somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই পোস্টটির লেখক এনাম মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাইক্রোবায়োলজি লেকচার ক্লাস চলছিলো। হঠাৎ খুব হৈ-হুল্লোড়। নতুন কি? হাসপাতালে এরকম হয়েই থাকে। ক্লাস শেষ করে নিচে নামলাম। তখন ১০ টা। চারদিকে এতো ভিড় কেন? অ্যাম্বুলেন্সে করে এতো মানুষ আসছে কেন? কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো। কি অবস্থা একেকটা রোগীর! তাকানো যায় না! চোখে জল টলমল করা শুরু করে দিল। ঠাহর করতে পারি নি এভাবে স্রোতের মতো অ্যাম্বুলেন্স আসবে। শক্ত হবার চেষ্টা করলাম, আবেগে গলে পড়ার সময় না এখন। ইতোমধ্যে সহপাঠী- সিনিয়র- জুনিয়র অনেকেই কাজে নেমে পড়েছেন। অ্যাপ্রন গুটিয়ে শুরু করলাম। প্রায় সব শিক্ষক- ছাত্র- কর্মকর্তা-কর্মচারী ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছেন।

এক অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নামাতে না নামাতেই চলে আসে আরেকটা। যারা উপস্থিত সকলে যেন দিশেহারা। এত ট্রলি, এতো হুইল চেয়ার আনা- নেয়ার লোক কোথায়? কর্মচারীদের সাথে হাত লাগালো এখানেও ছাত্ররা, আশেপাশের মানুষেরা। একেকজনের সর্বাধিক শক্তি দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে, কতটা দ্রুততার সাথে যে আনা- নেয়া করছিল, তা কল্পনাতীত। একেকজনের চেহারায় যে কতটা উদ্বেগ, কতটা আতঙ্ক তা বলে বোঝাবার না।

এক সময় রোগীদের সংখ্যার সাথে আর তাল মেলাতে পারছিল না ট্রলি আর হুইল চেয়ারগুলো। এখন এক ট্রলিতেই দু’জন। তবুও পারা যাচ্ছে না। এবার কোলে করে দৌড়ে ভেতরে নিয়ে যাবার পালা। তাই শুধু এখানে- ওখানে রক্ত নয়। অ্যাপ্রনগুলোতেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ; রক্তের মাখামাখি। এক সময় খেয়াল করলাম সদ্য এম,আর,সি,পি করে আসা স্যারএর অ্যাপ্রনটা ছিঁড়ে গেছে ইতোমধ্যে।

ইমারজেন্সি রুমে ঢুকলাম। কোন সুস্থ- স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সেখানে খুব বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না। শুধু ডাক্তার বলেই হয়তোবা তাঁরা সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আছেন। স্যার- ম্যাডামরা, ভাইয়া-আপুরা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, যাকে বোধহয় বলে সাধ্যের সবটুকু। রোগী আসলেই নাম জিজ্ঞেস করে, প্রাথমিক পরীক্ষাটুকু করে, ব্যবস্থাপত্র লিখতে হয়। কয়েকজনকে নাম জিজ্ঞেস করি, ফ্যালফ্যাল করে এদিক- ওদিক তাকায়, কাঁদে। নাম বলতে পারে না। শুধু বলে, আমার এ কোথায়, আমার ও কোথায়? এ না হলে মানুষ? নিজে মরে যাচ্ছে, সেটা খেয়াল নেই; প্রিয়জন কোথায় আছে, সেটা আগে জানা দরকার। একসময় ইমারজেন্সি রুমে আর সঙ্কুলান হোল না; এবার চাদর বিছিয়ে নিচে শুইয়ে দেয়া হল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রোগী এসেই চলছে। সমস্ত ওয়ার্ডগুলো রোগীতে ভরপুর। ফ্লোরে শুইয়ে রাখতে হয়েছে। আর ওদিকে ক্রমশ বাড়ছিলো মৃতের সংখ্যা।

