চাকরির ক্ষেত্রে বা পড়াশুনার ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক একটি বিষয়। যদিও বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কোটা ব্যবস্থা চালু আছে। এমনকি খোদ আমেরিকাতেও কোটা ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু তারপরও, আমি মনে করি, বাংলাদেশে এ ধরনের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চালু রাখার কোন মানে নেই। সরকারি হিসেব অনুযায়ী দেশের মাত্র প্রায় ৫ ভাগ লোক বেকার। কিন্তু সেটা কতটা সঠিক বোধ করি যে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। তাছাড়া কোটা ব্যবস্থা কোন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে না। আর এটা গণপ্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ১৯ ও ২০ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনও বটে। যেখানে বলা আছে,
১৯। (১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।
(২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য লোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
২০। কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষম, এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”Ñ এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।
(২) রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িকÑসকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই এটা কোন গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হতে পারে না। তাছাড়া কোটা তো আর কোন কোয়ালিফিকেইশন বা যোগ্যতাও নয়। একজন শিক্ষার্থী ১৬-১৭ বছর পড়াশুনা করার পর যখন এ ধরনের বৈষ্যমের শিকার হন। তখন তার জন্য বিকল্প আর কী ধরনের পথ খোলা থাকে, তা আমার ঠিক জানা নেই। আর যদি সাংবিধানিকভাবেই প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক সমান হন। তাহলে কোটা ব্যবস্থাটা কোথা থেকে আসে? আমি জানি না আমার এই প্রশ্নের জবাব কে দিতে পারবে। আর আদৌও কারও কাছে এই প্রশ্নের জবাব আছে কী না, সেটিও আমার জানা নেই।
একজন শিক্ষার্থী পড়াশুনা শুরু করেন, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ একটা মন নিয়ে। তার কিছু স্বপ্ন থাকে। থাকে ছোট ছোট কিছু আশা। কিন্তু পড়াশুনা শেষ করার পর ঐ ব্যক্তির চাকরি না পাওয়াটা শুধু তার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে না। আদতে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটাকেও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। সম্প্রতি আমার পরিচিত কয়েকজন বন্ধু চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যক্তি যখন কোন নির্দ্দিষ্ট পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। তখন তিনি ঐ নির্দ্দিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের সাবজেক্ট বা বিষয়ে যিনি পড়াশুনা করেছেন চাকরির পরীক্ষার সময় কিন্তু যোগ্যতার মাপকাঠিতে তারা উভয়েই একই পাল্লায় থাকেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে যখন এ ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েন, যে সে কেন এই সাবজেক্ট বা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পড়াশুনা করেন নি। তখন বোধকরি চাকরিদাতার যে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে তাই স্পষ্ট হয়ে উঠে। এটা কী ঐ ব্যক্তি দোষ যে, তিনি একটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে, অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য আবেদন করে, পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারভিউ পর্যন্ত পৌছতে পেরেছেন? না কি এটা তার যোগ্যতা যে, সে অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেও পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছেন? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবে এটাই ঘটে (দু একটা ঘটনা কখনও উদাহরণ হতে পারে না)। আসল কথা হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান বা চাকরিদাতার, চাকরি দেবার কোন ইচ্ছা নেই। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, চাকরির আবেদনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা, আর এটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে কিছু অর্থ এনে দেয়া। আদতে তারা তো লবিংবাজদের একজন হয়েই কাজ করেন। আর অন্যদিকে মরার উপর খাড়ার খা হিসেবে কোটা ব্যবস্থা তো আছেই। তাই চাকরি পাওয়াটা কিন্ত আসলেই মুস্কিল। আর এটা ভাববেন না যে, পড়াশুনা শেষ হয়ে গেল বেচে গেলাম। বরং আমি তো বলি, আরও অন্ধকারে পড়লেন। আর এখান থেকে উদ্ধার করারও কেউ নেই। আমার ধারণা ডারউইন এসময়টাতে জন্ম নিলে, ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ অর্থাৎ ‘যোগ্যতমের টিকে থাকার’ তত্ত্বটা একটু হলেও ভিন্ন হতো!
একদিন প্রজাতন্ত্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বন্ধুর রুমে গেলাম (সে হলের আবাসিক ছাত্র)। তখন সে আমাকে অদ্ভুত একটা কথা শোনালো। সে বলল, তার হলের নাকি ১৫-২০ জন ছাত্র উধাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, উধাও মানে? উত্তরে সে আরও চমকপ্রদ তথ্য দিলেন। সে বলল, তাদেরকে (এই ছাত্রদের) কোন এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বাইরের দুনিয়ার সাথে তারা সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এর মানে কী? সে বলল, সে জানতে পেরেছে যে, ওরা টাকার বিনিময়ে, ঐ ব্যক্তিদের সাথে যেতে রাজি হয়েছে এবং সেখানে গিয়ে তারা নির্দ্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করছে। আমি বললাম তাহলে তো তোমার অবস্থা সঙ্গীন। সে বলল, শুধু আমার কেন, আরও অনেকের অবস্থাই সঙ্গীন। কারণ একে তো কোটা ব্যবস্থা, তার উপর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া আর দলীয় লোকের নিয়োগ তো আছেই। আমি এতক্ষণ যে ঘটনাটির অবতারণা করলাম, সেটি ৩৩ তম বিসিএস পরীক্ষার লিখিত প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সময়কার একটি ঘটনা।
এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী পড়াশুনা শেষ করে কেবল যোগ্যতার বলে অহরহ চাকরি পাচ্ছেন না। আবার বিভিন্ন পরীক্ষার ইন্টারভিউয়ের আগে আগে নাকি হল থেকে লিস্ট যায়। এদিকে আবার কিছুদিন (প্রায় মাসখানেক) আগে পুলিশ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং উত্তর সরবরাহের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের সংবিধান
সিআইএ: দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক
বিভিন্ন পত্রিকা
ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার