somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিতা

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই মাত্র আরও একটি পাতা ঝরে গেল আগর গাছটি থেকে। সেই সাথে আমার আয়ু কমে গেল একদিন। গাছটির ডালপালাগুলোতে আর সামান্য কিছু পাতা রয়েছে। ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছে এই জগৎ সংসারে আমি আর অল্প কিছুদিনের অতিথি।

“অহনা মা, এখনও বারান্দায় দাড়িয়ে আছ?” পেছন থেকে জনাব জাহাঙ্গীর আলমের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

আমার রাগ হল ভীষণ। আমার বারান্দায় আমি যতক্ষণ খুশি দাড়িয়ে থাকব, তাতে এই লোকটার কি? আমি রাগ ঢেকে রাখার কোনও চেষ্টাই করলাম না। “হ্যা...দাড়িয়ে আছি। কোনও সমস্যা?”

“না মা কোনও সমস্যা না। এই দুপুরবেলা একটু শুয়ে বিশ্রাম নিলে ভাল হত। ডাক্তার তোমাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছে মা”।

শরীরটা দুর্বল লাগছে। একটু শুয়ে থাকতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকে বিশ্রামের উপদেশ পাওয়ার পর সেই ইচ্ছা মরে গেল। “ডাক্তার কি বলেছে আমি জানি। আপনার মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন দেখছি না”।

“ঠিক আছে দাড়িয়ে থাক। কিন্তু একটা চাদর তো গায়ে জড়িয়ে রাখতে পার! বাইরে থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে!”

কথাটা মন্দ বলেনি লোকটা। একটু শীত শীত লাগছে আমার। কিন্তু সেটা স্বীকার করার প্রয়োজন দেখছি না। “ঠাণ্ডা বাতাস আমার ভালই লাগে। আর আপনাকে তো কতবার বলেছি এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা”।

“দেখ মা... আমি তো তোমার ভালর জন্যই......”

“প্লিজ আপনি এখন যান তো! আমাকে একা থাকতে দিন”।

জনাব জাহাঙ্গীর আলম মাথা নিচু করে চলে গেলেন। কিন্তু তার জন্য আমি একটুও অনুতপ্ত বোধ করছি না। এই লোকটাকে আমার কখনই সহ্য হয়না। আর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তার আমার প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল রাখার এই বাড়াবাড়ি আরও অসহ্য লাগে।

***

জনাব জাহাঙ্গীর আলম সম্পর্কে আমার বাবা হন। ব্যাপারটা ভাবতেই আমার লজ্জা লাগে! সৃষ্টিকর্তা আমাকে এমন বাজে একটা লোকের সন্তান করে কেন পৃথিবীতে পাঠালেন? জুয়া খেলতে গিয়ে লোকটা একটা মানুষকে খুন করেছিল। তারপর ১৪ বছর হাজত বাস করে আবার ফিরে এসেছে শুয়ে বসে খাওয়ার আশায়। মায়ের মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি এখন লোকটা একাই ভোগ করতে পারছে। কারন পথের কাটা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি নিজেও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

মায়ের মৃত্যুর পর আমি আবিষ্কার করলাম আমার নিজের বেঁচে থাকার আর কোনও অর্থ হয়না।
কার জন্য বাঁচব?
কি লাভ বেঁচে থেকে?
কি করব বেঁচে থেকে?

