somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মাধুররি সাথে সারারাত

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্টেশনে নামার প্রায় সাথে সাথেই মেয়েটিকে এক ঝলক দেখেছিলাম। এই মেয়েটির সাথে এক ঘরে এমনকি একই বিছানায় পুরো একটা রাত কাটাতে হবে সে কথা তখন কল্পনা করাও ছিল অসম্ভব। ট্রেন থেকে নেমে আসা যাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বছরের এ সময়টা ভ্রমণ বিলাসী মানুষের এখানে আসার কথা নয়। তবুও নেহায়েত চাকরি বাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে অথবা আমার মতো দায়ে ঠেকে যারা এসে পড়েছে অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা প্লাটফর্ম খালি করে বেরিয়ে গেছে। কমদামী হোটেলের দু একজন দালাল এবং দু চারদিনের জন্য পেয়িং গেস্ট হিসাবে যারা অতিথিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় তেমনি কয়েকজন মানুষ ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। অন্তত একজন যাত্রীকে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে না পারলে আজ রাতে তাদের জমার ঘরে শূন্য। এদের মধ্যে অনিশ্চিত ঠিকানার দু একজন যাত্রী থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু পুরো প্লাটফর্মে একমাত্র এই মেয়েটি একবারেই বেমানান।

রাত প্রায় সাড়ে আটটা। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে বিকেলে ট্রেন যখন ছাড়ে তখন ঝলমলে রোদ ছিল। দূরে পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল সাদা সাদা মেঘ। ভারতীয় ডিএইচ রেলওয়ের ন্যারো গেজের আটটি বগি এবং চারটি ইঞ্জিন সারাটা পথ ধরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘুরে হাঁপাতে হাঁপাতে উপরে উঠছিল। দিনের আলো যতক্ষণ ছিল সময়টা শুধু চারপাশের দৃশ্য দেখেই বেশ কেটে গেছে। কার্সিয়াংয়ের পর থেকে পরিস্থিতি বদলে গেল। বাইরে অন্ধকার এবং ঝুপঝাপ বৃষ্টি। কামরার ভেতরে টিমটিমে বাতি আর কনকনে ঠা-া।

দীর্ঘপথে হাঁসফাঁস করতে করতে দার্জিলিং পৌঁছে ট্রেনটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও আমার ভেতরে শুরু হলো নতুন টেনশন। নতুন জায়গা, পথঘাট তো দূরের কথা কোনো মানুষকেও পুরোপুরি চিনি না। হোটেলে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না। আমার অবলম্বন বলতে বন্ধু সমীরণের দেয়া একশ টাকার একটা নোট, গোটা বিশেক খুচরা টাকা এবং চিরকূটে লেখা একটা ঠিকানা... ১২/২এ রুংটুং রোড! বারবার নিজেকেই ধমকে উঠতে ইচ্ছে হয়, ‘এই দুর্যোগের রাতে হুট করে দার্জিলিং এসে পড়ার সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়নি।’ সিদ্ধান্ত নেবার সময় কি জানতাম জুন মাসের মাসের প্রথম সপ্তাহে মালদা মুর্শিদাবাদে যখন ঠা ঠা রোদ আর প্রচণ্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন দার্জিলিং ঘন কুয়াশায় নিজেকে ঘিরে রেখেছে।

সমীরণ বলেছিল ‘রুংটুং রোডটা খুব পরিচিত সড়ক, রেল স্টেশন থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়। নেহায়েত রাতের বেলা যদি ঠিকানা খুঁজে বের করার রিস্ক না নিতে চাস তাহলে ছোট খাটো কোনো হোটেলে না হয় একরাতের জন্যে হোমস্টেতে থেকে যাস।’
‘হোমস্টে জিনিসটা কী?’ আমি বোকা বাঙাল, অনেক কিছুই প্রশ্ন করে জেনে নিতে হয়।
‘হোম মানে ঘর আর স্টেশনে থাকা অর্থাৎ হোটেলে না থেকে কারও বাড়িতে থাকা। এটাকে তুই শুদ্ধ বাংলায় বলতে পারিস গৃহবাস।’
‘চেনা নেই জানা নেই একজন আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেবে?’
‘পয়সা দিলে দেবে না কেন! তুই রাতে থাকবি ঘুমাবি সকালে ঠিকানা খুঁজে চলে যাবি। কেউ কেউ অবশ্য থাকা খাওয়া, সকালে নাস্তা ফাস্তার ব্যবস্থাও করে। যতো সার্ভিস ততো টাকা।’

