somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় মাইকেল

২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্বিতীয় মাইকেল
-এ. এস. রাজ

মাইকেলের হাত ধরে বাংলা ভাষায় যে প্রথম মহাকাব্য রচিত হয় তা বাংলা সাহিত্যে চির দিন একটি মাইল ফলক হিসেবে থাকবে। পশ্চিমা ভাবধারায় পুষ্ট মাইকেল কি কোন দিন দেশি পুরাণকে কাজে লাগিয়ে মহাকাব্যের দীর্ঘ ইতিহাসের নক্সী কাঁথার মাঠে নতুন একটি মানচিত্র একে দিবে এবং বাংলা সাহিত্যকে একটি নিদিষ্ট মর্যাদার আসনে বসিয়ে দেবে তা কেউ কোন দিন ভাবতেও পারেনি । মাইকেলের মধ্যে নিরোদ চৌধুরীরমত চরম মাত্রাই ইংরেজপ্রীতি লক্ষ্য করা যায়। যাকে ইংরেজীতে বলে অহমষড়সধহরধ বলে। যেভাবেই হোক মাতৃটানে নিজের মাটিতে ফিরে আসা মাইকেল নিজের ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য যখন মনোনিবেশ করলেন তখন অবশ্যই বহুভাষার পন্ডিত মাইকেল বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাবধারায় আর্শীবাদ পুষ্ট হয়ে নিজের মহাকাব্যকে একটি উৎকৃষ্ট মানের মহাকাব্যে পরিণত করার অসাধারণ সুযোগ পেয়ে গেলেন । শুধমাত্র রামায়ণের প্লটটি ধার করে নিজের মনের মাধূরি মিশিয়ে প্রতিটি চরিত্রকে এমন ভাবে নিজে হাতে গড়ে তুলেছেন যা মূল কাহিনীর থেকেও শক্তিশালী হয়ে গেছে যেমনটা বিষাদ সিন্ধুতে মীর মশাররফ হোসেন এক করুণ কাহিনীকে এক অসাধারণ ট্রাজেডিতে পরিণত করেছেন শুধুমাত্র লিখনি শক্তির জোরে।

যেহেতু মহাকাব্যের সংজ্ঞা অল্পতে দেওয়া সম্ভব নয় সেহেতু এই বিষয়টিকে আমি এড়িয়ে যেতে চাইছি। কিন্তু দেখতে চাইব এর প্রকারভেদ, আর বিভিন্ন মহাকাব্যের সাথে মাইকেলের মহাকাব্যেও একটি তুলনা । শুরুতেই জানা দরকার পশ্চাত্যে মহাকাব্য কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

এক. জাত মহাকাব্য (Epic of growth /authentic epic)
দুই . সাহিত্যিক বা অনুকৃত মহাকাব্য (imitative epic)

সাধারণ অর্থে যে মহাকাব্যটি কোন নিদিষ্ট এক ব্যক্তির দ্বারা লিখিত না কিংবা বহু বছর লোকমুখে বার বার ফিরে ফিরে এসেছে এবং পরবর্তীতে সংকলিত হয়েছে তাকে জাত মহাকাব্য বলে । যেমন রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াদ ও ওডিসি ইত্যাদি। আর মহাকাব্যিক উপাদান ঠিক রেখে একজন কবি যখন কোন মহাকাব্য রচনা করেন তখন তাকে সাহিত্যিক মহাকাব্য বলে। যেমন-- মেঘনাদবধ, প্যারাডাইস লস্ট ইত্যাদি।

বিভিন্ন মহাকাব্য থেকে বিভিন্ন চরিত্রের অধ্যয়ন করে নিজের মহাকাব্যে মাইকেল যে অসাধারণ সমন্বয় করেছেন তাই এই এখন আলোচনার বিষয়।

ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ হিসেবে সব সময় হেলেন কে দায়ী করা হয় । কিন্তু তারও আাগের কাহিনী আছে । অলিম্পিয়াস পর্বতের তিন দেবী হেরা , অ্যাফ্রোদিতি ও এ্যাথিনার মধ্যে তুমুল ঝগড়া বাধে কে সব চেয়ে সুন্দরী । তখন গ্রীক পুরানের প্রধান দেবতা জিউস পৃথিবীতে একটি আপেল ছুড়ে মারেন এবং শর্ত হিসেবে থাকে যে ব্যক্তি এই আপেলটি পাবে সেই নির্ধারণ করবে কে সবচেয়ে সুন্দরী। শেষমেষ আপেলটি পায় প্যারিস । তিন দেবী প্যারিস কে বিভিন্ন প্রলোভন দেয়। অ্যাফ্রোদিতি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী দিতে চাইলে প্যারিস অ্যাফ্রোদিতির হাতে আপেলটি তুলে বিজয়ী ঘোষিত হয়।

