somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ অথবা অমানুষের গল্প

১৪ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৃশ্যপট ১
শালা বেঈমান,বির বির করে বলে জয়নাল মিয়া।গত ৫ দিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে বিল্ডিংটা অনেকটা গেথে তুলেছে।আজ কিছু টাকা দেবার কথা ছিল মালিকের।কিন্তু সন্ধ্যার পরে আসতে বলেও শেষে এখন বলে দিল যা আজ হবে না।মাথা নিচু করে ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে চলতে থাকে জয়নাল।মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে।টাকাটা তার সত্যই খুব দরকার ছিল।ঘরে বউটার শরীরটা খারাপ।পেটে বাচ্চা।টাকার অভাবে এখনো কোন ডাক্তার দেখানো হয়নি।দেখাব দেখাব করে নয় নয়টি মাস পেরিয়ে গেছে।অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।ডাক্তার দেখান বিলাসীতা মনে হয়।তারপরও গত দু তিন দিন ধরে বউটার পেটটা নাকি ব্যথা করে,অস্থির লাগে।হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।ভাবতে থাকে জয়নাল মিয়া,কাল একমাত্র সম্বল ছাগলটা বিক্রি করে দিতে হবে।মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে গত দু দিন ধরে কেমন দুঃস্বপ্ন দেখছে সে।কারা যেন জোর করে তার বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে চাইছে,আর সে প্রানপনে চেষ্টা করছে বাধা দিতে।স্বপ্নটার আগামাথা কিছু বুঝতে পারে না সে।এক রাশ চিন্তার বোঝা নিয়ে বাড়ির কাছে পৌছুতেই কিছু মানুষের শোরগোল শুনতে পায় সে।কে যেন দৌড়ে এসে তাকে বলে,তোর বউ এর ব্যথা উঠে অচেতন হয়ে গেছে তারাতারি হাসপাতালে নিয়ে যা।আর কিছু মাথায় ঢোকেনা।তারাতারি প্রতিবেশীদের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি করে।আসার সময় এক সহৃদয় প্রতিবেশীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসতে পেরেছিল সে,যার ফলে প্রয়জনীয় অষুধপত্র কিনে দিয়ে এক রাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারী করছিল জয়নাল।বউটা বাচবে তো?আহারে,বউটার সাথে কত দিন ভাল করে কথাই বলা হয় না,দু দন্ড খোঁজ খবর করা হয় না।অভাবের সংসারে মন মেজাজ ভাল রাখবার সময় কই?বাড়ীতে নতুন অতিথি আসছে।বউটারে একটু ভাল মন্দ খাওয়াবার দরকার ছিল কিন্তু শালার নিষ্ঠুর দুনিয়া।নইলে সৎ ভাবে জীবন যাপন করেও সে এত গরীব কেন।এরকম নানা চিন্তা ভর করে তার মাথায় আর উৎকর্ন হয়ে থাকে নবজাতক সন্তানের তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকারের।এর মধ্যে তার মা,বোন সহ কিছু প্রতিবেশীও হাজির হয়েছে তাকে সঙ্গ দেবার জন্য।হটাৎ লেবার রুম এর দরজা খুলে যায়।সিস্টার কাপড়ে মোড়া পুটলির মত সদ্যজাত একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান এনে জয়নালের মায়ের হাতে তুলে দেয়।ঠিক যেন এক দেব শিশু।ভূল করে মর্তে চলে এসেছে।আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় জয়নাল।বিশ্বাসই হতে চায়না তার এই নাদুস নুদুস পরীর মত বাচ্চাটা তার।পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনেহয় নিজেকে।এমন সময় ছন্দপতন ঘটে।এক ডাক্তার এসে সাদা কাগজে কি যেন লেখা ধরিয়ে দিয়ে বলে বাচ্চার সমস্যা আছে।এখনি শিশু বিভাগে ভর্তি করে দিন।বিশ্বাসই হতে চায়না জয়নালের যে এতটুকু ফুটফুটে বাচ্চার কোন সমস্যা থাকতে পারে।দৌড় দিয়ে তারা শিশু ওয়ার্ডে নিয়ে যায়।ওখানকার ডাক্তাররা পরীক্ষা করে যা বলে তাতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।বাচ্চার নাকি দুই পা জন্মগতভাবে বাঁকা এবং শরীরের সব লম্বা হাড্ডিগুলো ভাঙ্গা,অবস্থাও ভাল না।তীব্র বিষাদে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।গরীবের এ কতবড় শাস্তি।

চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য।সে আর তার বউ বৃদ্ধ হয়ে গেছে।ন্যাংড়া মেয়েটা বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করে খায়।মেয়েটার বিয়ের কোন সম্ভাবনা নেই।আশেপাশের কিছু অমানুষ বুভুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।চোখে তাদের ফুটে থাকে আদিমতম লালসা।অসহায় এর মত তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করবার থাকে না জয়নালের।এই মেয়েটার জন্য বড় মেয়েটারও বিয়ে হল না।পাত্রপক্ষের ধারনা তাদের সন্তানও ন্যাংড়া হবে।বংশ বলে কথা।আর ভাবতে পারে না জয়নাল।সঙ্গে থাকা মা বোন ততক্ষনে আহাজারী শুরু করে দিয়েছে।নিজেকে সর্বহারার মত লাগে।একবার মনে হয় আল্লাহ মেয়েটাকে তুলে নাও।আবার মনে হয়,আহারে আমার বাবুটা।আমি ওকে বুক দিয়ে আগলে রাখব।কত কষ্টের ধন এটা।বাপ হয়ে কিভাবে মৃত্যু চাই ওর।ওর মার কাছে কিভাবে জবাব দিব?আহারে আহারে..মানুষ অথবা অমানুষের নত ভাবনার দোলাচলে দুলতে থাকে সে।