আমার বন্ধুটি হোমস্টে সম্পর্কে ধারণা এবং নিজের অনেক টানাপোড়েন সত্ত্বেও ভারতীয় মুদ্রায় একশ টাকার একটা নোট হাতে তুলে দিলেও আবহাওয়া সম্পর্কে কোনো কথাই বলেনি। ফলে আমার সঙ্গে কোনো শীতবস্ত্র নেই। অবশ্য ধারণা দিলেও কোনো লাভ ছিল না। মে মাসের এগার তারিখে রাজশাহী থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে লালগোলা যাবার সময় শুধু পৈত্রিক প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাতে পারলেই বেঁচে যাই। শীত-গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত আমাদের কাছে সব তখন একাকার। ফলে মুর্শিদাবাদ পৌঁছে দেখা গেল কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে গোটা কয়েক জামা প্যান্ট, লুঙ্গি গামছা ছাড়া আর কিছু নেই।

হাড় কাঁপানো শীতের ব্যাপারটা ‘ঘুম’ পার হবার পরেই টের পেয়েছিলাম। ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম ঘন কুয়াশা পুরো প্লাটফর্মটা ঘিরে রেখেছে। স্টেশনের অনুজ্জ্বল বিজলি বাতি প্রাণপণে কুয়াশা ঠেলে দূরে রাখতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মাঝে মাঝেই প্রবহমান কুয়াশার মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে সবাইকে। দ্বিতীয়বার মেয়েটিকে যখন দেখলাম তখন সে ঘন করে বোনা কুয়াশার চাদর দুহাত দিয়ে সরিয়ে হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়ালো এবং কোনো ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্যায়া জি আপ চলেঙে হামারা ঘর?’

এর আগে আরও একজন বৃদ্ধ প্রায় একই ভাষায় তার বাড়িতে রাত কাটাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভারি ওভারকোট ও মাংকি ক্যাপের আড়ালে তার একজোড়া সাদা গোঁফ ছাড়া প্রায় কিছুই আমার নজরে পড়েনি। কিন্তু কাছাকাছি আসার পর তার মুখ থেকে দেশি মদের উৎকট গন্ধের কারণে দ্রুত নেতিবাচক উত্তর দিয়ে তাকে বিদায় করেছি। বুঝতে পারলাম এই মেয়েটিও হোমস্টের জন্যে রাতের অতিথি খুঁজতে বেরিয়েছে। আমার ধারণা ছিল হোটেলের দালাল অথবা বাড়িতে থাকার জন্যে গেস্ট নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরুষকূলের একচেটিয়া অধিকার। হতে পারে ভিন্ন দেশে ভিন্ন সংস্কৃতিতে সবই সম্ভব। আমি বোকা বাঙাল পাকিস্তানিদের তাড়া খেয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নিয়েছি। বয়স এখনও পঁচিশ পার হয়নি। আমার কতটুকু জীবন আর কীই বা অভিজ্ঞতা!

