somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারাপার (উতসর্গঃ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম)

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢেউ আর ঢেউ।

দূরে জেগে আছে গ্রাম। অনেক দূরে কোথাও আলো নেই। মনে হয় যেনো নিধুয়া পাথার। সময়টা ১৯৭১ এর জুন জুলাই মাস। মধু মিয়া নৌকার মাঝি। আগে ছিলো শুধু মাঝি। এখন মুক্তিযোদ্ধা। লেখাপড়া না জানা মানুষটা জানে তার ইজ্জত অনেক বেড়েছে এই স্বল্প সময়ে।

আসলে এ কোনো নদী না। এ হলো বিল। একদিকে সেনবাগ থানা, তারপর ফেনী থানা সাথে লাগোয়া চৌদ্দগ্রাম থানা। আর বিলটার অবস্থান হলো তিন থানার মাঝখানে। সেই মার্চের শেষ থেকে মানুষ যাচ্ছে ওপারে। কেউ একা, কেউ পরিবারসহ। আর শুরুতে শুধু মানুষ যেতো। এখন ফিরছেও মানুষ। তারা মানুষ না। ফেরেশতা। মুক্তিসেনা। ওই তো অষ্টগ্রামের আব্বাস চেয়ারম্যান গেছিলো পরিবারসহ। ছেলেটা ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছিলো বিলের পানির দিকে। সেই ছেলে ফিরে এলো জোয়ান মর্দ হয়ে।গ্রেনেড পিকে টু নিয়ে সাথে রাইফেল। আসে আর যায়। মধু মাঝি কথা বলেনা, শুধু পার করে দেয়। সেই ছেলেই বলেছিলো যে মধু নাকি মুক্তিযোদ্ধা। অবাক মধু।

নৌকা থেকে নামার সময় মৃদুহেসে বলেছিলো চাচা তুমিও কিন্তু আমাদের একজন। মধু মাঝি প্রথম বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ছেলেটা বললো-চাচা এই যে আমাদের পার করে দিচ্ছেন, আপনি তো আমাদের লোক। কথা বাড়ায়না ছেলেটা আর। হারিয়ে যায় রাতের আঁধারে।সেদিন সারারাত ফেণীর দিক থেকে আওয়াজ। গুলি।মেশিনগান।ঠা ঠা আওয়াজ।

মধু মাঝি ভাবতে থাকে, আহারে কতো মানুষ আসে যায়। মধু সারা রাত মানুষ পার করে দিনে খ্যাপ মারে গুনবতি থেকে অষ্টগ্রাম। নিজের বুকে চিন চিনে একটা ব্যাথাও আছে।মাঝে মাঝে দিনে রাজাকারদের পার করে দিতে হয়। আবার মাঝে মাঝে তাদের রেশন। রাজাকাররা রাতে চলাফেরা করেনা। শুধু দিনের বেলা হাঁক ডাক করে। সেদিন অষ্টগ্রাম যাচ্ছিলো, সাথে রাজাকার সিরাইজ্জা। আগে ছিলো সিঁদেল চোর। একটা পাক্কা মমিন মুসল্মান। নিমকি দাঁড়ি মুখে।আয়েশী ভঙ্গিতে বলে-

কি রে মধু দিন কাল কেমন?
মধু চুপ চাপ।
আমাদের এদিকে মানুষজন ওই পারে যাই নাকি রে?
মধু মাথা নাড়ায়- না।
রাইতে কি হয় কে জানে?
স্বগোতক্তির মতো সিরাইজ্জা বলে।
আর মধুর দিকে তাকিয়ে বলে, রাইতে নৌকা বাওয়ার দরকার নাই।
মধু কথা বলেনা, মনে মনে বলে শালা ইস্কান্দার মীর্জা !
মধু চুপ চাপ দাঁড় বায়।
ছলাত ছলাত ছল।

সেই নোয়াখালি কিংবা আরো দূর থেকে মানুষ আসে আর চলে যায়, সাথে পরিচিত গাইড থাকে। মধুও তাদেরকে চিনে। কথা হয়না মুখে। শুধু চোখে। চোখে চোখে কথা। রাত একটু নিশি হলেই বিলের মাঝখান দিয়ে চলতে থাকে মধু মাঝির নাও। যাত্রীরা নিঃশব্দে চলে যায়। মধু জানে তারা চলে যাবে ত্রিপুরার চোত্তাখোলা কিংবা হরিনা কিংবা উদয়পুর কিংবা আগরতলা। যারা যুদ্ধে যায় তাদের মধু দেখলেই চিনতে পারে। চোখে আগুন। আর অনেকেই যায় প্রান বাঁচাতে। তারা জড়োসড়ো হয়ে কোনে বসে থাকা। আর যুদ্ধযাত্রীদের চোখ নাচে। আলোর নাচন।আগুনের নাচন।