ওদিকে বাচ্চার মা এর চেতনা ফিরে আসে।খোঁজ করতে থাকে তার নাড়ীছেড়া ধনকে।তাকে জানানো হ্য় বাচ্চার একটু সমস্যার জন্য শিশু বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এখনি নিয়ে আসবে।তার আর তর সয়না।আদরের বাচ্চাটাকে জে কখন পাবো।বাচ্চাটার জন্য কি কি করবে তাই কল্পনা করতে থাকে সে।একটু পর কাঁদতে কাঁদতে তার শ্বাশুড়ী এসে জানায় বাচ্চার সমস্যার কথা।কিছুই মাথায় ঢোকেনা তার।মা বলে কথা।বারবার মনে হতে থাকে তবুও আমার বাবুটা বেঁচে থাক।যত বিকলাঙ্গই হোক আমি সব মেনে নেব।আমিওর দেখাশোনা করব,বুকে আগলে রাখব তবুও বেঁচে থাক আমার সোনাটা,বাবুটা,লক্ষী মেয়েটা।আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে রেখো।

প্রকৃতির উপরে কারও হাত নেই।সকল দোয়া আর চেষ্টা কে বৃথা করে দিয়ে এক দিন পরে বাচ্চাটা নিষ্করুন পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে পরপারে পাড়ি জমায়।হয়তবা বিধাতার কাছে আর্জি জানাতে কোন পাপের শাস্তি হিসেবে তাকে এই ক্ষণস্হায়ী আয়ু দিয়ে বিকলাঙ্গ করে পাঠান হল।

গভীর রাতে যখন আদিগন্ত বিস্তৃত পৃথিবী উথাল পাথাল চাদের আলোয় ভেসে যেতে থাকে,জয়নাল মিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়।সারা গা ঘামে ভিজে ওঠে।মনেপড়ে পঙ্গু মৃত মেয়েটার কথা।কষ্টে বুকটা ভরে যায়।মেয়েটা যেন তাকে বলে বাবা আমি মরে গিয়ে তোমাদের বাঁচিয়ে গেছি।গরীব ঘরে তোমাদের ঘাড়ে বোঝাহয়ে থাকি নি।বির বির করে সে মাফ চায় এরকম চিন্তা করবার জন্য।চোখ ফেটে পানি আসে।আহারে আমার অচল বাবুটা অন্ধকার রাজ্যে একা একা কি করছে?পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে হাত বাড়ায়।অবাক হয়ে দেখে তার স্ত্রীর চোখে পানি।নিরবে দুইজন দুইজনের হাত ধরে রাখে।এক সময় স্ত্রী গভীর বিষাদমাখা কন্ঠে বলে,আমার বাবু সোনাটা একা একা না জানি কত কষ্টে আছে।আচ্ছা ও খুব বেশি কষ্ট পেয়ে মরে নি তো?জয়নাল কোন উত্তর দেয় না।নির্বাক হয়ে বসে থাকে।সময় বয়ে চলে।প্রকৃতির কিছুতেই কিছু যায় আসে না।

দৃশ্যপট ২

কিছু দিন আগে আমার শিশু ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট ছিল।সকাল ১০টার দিকে লেবার ওয়ার্ড থেকে একটি সদ্য ডেলিভারী হওয়া বাচ্চা আসল।রিসিভ করবার পর দেখি চমৎকার চেহারার একটি ফুটফুটে বাচ্চা,কিন্তু সে জন্মগত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত।চিকিৎসা বিঙ্গানের ভাষায় অস্টিওজেনেসিস ইমপারফেক্টা রোগে আক্রান্ত।বাচ্চা মেয়েটির বাবা ছিল একজন রাজমিস্ত্রী।এক দিন পরে বাচ্চাটা মারা যায়।বাচ্চাটার লোকজন খুব স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুটা নিয়েছিল এবং মনে হয়েছিল তারা এক প্রকার বেঁচে গিয়েছিল।কারন গরীবঘরে সুস্থ্যসবল বাচ্চাই ভালভাবে থাকতে পারে না,সেখানে চিরপঙ্গু তাও আবার মেয়ে।তার চেয়ে বোঝা নেমে গেছে।এটাই বা কম কিসে।যদিও চিন্তাটা অমানুষের মত।কিন্তু এ ছাড়া বিকল্প কি।এমনটাই তাদের অনুভূতি।এই লেখাটা উৎসর্গ সেই সব মহৎপ্রান বাবা মা দের,যারা শত সহস্র বাধা বিপত্তি ও দুঃখ কষ্টের মাঝেও বিকলাঙ্গ সন্তানদের পরম মমতায় লালন পালন করে যাচ্ছেন।নিশ্চয় তারা একদিন অনেক বড় প্রতিদান পাবেন।ভালথাক সেইসব বাবা মা রা।তাদের জন্যই পৃথিবীটা আজও সুন্দর।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ২:৪৪
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×