somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তগদ্য: পরীপুকুর

২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের একটি পুকুর ছিলো। পুকুর ছিলো বললে ভুল বলা হবে কেননা কেবল বর্ষাকালেই ওটাতে পানি থাকতো— বর্ষার পরে পরে পানি শুকোতে থাকতো রোদের তলে প্রতিদিন। তারপরও অনেকদিন থাকতো। ছয়সাতমাসতো থাকতোই। এটা হতো বালির কারণে। নদীর চরে বালি থাকবে না তো কী থাকবে। পুকুরপাড়ে অনেক পাথর ছিলো, বড় বড় পাথর। আমাদের বাড়ির সামনে যে বড় রাস্তা আরাকানের দিকে চলে গেছে— ওটা বানানোর সময় এই পাথর আনা হয়েছিলো অথবা নদীর পলি থেকে এঁটেলমাটিগুলি আলাদা হয়ে বছরের পর বছর ধরে এই পাথরগুলিতে রূপ নিয়েছে। আমি অবশ্য জানি না এঁটেলমাটি থেকে পাথর হয় কিনা— অনুমানে বললাম। প্রতিবছর বন্যা হতো বলে প্রচুর পলি জমতো আমাদের ভিটায়। এটা নদীর চর ছিলো। নদী ওধারে সরে গেছে পাড় ভেঙে ভেঙে। এধারে পাড় হলো আমরা হয়তো মাছ কিংবা শামুক হয়ে যেতাম। আমাদের ভাগ্যে ছিলো আমরা কাশবনে প্রজাপতি হবো।

পুকুরের গভীরতা ছিলো না বলে আমরা অনেকটা সময় ঝাপাঝাপি করতাম। জলের তলে পাথর ধরে একমিনিট বসে থাকতাম। চোখ খুলে সবুজ আলো দেখতাম।

পুকুরের পাড়ে যে পাথরেরা ছিলো যে আনারসের ঘের ছিলো— তাদের ফাঁকে ফাঁকে সাপ আর বেজিরা থাকতো। বেজি মানে নকুল অথবা নেউল। দেখতে অবশ্যই সজারুর মতো নয়। আমাদের ছোটোবেলায় আমাদের গোলঘরের জানলা দিয়ে সাপ আর বেজির খেলা দেখতাম। গোলঘরকে আমরা বাংলোও বলতাম। এটা আসলে আমাদের বসার ঘর ছিলো। সাপ আর বেজির খেলা দেখতে অনেক ভয় লাগতো— তারপরও দেখতাম। ক্যাসেটে বাজতো লতার গান, মেরা তন দোলে, মেরা মন দোলে... এই গানটার সুরে সাপুরিয়া বাঁশির তীব্র একটা ব্যাপার ছিলো। ফলত সাপেনেউলে এমন নৃত্য করতো যে আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে যেতো। তারপরও এই খেলাদেখা আমাদের প্রিয় শখগুলির একটি ছিলো। এইসব কথা আমি মৃন্ময়ীর কাছে বলেছিলাম— সে বিশ্বাস করেছিলো, সত্য কথা তো বিশ্বাস করবেই। কিন্তু সে যখন তার পাড়ার মেয়েদের বললো তারা বিশ্বাস করে নি। বলেছে আমি নাকি একটা পাগল আর আমার কথাগুলি প্রলাপ। ধূলিকণা বিশ্বাস করেছিলো কিনা জানি না— কেবল জানি সে আমাকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।

