জেনারেল এহিয়া
ছিল ছদ্মবেশে সেও মুক্তিযোদ্ধা

আমি বিস্মিত হবো না
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অলীক সুখ পর্ব ৪

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৫

ছবি নেট

শরীর থেকে হৃদয় কে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চেয়েছি
তুমি কোথায় বাস করো?
জানতে চেয়েছি বারবার
দেহে ,
না,
হৃদয়ে?
টের পাই
দুই জায়গাতে সমান উপস্থিতি তোমার।

তোমার শায়িত শরীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চলুন দেশকে কীভাবে দিতে হয় জেনে নেই!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫১

চলুন দেশকে কীভাবে দিতে হয় তা জেনে নেই৷ এবার আপনাদের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ঘটনা শেয়ার করবো৷ আমি কোরিয়ান অর্থনীতি পড়েছি৷ দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ১৯৭০ সালের পর থেকে প্রায় আকাশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৮

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪


আজকের গল্প হেয়ার স্টাইল ও কাগজের মোবাইল।






সেদিন সন্ধ্যার আগে বাহিরে যাব, মেয়েও বায়না ধরল সেও যাবে। তাকে বললাম চুল বেধে আসো। সে ঝটপট সুন্দর পরিপাটি করে চুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×