somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অচেনা চীনে ১৫

২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চীনের বাঙালি ২
ওয়াহেদ ভাইকে ফোন করার পর অনেকক্ষণ হয়ে গেল। লাগেজ হাতে না পাওয়ায় এয়ার পোর্ট থেকে বের হতে পারছিলাম না। এর মধ্যে অয়াহেদ ভাই দু বার আমার খোঁজ করেছেন। আমি তখনও প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ বর্গ মিটারের এয়ারপোর্ট টার্মিনালে লাগেজের জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চাংসুই এয়ারপোর্টের ১ নম্বর টার্মিনাল চীনের ২য় বৃহত্তম। প্রচুর দোকান পাট, বাচ্চাদের খেলার যায়গা, লাউঞ্জের ছড়াছড়ি। এ গলি সে গলি ঘুরে আমি যখন লাগেজের নাগাল পেলাম ততক্ষণে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ওয়াহেদ ভাই আবার ফোন দিয়ে বললেন আপনি গেটের বাইরে এসে আমাদের গাড়ি পাবেন, চাইনিজ ড্রাইভার, সব কিছু বলা আছে, ও আপনাকে গেস্ট হাউসে নিয়ে আসবে।

গেট থেকে বের হতেই একজন চাইনিজ হাসি মুখে হাত নাড়লো, আমি নি হাউ বলার প্রস্তুতি নিতে নিতে সে আমাকে চমকে দিল স্লামালেকুম বলে, তার পর পরিস্কার বাংলায় বললো ভালো আছেন? আমাকে ওয়াহেদ ভাই পাঠিয়েছে। আমার মাল পত্র গাড়িতে তুলে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে ঊঠে বসলো সে। যেতে যেতে আলাপ হল তার সাথে। ইংরেজির চেয়ে বাংলা ভালো জানে। ওয়াহেদ ভাইদের সাথে বেশ কয়েক বছর থাকতে থাকতে বাংলা শিখে ফেলেছে। আর ওয়াহেদ ভাইএর গেস্ট হাউসের বেশির ভাগ মেহমান যেহেতু বাংলাদেশের, বাংলা শিখে লাভ কম হয়নি। তার বাবাও চাকরি করে ওয়াহেদ ভাই এর অখানে। বাপের সাথে দেখা হয়েছিল রাত্তিরে। বাপ বেটা ভালোই আছে বাঙালি মনিবের কাছে।মিনিট দশেক উঁচু রাস্তায় চলার পর গাড়ি হঠাত ঘুরে একটি ছোট রাস্তায় নেমে এল।

ছোট্ট একটি গঞ্জে ঢুকলাম আমরা। চালক জানালো ওয়াহেদ ভাই এর বাসা বেশি দূরে নয়। এলাকাটি একটু উঁচু নীচু, তবে ঠিক পাহাড়ি এলাকা এটি নয়। একটি চড়াই পেরিয়ে, দুই গলি পর একটি বন্ধ গেটের সামনে থামলো আমাদের গাড়ি। ২০-২২ বছরের এক বাঙালি তরুণ আমাকে স্বাগতঃ জানালো দরজা খুলে। তার পেছনে আরও তিন জন বাঙালি যুবক, হাজির হল গাড়ির কাছে। ড্রাইভারের সাথে তাদের কথপকথনে মনেই হচ্ছিল না যে আমি বাংলাদেশে নই, অথবা ড্রাইভারটি বাংলাদেশি নয়।(এই পটলা, এত দেরি করলি যে, শহরে যাব কখন? ভাই জান জাস্ট উড়ে যাবো, উঠে বসেন)।

