somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মিজানুর রহমান মিলন
আমার ব্লগবাড়িতে সুস্বাগতম !!! যখন যা ঘটে, যা ভাবি তা নিয়ে লিখি। লেখার বিষয়বস্তু একান্তই আমার। তাই ব্লগ কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার আগে একবার ভাবুন এই লেখা আপনার নিজের মস্তিস্কপ্রসূত নয়।

ছোট গল্প : একজন মায়ের অপেক্ষা

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি:গুগোল থেকে।

মা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বিছানার পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন রাস্তার দিকে। রাস্তাটি চলে গেছে বাড়ির পাশ দিয়ে । গ্রাম্য মেঠো রাস্তা। রাস্তাটি কাঁচা হলেও বেশ অনেকটা চওড়া, প্রশস্ত ও সামান্য একটু একে বেঁকে গেছে। মা আছিয়া বেগমের ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তাটির অনেকদুর পর্যন্ত দেখা যায়।

মায়ের নিত্যদিনের কাজ ঘুম থেকে উঠেই তিনি জানালাটা খুলে বিছানায় বসে রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকবেন কিসের জন্য প্রতিক্ষায়। হয় তো কেউ এই রাস্তা দিয়ে আসবেন এই আশায়।তারপরে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি তার দৈনন্দিন কাজ শুরু করেন।

মা আছিয়া বেগমের সাথে আর একজন থাকেন । ছোট্ট মেয়ে নাম তিতলী। তিতলী পড়ে ক্লাস সেভেনে। তিতলীরা দু’ভাইবোন। বড় ভাই বুলবুল পড়েন দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিতলী জানে, মা কেন প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই তো, আর ক’দিন পরই ঈদ। ভাইয়া বলেছেন, ঈদের ছুটি পেলেই বাড়ি যাবেন।

তিতলীরও মনটা আনচান করে। ভাইয়েটা এখনো আসেনা কেন ? ভাইয়া আসলে তো কতই না মজা হয়। মা, কত পদের রান্ন্ করেন, তখন মায়ের হাতের রান্না আরো বেশি মজা হয়। ।ঈদের শপিং তো তার বান্ধবীরা অনেকেই করে ফেলেছে শুধু মনে হয় তারই বাকি। মাকে কয়েকবার বলেছে তিতলী। মা বলেছে, ভাইয়া আসুক। এক সঙ্গে সবাই যাব।

ভাইয়া, শেষবার যখন এসেছিল তখন বলেছিল. তিতলী দেখিস সামনের ঈদে তোর জন্য একটা সুন্দর লাল টুক টুকে জামা এনে দিব। তোকে যা মানাবে না !
আহ্ ! ভাইয়াটা এখনো আসে না । মাকে জিগায় তিতলী, মা ভাইয়া কবে আসবে ?

মা ভাবছিলেন, এই দু:খের সংসারটা কতদিন ধরে একলা তিনি আগলে রেখেছেন। আজ প্রায় কয়েক বছর হতে চলল।বুলবুলের বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। অল্প বয়সে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশকে স্বাধীন করে তবেই ঘরে ফিরেছেন।অর্থের অভাবে তেমন লেখা পড়া করা হয় নি। যুদ্ধ শেষে তিনি সরকারী অফিসে ছোটখাট একটা চাকুরি নেন। তার কয়েক বছর পর বিয়ে করেন। মাইনে ছিল খুবই সামান্য কিন্তু দেশকে নিয়ে তার আশার শেষ ছিল না। মাঝে মাঝে বুলবুলের মাকে বলতেন, আমি বলে রাখলাম, এই দেশ একদিন সোনার দেশ হয়ে উঠবে। চারদিকে শুধু সোনা আর সোনা ফলবে। তখন আমাদের কোন আর দু:খ কষ্ট থাকবে না।

কিন্তু তার সেই স্বপ্ন কিছুদিন পরেই দু:স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়।যখন দেখলেন, দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র জেকে বসেছে আর চারদিকে শুধু দুর্নীতি আর লুটপাট, লেজুড় বৃত্তি রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি দেশকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বলতেন, আমরা কি এজন্য জীবন বাজিকে রেখে দেশকে স্বাধীন করেছি ?

সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদ আসে যখন জানতে পারেন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিতলীর জন্মের চার বছর পরেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন।অনেক চেষ্টা তদবির করলেন । ডাক্তার বললেন, এ ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। সবাই পরামর্শ দিল, মানুষের কাছে আবেদন করার কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা । তার সাফ কথা, মরতে হয় মরব, শহীদ হওয়ার জন্যই জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি, শহীদ হতে পারিনি কিন্তু এখন বাঁচার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে পারব না। অবশেষে সরকারের কাছে আবেদন করলেন কিন্তু আশানুরুপ সহায়তা পাওয়া গেল না। দীর্ঘ এক বছর ক্যান্সারর সাথে লড়ে ক্যান্সারের কাছে পরাজয় স্বীকার করে অবশেষে তিনি চিরদিনের জন্য চলে গেলেন।
যাওয়ার আগে বার বার করে বলেছেন, আছিয়া, তুই আমাদের সন্তান দু’টিকে দেখিস । এদের মানুষ করার দায়িত্ব এখন তোর।সারা জীবন সৎ থেকেছি, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি , পারলাম না আমি এদের জন্য যুদ্ধ করতে। আমাকে ক্ষমা করে দিস।

সেই থেকে মা আছিয়া বেগম সংসার অনেক কষ্টে সামলে রেখেছেন। সরকারী মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আর বাড়ির সামনের জমিটুকুতে কিছু শাকসব্জি ফলান আর হাঁস মুরগি পালন করে কোনরকমে সংসারটা চালান। ডিম নিজে না খেয়ে জমা করেন এবং হাড়ি পূর্ন হলে তা বিক্রি করে ছেলেকে টাকা পাঠান।অনেক কষ্ট করে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন।ছেলে প্রথম দিকে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিলেও এখন আর টাকা নেয় না। ছেলে বলেছে, মা আমি এখন দুইটা টিউশনি পাইছি । এতে আমার খরচ হয়ে যায় । আর বাড়ি আসার সময় মা বোনের জন্য কিছু নিয়েও আসে।

এই তো আর মাত্র ক’টা দিন। ছেলে বের হয়ে আসলে একটা ভাল চাকুরি করবে তারপর সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়েকে দেখ ছেলেকে বিয়েও দিবেন। বউটিকে নিজের মেয়ের মতেই করে দেখবেন। ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করেছেন।

তিতলী আবার মাকে জিজ্ঞেস করে, মা ভাইয়া কবে আসবে ?

মেয়ের কথায় মা যেন একটু সম্বিত ফিরে পান। মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু ঈষৎ হেসে বলেন, এই তো ঈদের আগেই আসবে। কালকেই না কথা হল তোর ভাইয়ার সঙ্গে।

মা একটু খানিক পর বলেন, হ্যাঁ রে পাশের বাড়ির স্বপন বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি মারামারি চলছে কিন্তু বুলবুলতো আমাকে কিছু বলল না ?

তিতলী জবাব দেয়, তুমি চিন্তা করবা তাই হয় তো বলে নি কিন্তু আমার ভাইয়া তো ওরকম না যে সে মারামারি করবে। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করতেছ মা । ভাইয়া বলেছে, যারা রাজনীতি করে তারাই মারামারি করে। আর আমার ভাইয়া তো রাজনীতি করে না !

মা বলল, শুনলাম দুই টা গ্রুপ নাকি মারামারি করতেছে। কয়েকজন নাকি গুলি খেয়ে আহতও হয়েছে।

সেদিন পুরো দিনটাই মা আছিয়া বেগমের ভাল কাটেনি। কেমন যেন অস্বস্থি লেগেছিল। রাতে ঘুমও হয় নি ভাল করে। ভেবেছিল, পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছেলের সাথে কথা বলবেন।

যথা নিয়মে মা পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে তাকান। দেখে দুরে একটা মাইক্রোবাস দেখা যাচ্ছে। তাদের বাড়ির দিকেই আসতেছে। মা একটু অবাক হয় । এ রাস্তা দিয়ে তো এ গাড়ি সাধারনত আসে না। দেখতে দেখতে গাড়িটি আরো কাছে আসে। হ্যাঁ, তাদের বাড়ির দিকেই আসতেছে। তিতলী ঘুমিয়ে ছিল। মা গাড়িটির দিকে তাকিয়ে তিতলী ঘুম থেকে ডেকে তুলে। তিতলী কিছু বুঝে উঠতে না পেরে চোখ বড় বড় করে জানালা দিয়েই গাড়িটির দিকে তাকায়।

একসময় গাড়িটি তাদের বাসার একটু দুরে থামে । গাড়ির ভিতর থেকেই কে যেন বাইরে রাস্তায় দাড়ানো একটি লোককে কিছু জিজ্ঞেস করে। লোকটি আঙ্গুল উচিয়ে বুলবুলদের বাড়িটি দেখিয়ে দেয়। আছিয়া বেগমের বুকটা ভিতর থেকে মোচোড় দিয়ে উঠে।শরীরটা যেন মুহুর্তের মধ্যেই দুর্বল হয়ে যায়। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয় !

এরপরে গাড়িটি ঠিক তাদের বাড়ির সামনে এসে দাড়ায়। গাড়ি থেকে মুহুর্তের মধ্যে কয়েকজন লোক নেমে পড়ে এবং একটি সাদা কাফনে মোড়ানো লাশ গাড়ি থেকে নামায়। আছিয়া বেগম আর কিছু দেখতে পারেন না। মুহুর্তের মধ্যে মুর্ছা যান মা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৮
১৬টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×