পুকুরপাড়ে একটা বরইগাছ ছিলো। এই গাছে দুইরকমের বরই ধরতো। একপাশে কলকাইত্তা বরই আরপাশে হরো বরই। কলকাইত্তা মানে বড়ো বড়ো মিষ্টি বরই— যেসব বরই কলকাতা থেকে আসতো। হরো মানে দেশী টক বরই। একইগাছে দুইপ্রজাতির বরই হওয়াটা খুবি সম্ভব। আমার নানাভাই যেইবার কলকাতা গেলো— আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিলো চোখসমেত একটা বরইগাছের ছোট্ট ডাল। এই ডাল আমার মা আমাদের পুকুরপাড়ের হরো বরই গাছে কলম করে জুড়ে দিয়েছিলো কোনোদিন। তারপর সেই ডাল শাখায়পাতায় বেড়ে একপাশটা হয়ে গেলো কলকাতার বরই গাছ। তারপর আরো একবছর পর আমার নানাভাইয়ের লাশ এনে যখন আমাদের গোল ঘরে উত্তরশিথান করে শোয়ানো ছিলো— ননাভাইয়ের চোখ ছিলো খোলা। আমার বাবা আলতো হাতে চোখদুটি উজিয়ে দিলো। আর আমাকে বললো, যা বরইপাতা নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে গাছের দুইপাশ থেকে দুইটা সদ্যঝরা বরইপাতা কুড়িয়ে এনে বাবার হাতে দিলাম। বাবা বরইপাতা দুটি দিয়ে নানাভাইয়ের দুইচোখ ঢেকে দিলো। মা কাঁদছিলো দেখে আমার কেমন ভয় ভয় লাগছিলো। আমি নানাভাইয়ের মৃতদুইচোখের উপর বরইপাতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আর একটা দালিমগাছ ছিলো পুকুরের এইপাড়ে নয়নতারার ঝোপের পাশে। দালিম মানে ডালিম। ডালিমকে আমার দালিম বলতে কেনো ভালো লাগে তা ঠিক জানি না। হয়তো ডালিমকুমারকে দালিমকুমার বলতাম বলে। যাইহোক লাল হয়ে রৌদ্রের ভিতর ফুটে থাকতো দালিমের ফুল। কখনো ঝরে ঝরে পড়তো পুকুরের সবুজ জলে। এই ফুলে লালপরীরা এসে বসতো বলে দালিমের ধরন হতো পরীদের স্তনের রূপ। এইকথা আমাকে কেউ বলে দেয় নি— আমি নিজে নিজে ভেবে বের করেছি।

তোমরা এখন যাকে অরিগামি বলো তা তখন ছিলো পরীগামী কাগজের নৌকো, আমরা অংকখাতার গুণ আর ভাগ অংশের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে বানাতাম কাগজের নৌকো আর আমাদের পুকুরের জলে ভাসাতাম, নৌকো ভরে দিতাম দালিম আর নয়নতারা ফুলের পাপড়ি— ভাবতাম এই নৌকো ভেসে যাবে পরীর দেশে— পরীরা এই নৌকোয় চেপে আসবে আমাদের পুকুরপাড়ে, হবে দালিমের মায়াবতী রূপ।

পুকুরটা আসলে পুকুর হিশেবে কাটা হয় নি এটি কাটা হয়েছিলো আমাদের বাড়ির ভিটা ওখান থেকে উঠানো মাটি দিয়ে উঁচু করার জন্যে। আমাদের ছিলো তখন কাঠের দোতলা বাড়ি। দোতলার জানলা দিয়ে পুকুরটাকে জলজ্যান্ত পুকুর মনে হতো বর্ষাকালে। দোতলার জানলায় যাওয়া মানে আমাদের কাছে ছিলো অনেক উঁচু পর্বতের জানলা—চক্রাকারে দৌড়তে দৌড়তে গোলঘরকে যেমন আমাদের মনে হতো তেপান্তরের মাঠ।

একদিন ভরদুপুর, সুমসাম। কেউ ছিলো না ঘরে। আমি একা পুকুরপাড়ে নয়নতারার পাপড়িতে তিনটা হলুদ প্রজাপতির খেলা দেখছিলাম। সহসা শোঁ শোঁ শব্দে পাশ ফিরে দেখি রামধনুর মতো বিশাল আর ঝলমলে ডানা উদ্ভিদের মতো জেগে উঠছে পুকুরের দুইপাড়ে। আমি তাকাতেই মিলিয়ে গেলো। আমি রাতে একা পেয়ে মাকে বললাম চুপিচাপ, মা হেসে উড়িয়ে দিলো আমার কথা। আর ধূলিকণা বিশ্বাস করেছিলো কিনা জানি না— কেবল জানি সে আমাকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।

আমার কথা কেউ বিশ্বাস করতো না। একদিন গভীর পূর্ণিমারাতে যেদিন পুকুরটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে চলে গেলো কোথাকার কোন আকাশে সেদিন প্রথম আমার মাকে মানতেই হলো পুকুরটার প্রাণ আছে— পুকুরটা আসলে এক বৃহদাকার পরীই ছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৪৪
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×