ভাঙাচোরা হিন্দি বলতে পারলেও পারতপক্ষে না বলার চেষ্টা করি। ঊর্দু এবং হিন্দিকে আমার একই গোত্রভূক্ত বৈমাত্রেয় ভাই বলে মনে হয়। তাই ইংরেজি জ্ঞান খুব বেশি না হলেও উত্তর দিলাম ইংরেজিতে।
‘একচ্যুয়ালি আই এ্যাম লুকিং ফর এ্যান এ্যাড্রেস... আমি একটা ঠিকানা নিয়ে এসেছি। এই রাস্তাটা কোন দিকে কেমন করে যাওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে যদি একটু সাহায্য করতে পারো!’
দার্জিলিং বৃটিশদের নিজের হাতে গড়া শহর, এখানে সামান্য সংখ্যক স্থানীয় নেপালী তিব্বতি বাদ দিলে প্রায় সকলেই ইংরেজি জানে বলেই আমার বিশ্বাস। দেখা গেল আমার অনুমান মিথ্যা নয়, মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠে উত্তর দিল স্থানীয় উচ্চারণে হিন্দি মিশ্রিত এক অদ্ভুত ইংরেজিতে।
‘ইউ হ্যাভ গন ম্যাড ইয়ার! হু উইল টেক ইউ টু ইয়োর ঠিকানা এ্যাট দিস টাইম অফ নাইট... ইউ উইল হ্যাভ টু মুভ অন ফুট, পায়দল চলনে পড়েগা।’
আমি মাথাভর্তি দুঃশ্চিন্তার সাথে কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে নিরুত্তর থেকে যাই। আবারও মনে হয় এ ভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু এসেই যখন পড়েছি একরাতের জন্যে কোথাও উঠতে হবে তো। রাত ক্রমেই বাড়ছে, সাথে সাথে বাড়ছে কুয়াশা এবং শীত। প্লাটফরম ফাঁকা হয়ে এসেছে।
‘বেটার আই ফাইন্ড এ চিপার হোটেল নিয়ার বাই... এই শহরে আমি কিছুই চিনি না, কাউকে জানি না। আজ রাতে এই প্রথম এলাম।’
‘হ্যয়ার আর ইউ কামিং ফ্রম?’ এই প্রশ্নটি যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে করতে পারে, উত্তর আগে থেকেইে ভেবে রাখা উচিৎ ছিল। তবুও তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় স্বল্প পরিচিত কাউকেই সরাসারি নিজের পরিচয় না দেয়াই ভাল। বললাম, ‘কামিং ফ্রম মুর্শিদাবাদ... ওয়েস্ট বেঙ্গল।’
‘বাঙালি বাবু এবার আমার সাথে চলুন ঘরের সাথে ঘরওয়ালিও মিলে যাবে।’ স্বল্প আলোয় মেয়েটির ভ্রুভঙ্গি আমার চোখে পড়ে না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে একটা অন্য ধরনের আহ্বান আমি স্পষ্ট টের পাই। আমার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শীতল একটা অনুভূতি শিরশির করে নিচের দিকে নেমে যায়। একই সঙ্গে কিছুটা হিন্দুস্তানী টানে বলা বাংলা আমাকে চমৎকৃত করে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আপনি বাংলা বলতে পারেন?’
‘এখানে সকলে সব ভাষা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে। চলুন! আর কথা বাড়ালে রাত বাড়বে, রাত বাড়লে শীত বাড়বে। ইস্টিশানে বসে থাকলে ঠা-ায় জমে যাবেন।’

মেয়েটি একরকম জোর করেই আমাকে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে বাধ্য করে। এ ছাড়া আমারও কোনো গত্যান্তর ছিল না। স্টেশনের বাইরে মূল সড়ক ছেড়ে নিচে নামতেই মেয়েটি তার ওভার কোটের পকেট থেকে একটা বড় টর্চ লাইট বের করে রাস্তায় আলো ফেলে। আধো অন্ধকারে কখনও বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল চড়াইয়ের খাড়া পথে উঠতে থাকি আবার একটু পরেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাই। মাঝে মাঝে পাহাড়ের শরীর কেটে তৈরি ধাপে ধাপে ওঠা নামা করি। মেয়েটি এক দুবার ‘হুঁশিয়ার, দ্য রোড ইজ স্লিপারি...’ ইত্যাদি বলে সতর্ক করে দেয়। এভাবে প্রায় পনের কুড়ি মিনিট পাহাড়ি পথে চলার পর আমার যখন প্রায় দম ফুরিয়ে এসেছে তখন মেয়েটি একটি কাঠের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পায়ে চলার খাড়া রাস্তা থেকেও চার পাঁচ ধাপ উপরে সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা যে ঘরটিতে ঢুকলাম সেখানে কোনো আলো নেই। পাশের ঘর অথবা করিডোর থেকে আসা এক চিলতে আলোয় অপরিসর ঘরে বিছানা বালিশ ছাড়াও গোটা দুই চেয়ার, একটা টেবিল এবং একটা বুক শেলফ চোখে পড়ে। মেয়েটি সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই পাশের ঘর থেকে বয়সী নারী কণ্ঠে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘মাধু ফিরছস? আজ এতো রাত করলি ক্যান?’

