somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ড. জাকির নায়েক-ভাবনা

১৫ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'মুক্তমনা' ব্লগে ড. জাকির নায়েকের বিবর্তনবাদের ওপর লেকচার-বিষয়ক একটা প্রবন্ধ পড়লাম। হাসতে হাসতে একদিকে যেমন বিষম খাওয়ার যোগাড়, আবার মনে কিছু হতাশাও জন্ম নিল। ঐ লেখায় নির্দিষ্ট লেকচারটা থেকে প্রায় ২৭-২৮ টি অসঙ্গতি/ভুল/মিথ্যাচার চিহ্নিত করা হয়েছে। আমার মতো বিজ্ঞান-বিষয়ে প্রায় মূর্খ লোকও খালি চোখে তার ৭-৮ টা খুঁজে পাবে। বিখ্যাত গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপ, যেখানে ডারউইন ফিঞ্চ পাখির সন্ধান পেয়েছিলেন তার কথা কে না জানে? কিন্তু নায়েক সাহেব এইটাও ঠিকমতো বলতে পারেন নাই। এর বদলে বলেছেন ক্যালোট্রপিস নামে একটা দ্বীপের কথা; বিশ্ব-মানচিত্রের কোথাও যার দেখা মেলে না। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, নায়েকের তথ্য অনুযায়ী চার্চ কর্তৃক গ্যালিলিও-কে নাকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল! এভাবে অনেকগুলো কমন নলেজ-বিষয়ক ভুল ঐ লেকচারের মধ্যে রয়েছে।

লেকচারটায় বহু অপ্রমাণিত সূত্র ধরে বিবর্তনবাদের তত্ত্বকে খণ্ডন করার অক্ষম চেষ্টা করা হয়েছে। বিবর্তনবাদের বিরোধিতায় যেসব বিজ্ঞানীর তত্ত্বকে সামনে হাজির করা হয়েছে তারা বহু আগেই বাতিল হয়ে গেছে। পিয়েরে পল গ্রাস মিসিং লিংক সম্পর্কে চল্লিশ বছর আগে কী বলেছিলেন তার রেফারেন্স হাজির করা হয়েছে এখানে! অথচ এরপর কতো কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে, বহু দিক থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা কতো বিস্তৃত হয়েছে নায়েক সাহেবের কাছে তার খবর নাই। এছাড়া কাল্পনিক ও উদ্দেশপ্রণোদিতভাবে বেশ কিছু বিজ্ঞানীর নাম আবিষ্কার করা হয়েছে, যাদের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নাই। কোনো কোনো নাম বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, দুর্বল সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক- সেগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু ফ্রান্সের এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা সেখানে বলা হয়েছে যে নামে আদপে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথাও পাওয়া যায় না! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ফ্র্যাংক স্যালিসব্যারি নামে একজন জীববিজ্ঞানীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ এই নামে কোনো বিজ্ঞানীর তথ্য পাওয়া যায় নাই; মাত্র একজনকে পাওয়া গেছে যিনি কিনা আবার বিজ্ঞানীর বদলে ছবি-আঁকিয়ে!! এরকম আরো অনেক ভণ্ডামিপূর্ণ বক্তব্যের পরিচয় মেলে ঐ লেকচারটিতে।

আমি ঐ লেখার গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য নিজে ইন্টারনেটে বেশ কিছু তথ্য ক্রসচেক করেছি। সেখান থেকে প্রবন্ধের তথ্যগুলোর সত্যতার বিষয়েও নিশ্চিত হয়েছি। আমার মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাই তার কলেজ-জীবনের এক বন্ধুর কথা বলেছিল। সে ছিল অসম্ভব রকমের চাপাবাজ। পরীক্ষার খাতায়ও নাকি সমানে চাপাবাজি করত, যেমন লিখত: সমাজতত্ত্ববিদ হিথ স্ট্রিক বলেছেন, ".............", রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভ মাস্টেইন বলেছেন, "..............." ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব করে সে পরীক্ষায় নাকি নম্বরও ভালো পেতো। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই, জাকির নায়েকের উত্তরসূরীরা এদেশে অনেক আগে থেকে তৈরি হয়েই ছিল। এদেশে যে তার নামে ভক্তি গদগদ-ভাবধরা লোকের অভাব হবে না সেটা বিস্মিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা না। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যে ভারতের মতো দেশ- যেখানে অনেক বড় বড় মেধাবী বিজ্ঞানী রয়েছেন, সেখানে জাকির নায়েকের ন্যায় ভণ্ড চাপাবাজ হালে পানি পায় কী করে! ঐসব বিজ্ঞানী করেন কি? তারা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি নেয়ার ধান্দায় ব্যস্ত? প্রচার মাধ্যমে এতোবড় সব মিথ্যাচার অহরহ প্রচারিত হয়ে চলেছে এর বিরুদ্ধে তারা কার্যকর ও দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন না কেন?

