somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট/ অনুগল্পঃ এক টাকার ঋণ

১৮ ই নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইশ বছরের তন্বী তরুণীর পক্ষে বাড়ির বাইরের জগৎটা অবাধ বিচরণের পক্ষে অনুকুল না হোক, নিয়ন্ত্রিত বিচরণের পক্ষে সাংঘাতিক কিছু নয়। ভাবনাটা আমাদের অরিত্রির। একটা সরকারি কলেজ থেকে এবছরই গ্রাজুয়েশন করে এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে একটা চাকরি। পেয়েও যাবে মনে হচ্ছে কারণ পরপর বেশ কয়েকটা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সে ভাইভা দিয়ে রেখেছে।এদের মাঝ থেকে পজিটিভ রেজাল্ট কি একটাতেও আসবেনা? অরিত্রি আত্মবিশ্বাসী। সে জানে যে সে পারবে।

এই আত্মপ্রত্যয়ী তরুণীই হঠাৎ সেদিন জেনে-বুঝেও বোকা বনে গেল। মাত্র একটা টাকা ভাংতির অভাব তাকে বুঝিয়ে দিল জীবনের এক বড় বাস্তবতা, মূল্যবান দর্শন-- ঋণীব্যাক্তির কখনো ব্যাক্তিত্ব থাকেনা।

ঘটনাটা ফার্মগেটের। মতিঝিলে একটা বহুজাতীক কোম্পানীর অফিসে ভাইভা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মন নিয়েই বাসে চেপেছিল অরিত্রি। গন্তব্য মোহাম্মদপুর। ফার্মগেটে এসে সে সচেতন হয়ে দেখল যে বাসটা ভিন্ন পথে মোড় নিচ্ছে। বাস ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে সে কন্ডাকটরের দিকে পাঁচ টাকার কয়েনটা বাড়িয়ে দিয়ে ঝটপট নেমে পড়ল। এবার মোহাম্মদপুরের একটা বাস ধরার পালা।

ফার্মগেট থেকে বাসে ওঠা একাকী নারীর পক্ষে যে কত জটিল কাজের একটি তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা অসাধ্য। বাসে নির্ধারিত লেডিস সিট নয়টি এবং দেশে বাহিরবিহারী নারীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে ঐ নয়টি আসনের কোন একটি শুন্য পেতে হলে রাশিফল মেনে বাসে চড়তে হয় আরকি। ফার্মগেট থেকে সিটিংসার্ভিসগুলোতে ঠাঁই পাওয়ার আশা তাই নিতান্ত দুরাশা। আর যেগুলো ‘মুড়ির টিন’ সেগুলোর হেলপার অরিত্রির চেহারার কোন নারীকে কক্ষোনো গাড়িতে ঢুকতে দেবেনা। দেহাতি চেহারা হলে তারা অবশ্য তত আপত্তি করেনা কিন্ত মার্জিত রূপের সুবেশি নারীকে পাদানীতে ঝুলতে দিতে তারা মোটেই রাজি নয়। শিক্ষিত লোকের এমনিতেই ফ্যাকড়া অনেক-- আর নারী হলেতো কথাই নেই। এরা চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গাড়িতে উঠে সাথে সাথেই আসন দাবী করে বসে। এনাদের শরীরে কারো অনিচ্ছাকৃত স্পর্শও সয়না আবার ভীড়-ভীড়াক্কার বাসে দাঁড়িয়ে থাকার কৌশলটাও অনেকে জানেনা। সবমিলিয়ে এদেরকে কন্ডাকটর-হেলপাররা একরকম উৎপাত জ্ঞান করে এবং এধরণের যাত্রীদের এড়িয়েই তারা বাস চালিয়ে থাকে। এতে তাদের কিছুমাত্র লস্ও নেই কারণ ঢাকা শহরে যোগ্যযাত্রীর কোন অভাব নেই।

এসব বাসে যদি অরিত্রি শ্রেণীর কোন নারী কোনমতে ঢুকে পড়তে পারে এবং কোনমতে একটি শুন্য আসন পেয়ে যায় তবে সে মুখোমুখি হয় আরেক বিড়ম্বনার। সরকারি ভলভো ও মানসম্মত কোম্পানীর বাস ছাড়া সাধারণ সব বাসের নির্ধারিত আসনই হচ্ছে ইঞ্জিনকাভার ও তার সংলগ্ন একটা বেঞ্চি। ইঞ্জিনের অসহ্য গরমভোগের দায় থেকে বাসমালিকরা পুরুষদেরকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। ওটা বরং সর্বংসহা জাতির জন্য বরাদ্দ করে তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের নামটা কামানো হচ্ছে। অরিত্রির হাসি পায়-- ঠিকইতো, পরকালের দোজখে সংখ্যাগুরুর গৌরব যারা লাভ করবে বলে কথিত তারা ইহকালে একটু প্রাকটিস না করলে চলে কী করে!