অদেখা মহিলার কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। বুঝতে পারি তাঁর কথার সাথে আমার নিজের দেশগ্রামের কথার অনেক মিল আছে। মেয়েটি বেশ গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘তুমি এতো রাতে জেগে বসে আছো কেন? তুমি কি ভেবে নিয়েছো তোমার ছেলে একদিন ঝুপ করে তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে?’
‘আমি কিছুই ভাবি না রে... কারও লাইগা বইসা থাকার সময় নাই... আমার নিজেরই যাওনের সময় হইছে...।’ নারী কণ্ঠটি ক্রমেই বিলাপের মতো মনে হয়।
‘এই আবার শুরু হলো, তুমি কি থামবে?’ সম্ভবত আমার উপস্থিতি বিস্মৃত হয়ে ধমকে ওঠে মেয়েটি। হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ে সে বলে ওঠে, ‘আপনি এখানটায় বসুন। জুতো খুলে পা’টা তুলে বসতে পারেন। ফিল ফ্রি... আমি আসছি।’
আমি তাকে এক রকম থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘পাশের ঘরে যে ভদ্রমহিলা কথা বলছিলেন তার কথা শুনে মনে হয় তিনি পূর্ববাংলা থেকে এসেছেন। ’
‘আমার মা। ইনফ্যাক্ট মাই প্যারেন্টস আর ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান।’
তার কথার উত্তরে আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার আগেই মেয়েটি ভেতরে ঢুকে যায়।

দার্জিলিং এর পাহাড়ের ঢালে কাঠের খুপরিতে বসে ভদ্রমহিলা হয়তো জানেন না পূর্ব পাকিস্তান বলে কোনো দেশ বা দেশের অংশ বিশেষের অস্তিত্ব আর নেই। মাত্র আড়াই মাস আগে দেশটা স্বাধীন হয়ে গেছে আর এখন সেই স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই চলছে সারা দেশে। আমি চিরকালই পলায়নবাদী মানুষ। যুদ্ধ শুরু হবার পর জীবন বাঁচাতে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের কোনো ট্রেনিং ক্যাম্পে অথবা রিক্রুটিং সেন্টারের লাইনে না দাঁড়িয়ে একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদে দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে উঠে পড়েছি। বাংলাদেশ সম্পর্কে ওদের চিন্তা ভাবনার সাথে একমত হতে পারলে সেখানে চুপচাপ কয়েকমাস কাটিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু আমার মামা, বিশেষ করে মামাতো ভাইয়েরা শুরু থেকেই তাদের কথাবার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় এক সপ্তাহ পরে আর টিকতে পারিনি।

যুদ্ধে যাবার বয়সে পরিবার পরিজনহীন তেইশ বছরের তরুণকে শরণার্থী শিবিরেও মানানসই মনে হয় না। তাছাড়া স্যাঁতসেঁতে স্কুল ঘর অথবা থিকথিকে কাদা মাড়িয়ে বাঁশের খুঁটি টিনের চালের কাঁচা ঘরের আশ্রয়েও দু একদিন থেকে মনে হয়েছে শরণার্থী হিসাবে জীবন যাপনের চেয়ে দেশে ফিরে যাওয়াই ভাল। অতএব প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মালদায় স্কুল জীবনের বন্ধু সমীরণকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। স্বল্পকালীন সেখানে অবস্থানের স্মৃতি খুব সুখকর না হলেও মন্দ না। দিব্যি দিন দশ বার কাটাবার পরে মনে হয়েছে এবার ঠিকানা বদলানো দরকার। এরপর বড় ভাইয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু জ্যোতিদার খোঁজে হুট করেই দার্জিলিং চলে আসা। যতোদূর জেনেছি ডাক্তার জ্যোতিপ্রকাশ নন্দী শহরের মোটামুটি পরিচিত চিকিৎসক। স্থানীয় রাজনীতিতেও প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। আমার বিশ্বাস, তার সাথে একবার দেখা করতে পারলে স্থায়ী কোনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তারপর যুদ্ধ যতোদিন চলে চলুক। দু চার পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে দেশে ফেরা যাবে।