জনাব জাহাঙ্গীর আলম জেলে যাওয়ার সময় কিছুই রেখে যায়নি আমাদের জন্য। মায়ের হাত ধরে আত্মীয় স্বজনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেরিয়েছি। কত রাত আমার মুখে দু নলা ভাত তুলে দিয়ে মা উপস থেকেছে! তারপর একটা থ্রি স্টার হোটেলে রিসেপশনিষ্ট এর চাকরি যোগার করল। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। একদিন মা জানতে পারল হোটেলের মালিক অল্প টাকায় সব কিছু বেঁচে দিয়ে বিদেশে চলে যাবেন। মা ধার দেনা লোণ করে টাকাটা যোগার করে ফেলল, তারপর সাহস করে হোটেলটা কিনে ফেলল। মা ছিল সাহসী আর পরিশ্রমী মানুষ। অল্পদিনেই তিনি উন্নতি করতে পারলেন। লোণের টাকা ফেরত দিয়ে মা লাভের মুখ দেখলেন। জাহাঙ্গীর আলমের বিক্রি করে দেয়া বাড়ি পুনুরুদ্ধার করলেন। এভাবে ১৪ বছর কেটে গেল। এর মাঝে মা অনেক বার চেষ্টা করেছেন জাহাঙ্গীর আলমের সাথে দেখা করার। কিন্তু লোকটা কোনও এক অদ্ভুত কারনে মায়ের সাথে একবারও দেখা করেনি। তবে ছাড়া পাওয়ার পর যখন জানতে পারল আমাদের অবস্থা ভাল, তখন ঠিকই লাফাতে লাফাতে চলে এসেছে! লোকটাকে বাড়িতে জায়গা দেয়ার ব্যাপারে আমি মোটেও রাজি ছিলাম না। কিন্তু মায়ের মুখে হাসি দেখে সেদিন আমি কিছু বলতে পারিনি। আমার মা রাহেলা বেগমের মত বোকা মানুষ হয়ত খুব কমই আছে। নইলে যে ব্যাক্তি তাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রেখে তার গহনা বিক্রির টাকা নিয়ে জুয়া খেলতে যায় তাকে এমন পাগলের মত ভালবাসে কীভাবে?

অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে যে মা আমাকে এতদুর নিয়ে এসেছে, আমার উচিত বাকিটা জীবন তাকে সঙ্গ দেয়া। কিন্তু মা তো এই জগতে নেই! মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আমার কেবল মনে হতে লাগল মা অন্য কোনও জগতে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে ছাড়া একলা থাকতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার উচিত যত তারাতারি সম্ভব তার কাছে যাওয়া। দু একদিন পরই আমি বুঝতে পারলাম আমি আসলে মরে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু আত্মহত্যা সংক্রান্ত কোনও ঘটনা ঘটানোর ইচ্ছা আমার নেই। আমি চাচ্ছি প্রকৃতি নিজে থেকেই যেন আমার মৃত্যুর ব্যাবস্থা করে দেয়। জনাব জাহাঙ্গীর আলম বিষয়টা খেয়াল করলেন। আমাকে ডাক্তার দেখাতে চাইলেন। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। অবশেষে ছোট খালা, খালু আর খালাত বোন রানুর জোরাজোরিতে রাজি হলাম। শহরের বড় বড় ডাক্তার দের কাছে তারা আমাকে নিয়ে গেল। ডাক্তাররা আমার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল। শারীরিক কোনও সমস্যা নেই অথচ আমার জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে আসছে। দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার বাবস্থা করা হল। অবশেষে ডাক্তাররা সিদ্ধান্তে এলেন আমার এমন একটা অসুখ হয়েছে যার কোনও চিকিৎসা নেই। আমার অসুখটা হল আমার ব্রেনে। আমার ব্রেন ঠিক করে নিয়েছে আর বাচবে না। তাই আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত জীবন যাপন করলেও আমি ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
শীতের শুরুতেই লক্ষ করলাম আমাদের বাড়ির আঙিনায় বেড়ে ওঠা আগর গাছটার পাতা ঝরে যেতে শুরু করেছে। এই গাছটাকে ১০ বছর যাবত দেখছি, প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু। একটা চির হরিৎ গাছ। শীতকাল এলেও কখনও পাতা ঝরে যায়না। কিন্তু এবছর ঝরছে। কিছুদিন পর গাছটার পাতা ঝরে যাওয়ার সাথে আমার নিজের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা যোগসূত্র লক্ষ করলাম। দিন দিন গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে আর সমানুপাতিক হারে আমার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ যেদিন সব পাতা ঝরে যাবে সেদিনই আমার মৃত্যু হবে। আমার ইচ্ছা পুরন হতে চলেছে, প্রকৃতি আমাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
আমি প্রতিদিন গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর অনুমান করার চেষ্টা করতাম কতদিন বাঁচব। ব্যাপারটা আমার খালাত বোন রানুকে জানালাম। রানু প্রথমদিকে হেসেই উড়িয়ে দিল। পরে সে বিষয়টা সবাইকে জানল। কেউ মানতে চাইল না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি আমার ধারনাই সঠিক। যেদিন গাছটির শেষ পাতাটি ঝরে যাবে সেদিনই আমার মৃত্যু হবে।

