somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাইকার জেনারেশান : গতির নেশা, স্টাইল আর মূল্যহীণ জীবন

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উতসর্গ – সব বাইকার ব্লগার ও আমার বাইকার বন্ধুদের ।
সতর্কতা – কিছু ভয়াবহ দূর্ঘটনার শাব্দিক বর্ননা ও কিছু ছবি দেয়া হয়েছে। সংবেদনশীল মনের পাঠক’দের প্রবেশ না করার অনুরোধ করছি।

আমরা যে চায়ের দোকানের সামনে আড্ডা দেই, সরু ব্যাস্ত রাস্তা, দুইপাশে অনেকগুলো টং দোকান। নারায়নগঞ্জের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা শহীদ মিনারের সামনে এই রাস্তাটিতে। ইয়াং জেনারেশনই বেশি। প্রায় বছর খানেক ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মোটর সাইকেল তথা বাইকের সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। বাহারি চুলে এবং পোশাকে ‘আধুনিক’ এই জেনারেশান প্রচন্ড গতিতে এবং শব্দ তুলে এই সরু রাস্তা দিয়ে বাইকের কারিশমা দেখিয়ে আসা যাওয়া করে। এত বাইক আসলো কোথা থেকে? এই বাইকার রেভ্যুলুশন ঘটলো কবে? বাইকের দাম কি সস্তা হয়ে গেছে, নাকি ছেলেপেলের বাবা’রা হঠাত সবাই বড়লোক হয়ে গেছে? আমি নিশ্চিত; বেশিরভাগ বাইক বাপের টাকায় কিম্বা অবৈধ উপায়ে কেনা, নইলে নিজের কষ্ট করা উপার্জনে কিনলে বাইকের প্রতি কিছুটা হলেও মায়া থাকতো, আর বাইক চালাতে কিছুটা হলেও সাবধানতা অবলম্বন করতো।

কিভাবে ইয়াং জেনারেশন বাইক কিনছে, তা মূল বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে এরা বাইক কিভাবে চালাচ্ছে। এরা বিপদজনক গতিতে বাইক চালায়, হুট করে মোড় নেয়, ট্রাফিক আইন জানেনা বেশির ভাগ। আর এদের অনেকেরই লাইসেন্স নেই, থাকলেও জাল। ট্রাফিক পুলিশ এদের তখনই ধরে, যখন তাদের সেইদিনের ইনকাম কম হয়।

প্রতিনিয়ত ছোটখাট থেকে প্রাণঘাতী বাইক দূর্ঘটনা ঘটছে। আমি পেপার কাটিং কিম্বা পরিসংখ্যানে যাচ্ছিনা, শুধু আপনার আমার চারপাশের পরিচিত জন’দের দিকে তাকান। সেখানে এমন কেউ নেই, যে নিজে কিম্বা তার পরিচিত কেউ বাইক এক্সিডেন্টে পড়েনি।

বাইকের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছিনা। যেখানে দুইবার বাস বদলিয়ে, জ্যাম পেরিয়ে গুলশান থেকে নারায়নগঞ্জ আসতে আমার এক বন্ধু’র লাগে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা, সেখানে বাইক চালিয়ে আরেক বন্ধু পৌছে যায় মাত্র দেড় থেকে ২ ঘন্টায়। কিন্তু একটি দূর্ঘটনা যেভাবে সারা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, সেখানে এই বিপদজনক বাহন আর বেপরোয়া চালনার ক্রমবর্ধমান ক্রেজ দুশ্চিন্তার বিষয়।

লাইসেন্স বিহীন লাইসেন্স
বাংলাদেশে মোটর সাইকেলের অনুমোদন পাওয়া সর্বোচ্চ সিসি হচ্ছে ১৫০। অথচ রাস্তা ঘাটে যেইসব বাইক উড়ে যাচ্ছে সেগুলো কত সিসি? ১৮০, ২২০ এর পালসার; বডি’র সিসি স্টীকার চেঞ্জ করে চলছে অহরহ। এদেশে চাইলেই যেকোন ধরনের কাগজপত্র বের করে ফেলা যায়, সেইজায়গায় মোটর সাইকেলের লাইসেন্স বের করা তো সহজ কাজ। টাকা খাইয়ে অরিজিনাল লাইসেন্সও বের করে ফেলা যায় পরীক্ষা না দিয়েও। আমার পরিচিত একজনের মোটর সাইকেল আর হালকা গাড়ি, দুটো লাইসেন্সই আছে, অথচ তার গাড়ীও নেই, চালাতেও জানে না। চুরি হয়ে যাওয়া বাইকের লাইসেন্স আরেকজনের কাছে বিক্রি খুব লাভজনক ধান্দা কর্তৃপক্ষের অসাধু কর্মচারীদের। আর বর্ডার এরিয়া গুলোতে তো সিসি’র বালাই নেই। সীমান্ত পেরিয়ে বেআইনিভাবে ঢোকা এমন সব বাইক আমি সেখানে চলতে দেখেছি যে, আমার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল।