‘কী চিন্তা করছেন বাঙালি বাবু?’ মেয়েটির জিজ্ঞাসায় আমার ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায়। আমার দিকে একটা পুলওভার ছুঁড়ে দিয়ে সে বলে ‘নিন এটা গায়ে চড়িয়ে নিনÑ আপনি তো ওয়েদারের খোঁজ না নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন।’
আমি তাকিয়ে দেখি সে তার ওভারকোট খুলে এসেছে, তবে গায়ে সোয়েটার এবং গলার মাফলার যথাস্থানেই আছে। সে আবার বলে, ‘একটা তো ভুল হয়ে গেছে। এই যে আপনি গেস্ট হিসাবে আমার বাড়িতে এসে গেলেন, কিন্তু আপনার নামটা এখনও জানা হলো না।’
‘আমার নাম তুষার, তুষার তালুকদার।’ খুব সতর্কভাবে শুধুমাত্র নিজের ডাক নামের সাথে পৈত্রিক পদবী জুড়ে দিয়ে নিজের পরিচয় সেরে ফেলি।’
‘আমাদের ওয়েদারের কি দোষ বলুনÑ আপনি এখানে আসার সাথে সাথে মনে হয় আজ থেকেই এখানে তুষার ঝরতে শুরু করবে। বরষ কা পহেলা স্নোফল! হি হি হি...’ স্টেশনে দেখা সেই পরিচিত হাসিটা আর একবার খিলখিল করে বেজে ওঠে। হাসি থামিয়ে সে নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমার নাম মাধুরি। যানÑ ও পাশের দরজা খুলে বারান্দায় গেলে দেখবেন বালতিতে জল রাখা আছে। হাত মুখে একটু জল দিয়ে আসুন।’
‘এই ঠা-ার মধ্যে...’ আমি ইতস্তত করি।
‘একটু ঠা-া হবে... কি করবেন জল গরম করার ব্যবস্থা তো এখন নেই।’
‘না আমি বলছিলাম, একটা রাতের ব্যাপার কোনো রকমে রাতটা কাটাতে পারলে আর হাত মুখ ধোয়ার ঝামেলাটা...’ কথা শেষ করতে পারি না।
‘কিছু খেতে তো হবে! ডোন্ট ইউ ফিল হাংরি?’
সত্যি বলতে কি দীর্ঘপথের ক্লান্তি এবং অনিশ্চয়তা আর দার্জিলিং-এ নামার পর থেকে শীতের আক্রমণের সাথে টেনশনÑ সব মিলিয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন মাধুরির কথায় মনে হলো পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ক্ষুধার অস্তিত্ব পেটে টের না পেলেও মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। আমি কথা না বাড়িয়ে পেছনের দরজাটা খুলে কাঠের ঝুল বারান্দায় চলে যাই, সঙ্গে সঙ্গে একরাজ্যের শীত আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ভারতের মাটিতে পা রাখার পর থেকে খাওয়া দাওয়া ঘুমানোর কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আজকের খাবারটা খুব উঁচু মানের না হলেও পরিবেশনে আন্তরিকতা ছিল। গরম ভাতের সাথে সবজি এবং ডাল। টেবিল থেকে প্লেট বাটি তুলে নিয়ে যাবার একটু পরেই ফিরে এলো মাধুরি। এবারে বসলো আমার বিছানায় প্রায় আমার গা ঘেষে। মেরুদ-ের ভেতর দিয়ে শিরশির করে বয়ে যাওয়া সেই শীতল প্রবাহ আরও একবার আমি টের পেলাম।