ওয়াহেদ ভাই এর বাড়িটি তিন তলা। অনেকটা পুরোন ঢাকার বাড়ির মত। নিচ তলায় এক চিলতে বারান্দা, টিভি রুম অথবা লিভিংও বলা যায়, পাশেই ডাইনিং স্পেস, আট জনের ডাইনিং টেবিল আরও দু’তিনটি ছোট ছোট রুম।আমাকে দেওয়া হল দোতলার একটি ঘর।ওয়াহেদ ভাই এর সাথে দেখা হলনা। যে ছেলেটি আমাকে নিয়ে এল তার নাম ওয়াযেদ। সে বললো আপনি বিশ্রাম করেন, মামা একটু বাইরে আছেন, চলে আসবেন একটু পরে। আমার বিশ্রাম নেবার কোন ইচ্ছা ছিলনা, তখন তিনটা বেজে গেছে, আমার ফ্লাইট রাত বারোটায়। সময় নষ্ট করার সময় নেই। বললাম আমি তো শহরে যাবো। অবাক হল ওয়াজেদ, বুলছেন কী?আগে বুলবেইন না? গাড়ি তো নিয়ে গেল ওরা তিন জন।কথায় চাঁপাই নবাবগঞ্জের টান স্পষ্ট। মন আর মেজাজ দু’টিই খারাপ হয়ে গেল আমার। ওয়াহেদ ভাই কে বলেই এসেছিলাম আমি কুনমিং দেখতে যাবো, এখানেই যদি বিশ্রাম নিতে হয় তাহলে তো সরাসরি বিমান বন্দর থেকে চলে যেতে পারতাম! আমি বললাম আমাকে একটা ট্যক্সিতে ডেকে দাও আমি যেতে পারবো
- এখানে আপনি ট্যক্সি পাবেন কোত্থেকে, এটাতো গ্রামের মত, আর টাকা লাগবে অনেক।
- তা হলে বাসে তুলে দাও।
আমার মনোভাব বুঝতে পেরে চিন্তিত হয়ে পড়লো ওয়াযেদ। আপনি চীনা ভাষা জানেন? একা একা কোথাও হারিয়ে যাবেন, মামা থাকলে আমি লিয়ে যেতে পারতাম। শেষ পর্যন্ত রাজি হল ওয়াজেদ, ঠিক আছে, চলেন দেখি বাস পাই নাকি।

একেবারেই ছোট্ট শহর(?) ডাবানকিও। একটা মেইন সড়ক ছাড়া বাকি গুলো ছোটই বলা যায়, তাও আবার ধুলি ধুসরিত, কোথাও কাদা পানি জমা, ম্যাপে বলা আছে শিল্প শহর। একটি বাস স্টপ আছে শহরের কোনে। সেখানেই নিয়ে গেল ওয়াজেদ আমাকে। কুনমিং এর ভাড়া ১ ইউয়ান। ওয়াজেদ নিজেই ড্রাইভার কে ভাড়ার টাকা দিয়ে আমাকে কোথায় নামাতে হবে বলে দিল।আব্দুল ওয়াহেদের একটা কার্ড আমার হাতে গুজে দিয়ে বলল, অসুবিধায় পড়লে মামার কার্ড দেখাবেন এখানে ঠিকানা লেখা আছে।এই বাস কোথায় থামে দেখে সেখান থেকেই বাস ধরবেন, বলবেন তাপাংসু যাব। বললাম কার্ডে তো ডাবানকিও লেখা।
ওয়াজেদের কোন ভাবান্তর হল না। লেখা যায় থাক এরা তাপাংসু বলে, আপনিও বুলবেন। বাস থেকে নেমে আসার সময় আবার ড্রাইভার কে বুঝিয়ে বলল সে। আমার মত একদিনের অতিথির জন্যে ওয়াজেদের মমত্ব দেখে আবেগে চোখ ভিজে এল আমার।
অনেক গুলি স্টপেজ পেরিয়ে সোয়া-চারটার দিকে বাস থামল শেষ স্টপেজে, বাসে তখন ড্রাইভার আর আমি ছাড়া কেঊ নেই।বাস থেকে নেমে চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখে নিলাম, আবার এখনেই আসতে হবে বাসের জন্যে। সিটি সেন্টারের কাছেই একটি ছোট গলি দিয়ে বাস ঢুকে গেল বাস ডিপোয়।