কিন্তু সমস্যাটি হল ঠিক এই জায়গাতেই। হেলেন তো রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী। অ্যাফ্রোদিতি প্রতিশ্র“তি রক্ষা করে হেলেন প্যারিসের প্রণয় উপাখ্যান রচনা করা মাত্রই গ্রীক ও ট্রোজানদের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ । এই জন্যই বলা হয় অঢ়ঢ়ষব ড়ভ ফরংপড়ৎফ .
ঠিক রামায়ণেও আমরা দেখতে পায়, সীতা অপহরনের পর থেকেই রাম Ñ রাবণের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ । রাম কে সাহায্যের জন্য সর্বদা পাশে ছিল ছোট ভাই লক্ষণ । আর মেনেলাউসের স্ত্রী উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে বড় ভাই অ্যাগামেমনন।

ঠিক একই ভাবে দেখা যায় Ñ মেঘনাদ হল রাবণ পুত্র । আর হেক্টর, প্যারিসের বড় ভাই, হল ট্রোজান রাজা প্রায়ামের পুত্র। শুধু মাত্র পার্থক্য এইটুকু রাবণের সীতা হরনের জন্য পিতার পক্ষে যুদ্ধ করতে হয়েছে মেঘনাদ কে। আর প্যারিসের হেলেন নিয়ে পালিয়ে আসায় প্যারিসের জন্য যুদ্ধ করতে হয় পিতা প্রায়াম ও বড় ভাই হেক্টর কে ।

এমন উল্লেখ যোগ্য আরও অনেক মিল আছে ইলিয়াদের সাথে । ইলিয়াদের প্রধান চরিত্র একিলিস, রাজা পেলিয়াসের এবং দেবী থেতিসের পুত্র। একিলিসের বন্ধু প্যাট্রোকোলাসের মৃত্যুতে যেমনটা একিলিস শোকাহত হয়েছে ঠিক তেমনি শরবিদ্ধ লক্ষণকে পাশে নিয়ে বড় ভাই রাম শোকাহত হয়েছে।

আবার হেক্টর ও মেঘনাদের মধ্যেও একটি বিশেষ মিল খুজে পাওয়া যায়। হেক্টর পতœী অ্যানড্রোমাকি ও মেঘনাদ পতœী প্রমীলা কে আমরা স্ত্রী প্রেমিকা হিসেবে দেখতে পাই। বীর পতœীদ্বয় স্বামী চিন্তায় ব্যস্ত। তবে বীর রসে লিখিত হলেও হেক্টর ও মেঘনাদ কে যথেষ্ট সুপুরুষ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।

পতœী অভিমানী হলে মেঘনাদের কেমন অনুভূতি হয় তা কাব্য থেকে একটি উদাহরণ না দিলে ব্যাপারটি মনে হয় অপূর্ণ থেকে যায়।

সূর্যকান্তমনি ..........................
সম এ পরাণ কান্ত ,রবিচ্ছবি; -------
তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ণ ।

এরকম অনেক মিল রয়েছে দুই ভিন্ দেশী মহাকাব্যের মধ্যে । শুধু মাত্র হোমার থেকে নয় Ñ প্রাই সব বড় মানের মহাকাব্য থেকেই একটু একটু করে ধার নিয়ে চরিত্র চিত্রায়ান কে উৎকৃষ্ট করে তুলেছে মাইকেল । যার ফলে বিভিন্ন উপাদানের আর্শীবাদ পুষ্ট হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্য। তবে একটি দুঃখ বাঙালী কবিদের উপর আমার রয়েই গেছে। যেখান থেকে ইলিয়াদ শেষ ঠিক সেখান থেকে শুরু হয়েছে দুটি মহাকাব্যের এক.ওডেসি ও দুই ঈনিড।

কিন্তু বাংলা ভাষায় পুরাণ একটু বৃদ্ধি করে এবং সাহিত্য অতিরঞ্জন মিশিয়ে যদি আরো কয়েক খানি মহাকাব্য রচনা করা যেত তবে মহাকাব্যের আকালের যুগে বাংলা ভাষা আরো একধাপ এগিয়ে যেত বিশ্বের দরবারে । আমরা মাইকেলের পরে যে কোন মহাকাব্যিক পাইনি এমনটা নয় । তবে মেঘনাদবধ যেখানে শেষ সেখান থেকে যদি শুরু করা যেত নতুন কোন মহাকাব্য তবে ব্যাপারটি বেশ লোমহর্ষক হত । হোমারের ধারাবাহিকতা কে কাজে লাগিয়ে চমৎকার ভাবে রচিত হয়েছে ভার্জিলের ঈনিড; আজ আমরা শত বছর পরেও অপেক্ষায় রয়েছি দ্বিতীয় মাইকেলের ।

*মাসিক সুহৃদ * বর্ষ ০১ * সংখ্যা ০২ * উৎসর্গ: মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×