***

মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ। অর্থাৎ শীতের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে।
আরও একটি পাতা ঝরে গেল। আর অল্প কয়েকটা পাতা ঝরে যাওয়া বাকি। চাইলে গুনে দেখা যায়। যেকোনো মুহূর্তে একটা দমকা বাতাস এলে পাতাগুলো ঝরে যাবে আর সাথে সাথে মৃত্যু হবে আমার। আমি এখন আর উঠে দাড়াতে বা বসতে পারিনা। শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাতাহীন আগর গাছটির মত আমিও রুক্ষ ও ম্লান হয়ে গেছি। ইদানীং কথা বলতেও কষ্ট হয়। খাওয়া দাওয়া একদমই করিনা। মৃত্যু আর মাত্র এক পদক্ষেপ দূরে।

জনাব জাহাঙ্গীর আলম এলেন দয়া দেখাতে, “মা তোমার শরীরের অবস্থা তো বেশি খারাপ! আমার মনে হয় তোমাকে হাসপাতালে নেয়া উচিত”।

“না! আমি কোথাও যাবনা! আমি এখানেই থাকতে চাই”।

“মা, আমার কথা শোন...”

“আপনি প্লিজ যান। আমাকে একা থাকতে দিন”।

“মা, কেন তুমি এমন করছ? আমি তো তোমার ভালই চাই!”

আমি হাসার চেষ্টা করলাম, “সত্যিই আমার ভাল চান আপনি?”

“অবশ্যই মা! তুমি স্বীকার কর আর নাই কর, আমি তোমার পিতা। পিতা হয়ে কন্যার ভাল চাইব না?”

“সত্যিই যদি আমার ভাল চান তবে এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান, আর কখনও আমার সামনে আসবেন না। ফর গডস সেক! আমি আপনাকে একদমই সহ্য করতে পারিনা!”

জনাব জাহাঙ্গীর একটা গা জ্বালানো হাসি উপহার দিয়ে বলল, “বেশ! তোমার যা ইচ্ছা তাই হবে। আমি চলে যাচ্ছি, কথা দিচ্ছি আর কখনও তোমার সামনে এসে দাঁড়াব না”।

জনাব জাহাঙ্গীর চলে যেতেই আমি আবার গাছের দিকে মনোযোগ দিলাম। আরও কিছু পাতা ঝরে গেছে। সারাটি বিকাল অপেক্ষায় থাকলাম শেষ পাতাটি ঝরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ঝরল না। রাতে ঘুমানোর আগে বুঝতে পারছিলাম এটাই আমার জীবনের শেষ ঘুম। এই ঘুম আর কখনও ভাঙবে না।

***
কিন্তু ঘুমটা ভাঙল। ভোরবেলা এই বছরের প্রথম কোকিলের কুহু কুহু স্মর শুনে ঘুম ভাঙল। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গাছের একটি পাতা এখনও ঝরে যায়নি। ভেবেছিলাম শীতের সাথে আমিও বিদায় নেব। কিন্তু কোকিলের আওয়াজ বলছে শেষ বারের মত বসন্ত দেখে যাওয়ার সুযোগ হল আমার। দিনের শুরুতে খালার কাছ থেকে আরও একটা ভাল খবর পেলাম। জনাব জাহাঙ্গীর আলম গতকাল থেকে লাপাত্তা। হয়ত কোনও জায়গা থেকে বেশ কিছু টাকা সরিয়েছে। এখন সেই টাকা ওড়াবে আর আমার খোঁজ খবর রাখবে। আমার মৃত্যুর খবর পেলেই ছুটে আসবে সব দখল করার জন্য। আমি নিশ্চিত আমার মৃত্যুর পর ১ বছরের মধ্যে মায়ের রেখে যাওয়া সব কিছু বিক্রি করে দেবে লোকটা।