য়ুনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং।যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ২৭৯ বছর আগে, দিয়েন রাজাদের হাতে গোড়াপত্তন হয়েছিল এ শহরের। তার দেড়শো বছর পর হ্যান বংশের কাছ হাত বদল হয় নগরের কর্তৃত্ব। দক্ষিণ সিল্ক রোডের সুবাদে কুনমিং হয়ে ওঠে চীনের সাথে ভারত উপমহাদেশসহ অন্যান্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশের সাথে যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র। সে সময় কুনমিং ইঝৌ নামে পরিচিত ছিল। ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে শিউ রাজারা ইঝৌ এর নাম বদলে রাখে কুনঝৌ। এরপরও বহু বার নাম পরিবর্তন হয়েছে এ শহরের, হাত বদল হয়েছে ক্ষমতার। ইঝৌ থেকে আধুনিক কুনমিং হতে প্রায় দুই হাজার বছর লেগে গেছে এ নগরের।প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন শহরটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে ১৯১০ সালে হ্যনয় কুনমিং রেল লাইন চালু হবার পর।১৯১২ সালে কাউন্টির মর্যাদা কুনমিং।এর আঠারো বছর পর ১৯৩০ সালে কুনমিং – চোংকিং হাইওয়ে চালু হবার পর কুনমিং এর অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়। দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের সময় সেনা ছাউনির কারনে কুনমিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বার্মার সাথে যোগাযোগের সুবিধার জন্যে এসময় মার্কিন এয়ার বেইস গড়ে ওঠে এখানে। ভিয়েতনাম, লাওস আর বার্মার মধ্যে যোগাযোগের কেন্দ্র হিসাবে কুনমিং এর সামরিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায় হঠাত করেই। একই সাথে এটি হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সবচেয়ে কার্যকরী বানিজ্য কেন্দ্র। ১৯৩৭ এর চীন-জাপান যুদ্ধ কুনমিংগের জন্যে শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। জাপানিরা পূর্ব উপকুলের বিপুল সঙ্খ্যক চীনা শরণার্থীকে ঘর ছাড়া করে। নিরুপায় এই চীনাদের ঠাঁই দক্ষিণ পশ্চিম চীনের এই নগরীতে।জাপানের তাড়া খাওয়া চীনাদের অনেকেই ছিল বিপুল বৈভবের মালিক। তাদের টাকায় কুনমিংএর অর্থনীতির চাকা গতি পায়।এসব কেতাবি ইতিহাস ভাবতে ভাবতে আমি কুনমিং এর রাস্তায় হাটতে থাকলাম। আমার কুনমিঙ্গে আসার অন্যতম কারন দুই হাজার বছর পুরোনো শহরটিকে বর্তমানের আলোয় দেখা। মিউনিখে দেখেছি মহাযুদ্ধের থাবায় ক্ষত বিক্ষত শহর কীভাবে ধ্বংসস্তুপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিভিন্ন স্থাপনা আবার পুরনোটির মত করেই তৈরি করা হয়েছে সেখানে। কুনমিংএ সেই আমেজটি পাচ্ছিলাম না দুটি কারণে। প্রথমতঃ আকাশ ছোঁয়া বাড়ি ঘর, চোখ ধাঁধানো বিপনিকেন্দ্র, নাগরিক কোলাহল সব মিলিয়ে দারুন কর্ম চঞ্চল এশহরে শুধু ইতিহাস হাতড়াতে আসে খুব কম লোক।দ্বিতীয়তঃ ভাষার দূরত্ব।পথ নির্দেশনার জন্যে দু’একবার পথচারিদের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। লাভ কিছু হয়নি, ক্ষতির মধ্যে সময় নষ্ট। ইংরেজি সাইনপোষ্ট দেখে পথ চলতে থাকলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:০৪
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যারিস্টার সুমন দায়মুক্ত , চু্ন্নু সাহেব কি করবনে ?

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৭


দেশে প্রথম কোন সংসদ সদস্য তার বরাদ্ধের ব্যাপারে Facebook এ পোষ্ট দিয়ে জানিয়ে থাকেন তিনি কি পেলেন এবং কোথায় সে টাকা খরচ করা হবে বা হচ্ছে মানুষ এসব বিষয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৮










চিত্রকলার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোট বেলায় যেটুকু শিখেছিলেন গৃ্হশিক্ষকের কাছে আর পাঁচজন শিশু যেমন শেখে। সে ভাবে আঁকতেও চাননি কোন দিন। চাননি নিজে আর্টিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতা বনাম ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত বিবিধ দোষ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৪



জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতার বিবেচনায় মুমিন ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত দোষারোপ আমলে নেয় না। আমার ইসলাম সংক্রান্ত পোষ্ট সমূহে অমুসলিমগণ ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে বিবিধ দোষের কথা উপস্থাপন করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×