গতির নেশা এবং স্টাইল
কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি ভয়ংকর বিপদজনক একটি ট্রেন্ড, লুকিং গ্লাস খুলে বাইক চালানো !! কি অদ্ভুত ড্যাম কেয়ার চিন্তাধারা !!
এভাবে বাইক চালানো একজনকে জিজ্ঞেস করায় সে দাত বের করে হেসে উত্তর দিল,
‘ভাবজ !! জানেন, হেব্বি স্পিডে যখন চালাইনা, তখন নিজেরে ডন মনে হয়!’
‘পেছন থেকে কি আসছে দেখো কিভাবে?”
‘আমি দেখবো ক্যান, তারাই দেইখা নিবে !!’
কানে হেডফোন গুজে, চুলে জেল লাগিয়ে আর হাল ফ্যাশনের ড্রেস চড়িয়ে প্রচন্ড শব্দ তুলে যখন একটি ইয়াং ছেলে সাই সাই করে, একেবেকে বাইক চালিয়ে যায় তখন তার মনে কি খেলা করে? শুধুই সেই ‘ভাবজ’। সবাই তাকে তাকিয়ে দেখছে, মেয়েরা আকৃষ্ট হচ্ছে, ভাবছে, ইস, কি দুর্দান্ত !! ছেলেটি জানে না, এ হচ্ছে যৌবনের নির্বোধতম প্রাণঘাতী প্রদর্শনী।

মূল্যহীণ জীবণ
প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দূর্ঘটনা ঘটছে। ভিকটিম সেলিব্রেটি না হলে কিম্বা দূর্ঘটনা খুব ভয়াবহ কিছু না হলে, যার বেশিরভাগ খবর পত্রিকার পাতাতেও আসেনা। কিন্তু প্রতিটি দূর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট মানুষ গুলোর জীবন কি রকম ওলট পালট করে দিয়ে যায়, তা একমাত্র কাছের মানুষ ছাড়া কারো বোঝার সাধ্য নেই। বাইক দূর্ঘটনায় আমার কাছের গন্ডিতে এলোমেলো হয়ে যাওয়া কিছু জীবনের গল্প -

১। নারায়নগঞ্জের মাসদাঈরে বড় রাস্তা পার হচ্ছিলেন এক মধ্যবয়স্কা নারী। বিধবা এই মহিলা একটি স্কুলে ছোট চাকরি করে সংসার চালাতেন। একটী ট্রাক’কে ওভারটেক করে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা এক বাইকের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন, এবং বাইক তার দুই পায়ের উপর দিয়েই চলে যায়। বহুদিনের কষ্টকর চিকিতসা শেষে আজ তিনি নিঃস্ব এবং চিরতরে পঙ্গু।

২। ঢাকা – নারায়নগঞ্জ লিঙ্ক রোড। তীব্রগতিতে আর কৌশলী বাইক চালনায় বন্ধুমহলে সুখ্যাতি পাওয়া এক তরুণ। মুহূর্তের অসাবধানতায় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তায় পিছলে পড়েছিল আর পেছন থেকে আসা বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে সম্ভাবনাময় জীবনটার ইতি টেনেছিল।

৩। আমার খুব কাছের বন্ধুর রুমমেট। মাস খানেক পরেই বিয়ে। অজস্র স্বপ্নের আকিবুকি বুকের ভেতর। ক্লাস শেষে আরেক বন্ধুর বাইকে ডাবলিং করে ফিরছিল। বৃষ্টীভেজা রাস্তায় পিছলে পড়ে স্কিড করে গিয়েছিল তারা অনেকখানি। তারপর এক বাসের চাকা গুড়িয়ে দিয়েছিল ওই স্বপ্নভরা বুকটাকে।