সারাদিন শেষ পাতাটি ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনলাম। এত বাতাস বইল, কিন্তু পাতাটি ঝরে গেল না। প্রকৃতি আমাকে নিয়ে খেলছে। মৃত্যুর জন্য আমার অপেক্ষা দীর্ঘায়িত করার মধ্যে হয়ত এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছে সে! পরের রাতটিকে শেষ রাত মনে করে ঘুমিয়ে গেলাম।

আবার ঘুম ভাঙল কোকিলের ডাকে। অদ্ভুত ব্যাপার! পাতাটি ঝরে যায়নি!
একদিন গেল।
দুইদিন গেল।
তিনদিন গেল।

চতুর্থ দিন লক্ষ করলাম পাতা তো ঝরেই নি বরং নতুন কিছু ছোট ছোট পাতা গজিয়েছে গাছে! তারমানে কি প্রকৃতি চাচ্ছে না আমি মারা যাই?

সপ্তাহ খানেক বাদে লক্ষ করলাম নিজেকে আর তেমন দুর্বল লাগছে না। তবে কি আমার জীবন-মৃত্যু নিয়ে প্রকৃতি কোনও অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছে? কিছুদিন বাদে ডাক্তার এসে আমাকে পরীক্ষা করলেন। তার মুখে হাসি ফুটল, “তুমি সেরে উঠছ অহনা! তোমার রোগটা ধীরে ধীরে তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে! তুমি ভাল হয়ে যাচ্ছ!” আমি ডাক্তারের মত হেসে উঠতে পারলাম না। নিজেকে প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালের শিকার ভাবতে ভাল লাগছে না!
তবে আমি সত্যিই ভাল হয়ে গেলাম। পৃথিবীটা আবার আগের মত অনুভূত হতে লাগল। আমি দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে নিলাম। মায়ের হোটেল ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নিলাম। নিয়মিত অফিস করতে শুরু করলাম। মায়ের অনুপস্থিতি কষ্ট দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি যে জনাব জাহাঙ্গীর আলম নামের ঐ ব্যাক্তির মুখ আর দেখতে হচ্ছে না!

এভাবে ২ বছর কেটে গেল।

***
আমি হোটেলে আমার অফিস রুমে বসে আনমনে কিছু ব্যবসায়িক ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। হোটেলটাকে ৫ তারা হোটেলে রুপান্তর করার চিন্তা এসেছে মাথায়। আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাল হোটেলের নতুন রিসেপশনিষ্ট রচনা রায়। “অহনা, তুমি কি ব্যাস্ত?”

মেয়েটি আমার সমবয়সী। সুন্দরী, কথা-বার্তায় স্মার্ট! তার পারফরমেন্স আমাকে বেশ সন্তুষ্ট করেছে। ইতিমদ্ধে আমাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আমরা পরস্পরকে “তুমি” বলে সম্বোধন করি। “না ব্যস্ত না। কেন? কিছু বলবে?”

“একটা অচেনা লোক এসেছে, তোমার সাথে দেখা করতে চায়”।

“তুমি কি বললে?”

“চিনিনা জানিনা, হুট করে এসে দেখা করতে চাইছে! আমি বললাম, ম্যাম ব্যাস্ত আছে। পরে আসুন। লোকটা আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই খামটা একটু কষ্ট করে ওনার হাতে দিয়ে আসুন”।বলে হাতে ধরা একটা সাদা খাম দেখাল রচনা। আমি খামটা হাতে নিলাম। গায়ে কিছু লেখা নেই। নেড়ে চেড়ে মনে হল ভিতরে একটা চিঠি আছে।

“লোকটার বয়স কত হবে? দেখতে কেমন?”

"বয়স ৫০ এর মত হবে। পাঞ্জাবী পরনে, মাথায় বড় চুল। গায়ের রং ফর্সা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চেহারায় একটু কবি কবি ভাব আছে"।

“কথা বলার সময় খুব বেশি হাত পা নাড়ে?”

“হ্যা!”

আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। হোয়াট দা হেল! জনাব জাহাঙ্গীর ইজ ব্যাক! একবার মনে হল খামটা ছুড়ে ফেলে দেই। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলাম। এখন রিঅ্যাক্ট করা ঠিক হবেনা। খামটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করলাম। হ্যাঁ, চিঠিই। সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। অনেক দীর্ঘ একটা চিঠি, কাগজের দু পিঠেই লেখা হয়েছে! আমি পড়তে শুরু করলাম....

মা অহনা,

জানি তুমি সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ভাল আছ। আর এও জানি আমি কেমন আছি তা নিয়ে তুমি চিন্তিত নও। তবে দেখে ভাল লাগছে, আজ আমার মেয়েটি নিজ পায়ে দাড়াতে শিখেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি বেশ সুন্দর ভাবে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছ মা। তুমি আরও অনেক উন্নতি করবে। কারন তোমার সাথে তোমার মায়ের দোয়া আছে। তোমার মা একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন।

রাহেলাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসতাম। কিন্তু জুয়ার নেশা আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। একদিন জিততাম তো দশদিন হারতাম। হেরে গেলে আরও জিদ চেপে যেত। রাহেলাকে না জানিয়ে বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম, সেই টাকাও গেল। একসময় প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

সেদিন রাহেলা খুব অসুস্থ ছিল। আমার হাত দুটি ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল আমি যেন আর জুয়া না খেলি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় তাকে ফেলে ছুটে গিয়েছিলাম জুয়ার আসরে। সাথে ছিল গহনা বিক্রি করে পাওয়া ২ লাখ টাকা। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলাম এই ২ লাখ কে ১০ লাখ করেই তবে ফিরব। কিন্তু প্রতারনার শিকার হয়ে আমি ২ লাখ টাকাই হেরে গেলাম। রাগে দুঃখে তখন আমার মাথা খারাপ অবস্থা। কথা কাটাকাটি থেকে এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হল। কীভাবে যে কি হয়ে গেল আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ছে না! শুধু মনে আছে প্রচণ্ড হই চই হচ্ছিল চারিদিকে। তার মাঝে হঠাৎ খেয়াল হল আমার হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরি আর পায়ের কাছে পরে আছে একজনের লাশ!

গ্রেফতার হলাম আমি। হাতে নাতে প্রমান সহ ধরেছে পুলিশ। কোটে চালান করল, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলাম, জর্জ কোনও দয়াপ্রবন হয়ে ফাঁসির বদলে ১৪ বছরের জেল দিল। শুরু হল আমার কারাবাস। এর মাঝে তোমার মা অনেক বার চেষ্টা করেছে আমার সাথে দেখা করার, কথা বলার। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব? আমার সে সাহস হয়নি। কি বলতে পারতাম তাকে? প্রতিবার তোমার মা দেখা করতে এলেই মনে হত ১৪ বছরের কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যু অনেক ভাল ছিল।

কেটে গেল ১৪ বছর। ভেবেছিলাম ছাড়া পাওয়ার পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার বংশের কোনও পূর্ব পুরুষ সম্ভবত বিশাল কোনও পুণ্যের কাজ করে ছিল, যার ফলে আমি তোমার মায়ের মত একজন মানুষের ভালবাসা পেয়েছিলাম! ছাড়া পাওয়ার পর দেখলাম কয়েদখানার বাইরে বেরিয়ে দেখলাম তোমার মা দু হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছেন। তার সেই দু বাহুর আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দেবার পর মনে হচ্ছিল এই তো জীবন! হয়ত এই জীবনের স্বাদ পাওয়া বাকি ছিল বলেই আমার মৃত্যুর আদেশ হয়নি!

তারপর জানতে পারলাম তোমার মা নিজ চেষ্টায় একটা ভাল মানের থ্রি স্টার হোটেল দাড় করিয়েছে। আমার বিক্রি করা বাড়িটা আবার কিনেছে। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছ! সে দিন নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ মনে হতে লাগল। কিন্তু সুখ খুব বেশি দিন টিকলনা। তোমার মা জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ফুরিয়ে গিয়েছিল তার জীবনী শক্তি! রাহেলার মৃত্যুর সময় তাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার মাথার উপর আমি ছায়া হয়ে থাকব। কিন্তু আমি জানতাম কাজটা সহজ হবেনা, কারন তুমি আমাকে সহজ ভাবে গ্রহন করতে পারনি। সেটাই স্বাভাবিক। তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি শত অবহেলা উপেক্ষা করে তোমার পাশে থাকার।