‘আপনার খেতে খুব কষ্ট হলো, তাই না তুষার বাবু?’
অজানা পরিবেশে, স্বল্প আলোকিত একটি ঘরে প্রায় অপরিচিত এক তরুণীর কণ্ঠে ‘তুষার বাবু’ শুনে প্রথম অবস্থায় আমি রশিদুল হক তালুকদার ওরফে তুষার বুঝতেই পারলাম না কথাটা আমাকে বলা হয়েছে।
‘ইনফ্যাক্ট গেস্ট মেইনটেন করার মতো প্র্যাকটিক্যাল অবস্থা আমাদের এখন নেই।’ তার কথাটা আত্মস্থ করতে আমার যে টুকু সময় লেগেছিল তার মধ্যেই মাধুরি একটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলে। আমার মনে হয় এবারে কিছু একটা বলা দরকার। দ্রুত বলে উঠি, ‘খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কিচ্ছু ভাববেন না। পাকিস্তানিদের তাড়া খেয়ে এদেশে আসার পর থেকে এক একটা দিন টিকে থাকার যে অবস্থা সে তুলনায় আজকে তো স্বর্গে আছি। আমার অজান্তেই সত্যি কথাটা মুখ থেকে বের হয়ে আসে। সে ভীষণ অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
‘তার মানে আপনি ওপার থেকে এসেছেন?’
‘ওপার থেকে এবং সম্ভবত আপনার মামা বাড়ির খুব কাছে থেকে।’
‘আমার মামা বাড়ি... ও ইয়েস মাই মাদার ইজ ফ্রম মাই মেন সিং এ্যাজ আই নো।’ ময়মনসিংকে এভাবে ভেঙ্গে উচ্চারণ করে মাধুরি। হয়তো সে এভাবেই শিখেছিল।
‘আমার ধারণা ভুল হয়নি, আমার বাড়ি টাঙ্গাইলে। আমরা একই জেলার মানুষ, কিছুদিন আগেও টাঙ্গাইল ময়মনসিংয়ের ভেতরেই ছিল।’
‘একটু খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে আপনি আমাদের কোনো ডিসট্যান্ট রিলেশানই হবেন।’ আমি মাধুরির কথায় আবারও চমকে উঠে বলি, ‘নাহ... সে সম্ভাবনা কম, কারণ... আচ্ছা আপনারা, আই মিন আপনার বাবা মা কতদিন আগে দেশ ছেড়েছেন?’
‘পাকিস্তান ইন্ডিয়া পার্টিশানের তিন বছর পরে আমার বাবা মা আমাদের সাথে নিয়ে পাকিস্তান থেকে শিলিগুড়িতে এসে উঠেছিলেন। আমার তখন দু বছর হবে, দাদার পাঁচ।’
‘তাহলে আপনি হয়তো বয়সে আমার সমান অথবা ছোটই হবেন।’
‘ছোট হলে আর আপনি আজ্ঞে করছেন কেন? আমি কিন্তু বাংলা ভাল বলি না, আপনি আজ্ঞে তো আরও বলতে পারি না।’

আগামীকাল সমাপ্য...
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জেন্ডার ও সেক্স

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫২

প্রথমে দুইটা সত্যি ঘটনা শেয়ার করি।

২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে জেলা পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মৌখিক পরীক্ষার ঘটনা। দুজন নারী প্রার্থী। দুজনই দেশের নামকরা পাবলিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমপি আনারকে সবাই কৃত্রিম সন্মান দেখায়েছে, বেনজিরকে মিথ্যা স্যার ডেকেছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



এমপি আনার ৪/৫ শত ক্যাডারকে লালন পালন করতো, সবাই তাকে "ভাই" ডাকতো; কত কলেজের শিক্ষক, প্রিন্সিপাল, থানার দারোগা উনাকে স্যার ডেকেছে; পার্লামেন্ট ভবনে উনাকে কত আদর করে খাবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামীলীগে শুধুমাত্র একটি পদ আছে, উহা সভাপতি পদ!

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৪ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪১


বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড়, পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। মানুষ এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ৭০ এর নির্বাচনে এই দলটিকে নিরঙ্কুশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×