৪। আমার প্রিয় বন্ধু। কারওয়ান বাজার অফিস থেকে বাইকে করে ফিরছিল। এয়ারপোর্ট রোডে সব গাড়িই তীব্র গতিতে চলে। হঠাত সামনে থাকা এক মাইক্রোবাস গতি কমিয়ে দিলে আমার বন্ধুর বাইক সজোরে গিয়ে ধাক্কা খায় সেই গাড়ির পেছনে। আর বন্ধুটি গতি জড়তায় ছিটকে গিয়ে পেছনের মোটা কাচ ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে ভেতরে। ওর হেলমেট দেখে কেউ বিশ্বাস করবেনা, এরপরেও সে বেচে ছিল।

৫। ফার্মগেটে বাইকে সিগন্যালে আটকা পড়েছে এক বড়ভাই। পেছনে তার কলিগ। লম্বা, ফর্সা আর সুদর্শন চেহারা। সিগন্যাল ছেড়ে দিতেই সবগুলো গাড়ি যেন পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করলো। বড়ভাইও দিল টান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এক প্রাইভেট কারের বাম্পারে বাড়ি খেয়ে তারা ছিটকে পড়ে ব্যাস্ত রাস্তায়। আর পড়ার সাথে সাথে পেছনে থাকা সেই কলিগের মাথাটা তরমুজের মতো ফাটিয়ে দিয়ে গেল আরেকটি গাড়ি। আমার সেই বড় ভাইয়ের কিচ্ছুটি হোলনা, আচড় পর্যন্ত লাগলোনা সেই মানুষটির শরীরেও, কিন্তু সেই নায়কের মত চেহারাটার বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট রইল না।

৬। ফেসবুকে কে যেন একটা ভিডিও শেয়ার করেছে। দেখে ঐ রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। মাওয়ায় একটি বাইক এক্সিডেন্ট। মাটিতে শুয়ে আছে রক্তে ভেসে যাওয়া এক তরুন। কোমরের কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে পাশেই পড়ে রয়েছে পুরো একটি পা। নাড়িভুড়ি বেরিয়ে পড়েছে। সবচে করুন ব্যাপার হোল, ছেলেটির জান তখনো বেরিয়ে যায়নি।

৭। এবারের গল্প আমার কারো নয়। অপরিচিত কোন এক ভাইয়ের, যিনি তার মা’কে নিয়ে বাইকে করে যাচ্ছিলেন। হঠাত পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন, মা নেই, পড়ে আছেন এক বাসের জগদ্দল চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে। আহারে, কিভাবে বাকি জীবনটা পার করবে সেই ছেলেটি? মনের ভেতর জেকে বসা সেই দৃশ্য মুছবে কিভাবে?

৮। আমাদের জাতীয় বীর মানজার রানা আর সেতু। বাইক দুর্ঘটনায় উদীয়মান এই দুই ক্রিকেটারকে হারানোর কষ্ট তো আজো আমাদের যায়নি।

আমি বলছিনা, এই দুর্ঘটনাগুলো সব বাইক চালকের দোষেই হয়েছে, তীব্রগতিতে চালনার জন্য কিম্বা অসাবধানতায় অথবা অদক্ষতায়। দূর্ঘটনা; দূর্ঘটনাই। দোষারোপ করে কি আর যা ক্ষতি হয়ে যায়, তা ফেরত পাওয়া যায়? নিয়তিতে থাকলে দূর্ঘটনা যেকোন সময় যেকারোরই হতে পারে, ঠীক কথা। কিন্তু তাই বলে যেচে পড়ে এই অভিশাপের মুখোমুখি হওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?

ধূমপায়ী'দের সতর্ক করার জন্য সিগারেটের প্যাকেটে যেমন ক্ষয়ে যাওয়া ফুসফুসের ছবি থাকে, তেমনি কিছু বাইক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের ছবি দিলাম। মৃতদেহের প্রতি যথাযথ সম্মান আর ছবির ভয়াবহতার জন্য ছবিগুলো বড় করে দেখার অপশন দিলাম না।











সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:২৮
৭৬টি মন্তব্য ৭৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×