কিন্তু তুমিও একটা অদ্ভুত অসুখ বাধিয়ে বসলে। প্রতিজ্ঞা করে বসলে নিজের মায়ের কাছে চলে যাওয়ার। আগর গাছটার পাতা ঝরার সাথে সাথে নিজেও দুর্বল হয়ে যেতে লাগলে। আমি মানুষটা খারাপ হতে পারি, কিন্তু তোমার বাবা! আমি বিবেকহীনের কাজ করেছি ঠিকই, কিন্তু তোমাকে প্রচণ্ড ভালবাসি মা! তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনা।

মা, পুরোটা তোমার ভুল ধারনা ছিল! তুমি ভেবেছিল প্রকৃতি আর তোমাকে বাচিয়ে রাখতে চাইছেনা। কিন্তু ধারনা ঠিক নয়। প্রকৃতির কোনও ক্ষমতা নেই মানুষের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়ার। আগর গাছটার পাতা ঝরে যাচ্ছিল আর তুমিও ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলে! তার ছাপ পরছিল তোমার শরীরের ওপর। এটা হয়ত প্রকৃতির কোনও অদ্ভুত খেয়াল যে, চির হরিৎ বৃক্ষ হওয়া সত্ত্বেও গাছটার পাতা ঝরছিল। কিন্তু তার সাথে তোমার অসুস্থ হওয়ার কোনও যোগাযোগ ছিলনা। পুরো ব্যাপারটা ছিল একটা মানসিক অসুখ। কিন্তু কিছুতেই তোমাকে বোঝাতে পারলাম না।
তাই আমি যাওয়ার আগের দিন রাতে গাছের নিচে বসে ছিলাম শেষ পাতাটি ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায়। তখন তুমি ঘুমিয়ে পরেছিলে। চারিদিক ছিল অন্ধকার। ঠিক রাত ১ টার দিকে শেষ পাতাটি ঝরে গেল! আমি তখন সেই পাতাটি যেখানে ছিল সেই যায়গায় একটা প্ল্যাস্টিকের তৈরি নকল পাতা ভালভাবে শক্ত আঠা দিয়ে আটকে দিলাম! আমি জানতাম কাজ হবে। এতে করে তুমি মানসিক জোর ফিরে পাবে এবং সুস্থ হয়ে উঠবে। এবং আমি কাছে না থাকায় তুমি আরও সাচ্ছন্দ বোধ করবে।

তাইতো এই ২ বছর দূরে দূরে থাকলাম। কিন্তু মাগো! আর পারছিনা! আমার বয়স হয়েছে মা, আর কতদিন বাঁচব জানা নেই। মৃত্যুর আগে একবার তোমাকে একটু দেখতে মন চাইছে! একবার একটু দেখা দেবে মা? আমি শুধু একনজর দেখতে চাই আমার মেয়েটা কেমন আছে। দেখেই আমি বহুদুরে চলে যাব! আর কখনও তোমার সামনে এসে দাঁড়াব না! একটু দেখা দেবে মা?

অনেক অনেক ভালবাসান্তে
তোমার হতভাগ্য
পিতা


আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলাম। রচনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মানুষটা কোথায় আছে?”

রচনা বলল, “রিসেপশনে বসিয়ে রেখে এসেছি”।

আমি প্রায় দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মানুষটার দিকে চোখ পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। ইস! চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ২ বছরে বয়স যেন ১০ বছর বেড়ে গেছে। চোখগুলো যেন গর্তে দেবে গেছে! কত রাত ঘুমায়নি কে জানে! অযত্নে বেড়ে উঠেছে চুল, দাড়ি। কি মলিন একটা পাঞ্জাবী পড়ে আছে! মা কাছে না থাকলে সন্তানের অবস্থা যেমন হয়। আমার বুক ঠেলে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে।

পাশ থেকে রচনা জিজ্ঞেস করল, “উনি তোমার কে হয় অহনা?”

আমি ধরা গলায় বললাম, “আমার বাবা......”
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:২১
১৭টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×