আমার কথা হলো: আপনি ইসলাম অথবা অন্য ধর্মের পক্ষে দাঁড়ান, অথবা নাস্তিক্যবাদের পথেই থাকুন না কেন তাতে অসুবিধা নাই, কিন্তু আপনার কাছ থেকে ন্যূনতম যুক্তিবোধ আর সততা আশা করে মানুষ। সেখানে নিজের বক্তব্য প্রচার করতে দাঁড়িয়ে এই রকম মিথ্যাচার আর ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়ার মাধ্যমে আপনি কি প্রকৃতপক্ষে আপনার আদর্শের পক্ষে অবস্থান নেন, নাকি তাকে খেলো আর অসার প্রমাণ করার পথকেই প্রশস্ত করেন? তবে নায়েক সাহেব আদতে ইসলামের কোনো স্যাভিয়র নন। আধুনিক যুগেও ধর্ম হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বিক্রয়যোগ্য পণ্য। এই পণ্যের লাভজনক ব্যবসায়ের লাইন নায়েকদের মতো ধান্দাবাজ মানুষ ছাড়বেন কেন! জাকির নায়েকের লেকচার শুনতে ভিড় করে আসা জনতার মধ্যে ঐ সমস্ত বক্তব্যের কোনো যৌক্তিক বিরোধিতা না থাকায় বোঝা যায় কী ধরনের লোকজন এসব গু-বিষ্ঠা লাভের জন্য সেখানে দলে দলে উপস্থিত হয়। আমাদের দেশের আটরশি, চরমোনাই, রাজারবাগী, দেওয়ানবাগী, সাইদাবাদী হুজুরদের মুরীদ এবং এসব মজমায় উপস্থিত হওয়া মস্তিষ্কবিহীন শ্রোতৃমণ্ডলির সাথে তাদের গুণগত কোনো পার্থক্য নাই।

আমাদের 'শিক্ষিত' মধ্য/উচ্চ-মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকগণ অফিস টাইমে টেবিলের নিচ থেকে সাধ্যমতো হাতিয়ে নিয়ে, ফাঁকে সুন্দরী কর্মচারীকে সময়-সুযোগ বুঝে দলাই-মর্দন করে, রাস্তায় গাড়িতে বসে পথচারিণীবৃন্দের পরিচ্ছদের ওপর দিয়ে বক্ষ-পৃষ্ঠ-উরু-নিতম্ব সহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি-কলকব্জার আকৃতি-প্রকৃতি ভালোমতো দর্শন করে-টরে বাড়ি ফিরে 'পাপ-পুণ্যে'র ব্যালেন্স করার খায়েশে টিভি খুলে জাকির নায়েকের লেকচার শুনতে বসেন। মধ্যপ্রাচ্যের পিস টিভি আর বাংলাদেশের ইসলামিক টেলিভিশনে সমস্ত দিন-রাতব্যাপী জাকির নায়েক, আহমেদ দিদাত, জামাল বাদাবি আর তাদের ক্যাটেগরির লোকজনের 'যুক্তিপূর্ণ' ইসলামী বয়ান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। এই 'পিছলামী' (পিস+ইসলামী) চ্যানেলগুলোর মালিক-পৃষ্ঠপোষক আমাদের দেশের ড. ইউনুসের মতোই অতিশয় ধূর্ত ব্যক্তি। তারা এক ঢিলে কয়েক পাখি মারছেন। সাধারণ ঘিলুবিহীন, দুর্নীতিবাজ, ভ্রষ্ট চরিত্রের ভদ্রলোকদের মগজ ধোলাই করে এক দিকে অবাধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে বহু মানুষের 'হেদায়েতপ্রাপ্তি' আর পাপক্ষালণের বন্দোবস্ত করে আখেরাতে অশেষ সওয়াব হাসিলের পথ খোলা রাখছেন!

এই সমস্ত ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। আমাদের দেশে অফিসে-আদালতে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে-পথেঘাটে-বেশ্যাপাড়ায়-শুঁড়িখানায় জাকির নায়েকের নামে মাতম তোলা লোকজনের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের এক শক্তিশালী অংশের মধ্যেও এর বিষময় প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। এসব মিথ্যাচার-অনাচার চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এদেশের মানুষের চিন্তাজগতের অস্বচ্ছ পরিবেশ আরো ঘোলাটে হবে, যৌক্তিক চিন্তার পথ রুদ্ধ হয়ে জাতীয় মুক্তির সম্ভাবনা আরো বহুদূর পিছিয়ে যাবে।


ছবি কৃতজ্ঞতা: http://mitucartoon.blogspot.com/

প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৩১
১৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×