যাহোক, অরিত্রি আজ কোনমতে একটা বাসে উঠে পড়ে। আসনপ্রাপ্তির আশা সে করেনা। বাসে পুরুষের ভীড়ে দাড়িয়ে থাকা স্বস্তির কাজ নয় কিন্ত পথ অল্প ভেবে সে মানিয়ে নেয়। কিন্ত কন্ডাকটর ভাড়া চাইলেই ঘটে যত বিপত্তি। অরিত্রি শেষ খুচরোটা এর আগের বাসটাতে দিয়েছে, এখন তার ব্যাগে কড়কড়ে কয়েকটা একশ টাকার নোট। দু’একটা কয়েন-টয়েন থাকার কথা কিন্ত ঢাউস সাইজ ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর চিরুণী-কাজল-লিপিস্টিকসহ নানা কাগজপত্র, টিস্যুপেপার প্রভৃতির ভীড়ে তা যে কোথায় আছে তা এই চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটাব্যাগ আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করা এক অসাধ্যকর্ম। অতএব, অরিত্রি হতাশ চোখে কন্ডাকটরের মুখের দিকে চেয়ে বলে, ভাড়া কত?
-- যাবেন কই?
-- মোহাম্মদপুর।
-- এই গাড়িতো মোহাম্মদপুর যাইবনা। এইডা মিরপুরের গাড়ি।
-- তাই নাকি? বুঝতে পারিনিতো। তাহলে আমি কোথায় নামব?
-- আসাদগেট নাইমেন।
-- সে পর্যন্ত ভাড়া কত?
-- এক টেকা।
কন্ডাকটর কর্কশস্বরে বলে।
-- একশ টাকা ভাঙতি আছে?
কন্ডাকটর কঠিন চোখে চেয়ে বলে, ভাঙতি দ্যান।

অরিত্রি এবার বিপদে পড়ে যায়। মাত্র একটাকার জন্য একশ টাকা ভাংতি এখন সে কোথায় পাবে? অরিত্রি মফস্বল শহরের মেয়ে। ঢাকার ছেলেমেয়েদের মত স্মার্টলি বলতে পারেনা যে মামা ছাইড়া দ্যান। অতএব একটা অস্বস্তিকর হীনম্মন্যতায় সে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে।

এ অবস্থায় কান্ডারী হয়ে যিনি অরিত্রিকে তরিয়ে দিলেন তিনি বয়সে প্রায় পৌঢ় একজন মানুষ। নিতান্ত চিমসা এলোবেলেদর্শন একজন ব্যাক্তি। অরিত্রি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশক একটা ইলাস্টিক হাসি হেসে বলে, আপনি কেন দিলেন?
-- সমস্যা কী? ও ব্যাটার পক্ষেতো একটাকার মায়া ছাড়া কঠিন।
-- কিন্ত আপনাকে আমি টাকাটা শোধ দেব কী করে? ঢাকাতেতো ভাঙতি পাওয়াও সহজ নয়।
-- সে দেখা যাবে।

অরিত্রির অস্বস্তিবোধ এখন আরো বাড়তে থাকে। এই অযাচিত দাতার ঋণ এখন সে কীভাবে শোধ করে? এই পথটুকু চুপচাপ কাটিয়ে আসাদগেটে পৌছাতে পারলে ওনাকে শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে টুপ করে বাস থেকে নেমে যাওয়া যেতে পারে কিন্ত তাতে নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হয়। মর জ্বালা! লোকের কাছে ছোট হওয়াটাই আজকে বুঝি কপালে লেখা ছিল। কিন্ত এছাড়া আর কীইবা করা যায়?

কিন্ত অরিত্রিকে ছোট হওয়ার সুযোগ লোকটা দিলনা। বাস থেকে অরিত্রি নামতেই সেও নামল তার পিছু পিছু। তারপর অরিত্রির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গল্প জমানোর চেষ্টা।

কোথায় গিয়েছিলেন? মতিঝিলে কেন? চাকরি করেন বুঝি? ওহ্, ইন্টারভিউ। কোন অফিসে? সরকারি চাকরির চেষ্টা করছেননা? বি সি এস এর ভাইভা দিবেন? বোর্ডের কেউ পরিচিত আছে? নেই? তাহলে চাকরি হবে কী করে? সমস্যা নেই, আমার সাথে যখন পরিচয় হল.....তাহমিদা ম্যাডাম আমার আপন খালার বান্ধবী। আমি কী করি? এইতো একটা কলেজে আছি, বাড্ডায়। আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখলে ভাইভার আগে আমি তাহমিদা ম্যাডামের সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। আপনার মোবাইল নাম্বারটা.....

আরে! সাবধানে রাস্তা পার হন। দাঁড়ান, দাঁড়ান, ঐ গাড়িটা আগে চলে যাক.....

চলুন কোথাও বসি। কিছু খান। খাবেননা? আহা, বড়ভাই ছোট বোনকে রিকোয়েস্ট করছে........ঠিক আছে, তাহলে চলুন আপনার রিক্সা ঠিক করে দেই। মোহাম্মদপুর কোন রোডে যাবেন? ওটা কি আপনার বাসা? ওহ্, বোনের। আপনি কোথায় থাকেন? খুলনা? আরে ওখানেতো আমার মামার বাড়ি! বানরগাতি চেনেন? ওখানে ছোটমামা বাড়ি করছে। আরে, আপনিতো আমার আত্মীয়!-- কিছু খাবেননা, তাকি হয়? বোনের বাচ্চা আছে? ছেলে না মেয়ে? ঠিকাছে দাঁড়ান, ওর জন্য একটা আইসক্রিম কিনে দেই। এবার আর না করতে পারবেননা।

অরিত্রি একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস মোচন করল। হে খোদা! এই একটাকার ঋণ কীভাবে সে শোধ করে!

৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×