তখন রক্ত দরকার, প্রচুর, প্রচুর। একটা টেবিল আর টুল নিয়ে বাইরে বসা হয়েছে। যারা রক্ত দেবে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। লিখে কূল পাচ্ছি না। পাশে থাকা আরও দুই লোক আমার সাথে লিখতে থাকলেন। শত- শত মানুষ রক্ত দিতে চলে এসেছেন, শুধু সাভার থেকে নয়; বহু দূর- দুরান্ত থেকে। কার আগে কে দেবেন, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা। কে নেই রক্ত দেয়ার জন্য? কিশোর- কিশোরী, তরুণ- তরুনী, যুবক- যুবতী, বয়স্ক সকলেই। অনেক হয়ে গেছে। তখন আর রক্তের প্রয়োজন নেই। তবুও মানুষ বলছে, আমারটা নিন, আমারটা নিন, আমি রক্ত দেবো। মানবতা নাকি আর কারও মাঝে নেই এখন? গাজীপুরের এক মাদ্রাসা থেকে ৭০ জন ছাত্র সারিবদ্ধভাবে চলে এসেছেন রক্ত দেবেন বলে।

হাজার- হাজার মানুষ ভিড় করেছে হাসপাতালের সামনে। কেউবা রোগীর স্বজন, কেউবা উৎসুক জনতা। সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা যাতে নির্বিঘ্নে দেয়া যায়, তাই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না সাধারণ মানুষদের। কিন্তু জনতার আবেগকে কি আর দমিয়ে রাখা যায়? পুলিশ আসলো, আর্মি আসলো। আর হাসপাতালের গার্ডরা তো ছিলেনই, সাথে আরও কয়েকজন স্বপ্রণোদিত স্বেচ্চাসেবক। মানুষগুলো খুব কাকুতি- মিনতি করছিল ভেতরে ঢোকবার জন্য। শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, “I have to be cruel only to be kind.” সেটার বাস্তব প্রয়োগ দেখলাম আজ। কি বলবো আমি!! একজন হুট করে এসে পায়ে ধরে বসলেন, একটু যেন ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিই। অন্তরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার ছিল না। এরকম অনেকেই অশ্রুসজল চোখে অনেক অনেক অনুরোধ করেছেন। খুব খারাপ লাগছে।

আর ঐ মানুষগুলোর কথা কি বলবো আমি? বলে কি শেষ করা যাবে কখনও? যারা আহত, যারা নিহত, যারা তাদের স্বজন- প্রিয়জন তাদের কথা কি বলবো আমি? যে মা সন্তান হারিয়েছেন, যে সন্তান বাবা-মা হারিয়েছেন, যে স্বামী বধূ হারিয়েছেন; আমার কি ক্ষমতা আছে সেগুলো বলার মতো? আজকের দিনে ওখানে যারা উপস্থিত ছিল তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব না বিস্তারিত বর্ণনা করা। শুধু এতটুকু বলবো, টেলিভিশনের পর্দায় দেখা, আর অ্যাপ্রন গায়ে দেখা, দু’টোর মধ্যে অনেক অনেক তফাৎ।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিদেশ থেকে অনেকেই ফোন করে, ইনবক্স করে আর্থিক সহায়তা দিতে চেয়েছেন। স্রষ্টা যখন তাদের ভেতরে মানবিকতার চেতনা সুদৃঢ়ভাবে বসিয়ে দিয়েছেন, সেখানে আমি না করবার কে? যে কোন ধরণের সহায়তা বা পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে ইন শা আল্লাহ্‌। দু’আ অবশ্যই করবেন, পারলে দু’রাকাত নামায পড়ে ফেলতে পারেন। আমার বন্ধুরা এখনও কাজ করে যাচ্ছে, আমারও যেতে হবে। ধন্যবাদ।
৩১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

দোয়া ও ক্রিকেট

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৪


দোয়া যদি আমরাই করি
তোমরা তাইলে করবা কি?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচকের
দুইপায়েতে মাখাও ঘি।

খেলা হচ্ছে খেলার জায়গা
দোয়ায় যদি হইত কাম।
সৌদিআরব সব খেলাতে
জিতে দেখাইত তাদের নাম।

শাহাবুদ্দিন শুভ ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!!

লিখেছেন অন্তর্জাল পরিব্রাজক, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:২১



দয়া করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!! X( এরা ছাগলের দলই ছিল, তাই আছে, তাই থাকবে :-B !! এরা যেমন ধারার খেলা খেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেট্রোরেল পেয়েছি অথচ হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিজদের ভুলে গেছি

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১১

জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×