মধু মাঝি সারাদিন বসে থাকে রাত আসবে কখন। আহা! মানুষগুলো কত বিপদে আছে।অদ্ভুত তার অনুভুতি যেনো পুল সেরাত পার করে দেয় মানুষদেরকে।রেললাইনের ব্রীজ পার হতে বাচ্চাদের মুখ চেপে পার করতে হয়। কারন ব্রীজ পাহারা দেয় রাজাকাররা। পাঁচ/ছয় জন রাজাকার থাকে। সব চেয়ে কষ্টের জায়গা হল রেললাইনের পোলটা পার হওয়া। ব্রিজের নীচে পানি কম হওয়াতে মধু দাঁড় বায়না। নৌকা থেকে নেমে নৌকা টেনে নিয়ে যায়। যাতে দাঁড় বাওয়ার শব্দ না হয়।

জুলাই মাসের শেষের দিকে ওই পার থেকে মানুষ আসা বেড়ে যায়। যাওয়া কমে যায়। প্রায় দিন দুই তিন জন করে আসছে। মধু বুঝে তারা গেরিলা। মধু নিঃশব্দে পাটাতন খুলে দেয়। ভিতরে তারা সাজিয়ে রাখে রাইফেল, গ্রেনেড আর পি কে টু। মধু এখন পি কে টুও চিনে।

আগষ্টের শুরুতে আর তেমন কেউ আসেনা। রাজাকারদের উতপাতও কমে আসে। বিলে পানি কমে আসছে দ্রুত। আসন্ন শীতের আগমনধ্বনি। বিলের কোথাও এক হাঁটু পানি। কষ্ট হয় তবুও নৌকা চালিয়ে যায় মধু। হাটু পানিতে পরম মমতায় নিঃশব্দে পার করে দেয় মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত।

একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। গোলাগুলি। অনেক দূরে। কাছে। গুনবতি। অষ্টগ্রাম। ঢালুয়া। দরবেশেরহাট। অষ্টদ্রোন। আরো দূরে। সারা অঞ্চলে আগুন ধরে যায়।মধু পাগলের মতো ছুটে যায় নদীরপারে। বসে থাকে। কেউ যদি আসে। পার হতে। না কেউ আসেনা। তার স্বল্প জ্ঞানে বুঝতে পারে দেশের অভ্যন্তরে এখন শেল্টার হয়ে গেছে। এখোন আর পালাতে হবেনা ওই পারে।এখন যুদ্ধ সমানে সমানে।

তারও দুই দিন পরে। সকালবেলা ঘাটে বসে আছে মধু। দেখে দূর থেকে পাকিস্থানী বাহিনী, খাকি পোষাক পরা আরো কালো পোষাকের মিলিশিয়া আর রাজাকার সিরাইজ্জাসহ দশ/পনেরোজনের দল। মধু ভাবে খেপ নিয়ে আবারো রাজাকার আর পাকি কুত্তাদের পার করতে হবে।সিরাইজ্জা থম থমে মুখে বলে-

মধু রাতে নৌকা চালাস?
মধু মাথা নাড়ে।
আবারো একি প্রশ্ন।
আবার মাথা নাড়া।

সিরাইজ্জা বলে- এই অঞ্চলে নৌকা একটাই, মোহাম্মদ আলী বাজারে আমাদের চেকপোষ্ট আছে, আর আসার জায়াগা নেই।

নিচুস্বরে পাকিস্থানীদের কিছু একটা বলে সিরাইজ্জা। সক্রিয় হয়ে উঠে চায়নিজ রাইফেল। মধু পড়ে যেতে যেতে দেখে নীল আকাশ। সকালের পরিস্কার আকাশে দু’ একটা ছেঁড়ামেঘ। দূরে পাখিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। মধুর অনেক স্বাদ মুক্তি হবে। আকাশের ওই পাখি হবে।


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৩৬
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেট্রোরেল পেয়েছি অথচ হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিজদের ভুলে গেছি

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১১

জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধে নিহত মনোজ দা’র বাবা

লিখেছেন প্রামানিক, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ছব্বিশ তারিখ। দেশে তখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়েই বেশি সমস্যা। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে হত্যা করছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিয়ে থেতে ভাল্লাগে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৯

আমার বিয়ে বাড়ির খাবার খেতে ভালো লাগে। আমাকে কেউ বিয়ের দাওয়াত দিলে আমার খুসি লাগে। বিয়ের দিন আমি সেজে গুজে বিয়ে বাড়িতে আয়োজন করা খাবার থেতে যাই। আমাদের এলাকায় বর্তমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুর সামনের পাতার ৯টি পোষ্টে শুন্য (০ ) মন্তব্য।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০



আজকে সকালে একটু দেরীতে ( নিউইয়র্ক সময়, সকাল ৮:২১ ) সামুতে লগিন করলাম; লগিন করে আজকাল প্রথমে নিজের লগিন স্ট্যাটাস পরীক্ষা করি: এখনো সেমিব্যানে আছি। মোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

উসমানীয় সাম্রাজ্যের উসমান এখন বাংলাদেশে

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০



জনপ্রিয় ''কুরুলুস উসমান'' সিরিজের নায়ক Burak Ozcivit এখন বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছর ধরে তার্কির অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুলতানদের নিয়ে নির্মিত সিরিজগুলো বিশ্বব্যপী বেশ সারা ফেলেছে। মুসলিমদের মাঝেতো বটেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×