somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে এই মাওলানা !! শেষ পর্ব

০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কলকাতা আলিয়া মাদরাসা উত্তাল হয়ে আছে।
মাদরাসার ইংরেজ প্রিন্সিপাল ইসলামের মহানবীর সম্ভ্রমে আঘাত হেনেছেন। তিনি প্রিয়নবীকে নিয়ে মশকরা করেছেন।
প্রিন্সিপালের এমন বেয়াদবী কান্ডে ছাত্ররা ক্ষেপে আছে। কেউ সরবে প্রতিবাদ করছে, কেউ নীরবে এক বুক ঘৃণা নিয়ে বসে আছে।

বাংলা অঞ্চলের একটি ছেলে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। সে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ইংরেজ প্রিন্সিপালের মুখের উপর কিছু গরম গরম কথা শুনিয়ে সে বের হয়ে এসেছে। এমন শিক্ষালয়ে সে আর পড়বে না। অন্য ছাত্র আর শিক্ষকরা এর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে তারা সাব্বাশ বেটা বললেও মুখে মুখে চুপ করে আছে।
সাহস তো আর সবার কপালে জোটে না।

এ তরুণের নাম আকরাম খাঁ।
বাংলাভাষা ও সাহিত্য এবং সংবাদপত্রের ইতিহাসে তার নাম মাওলানা আকরাম খাঁ।
তার প্রকাশিত দৈনিক আজাদ তৎকালে গোটা বাংলায় মশহুর ছিল। পাঠকপ্রিয়তায় এর অবস্থান অনেক উঁচুতে ছিল।

আকরাম খাঁর বয়স ষাটের উপর। তিনি বুড়িয়ে যাচ্ছেন। তবুও নিয়মিত আজাদ পত্রিকার অফিসে আসেন। সংবাদ ও প্রকাশনা দেখাশোনা করেন। তার সাথে প্রায়ই গল্প করতে আসেন মাওলানা। আকরাম খাঁ এ মাওলানাকে কথায় কথায় ভাতিজা ডাকেন। তার কথাবার্তায় আনন্দ ভোগ করেন।
প্রায়ই অনেক তরুণ আজাদ পত্রিকার অফিসে এসে হাযির হয়। আজও এসেছে এক তরুণ।
- সম্পাদক সাহেব! আসতে পারি?
- হুমম, আসো।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়া আলাইকুম।
- আমি একটা লেখা নিয়ে এসেছি, আপনার পত্রিকার জন্য। একটু যদি দেখতেন। তরুণটির গলা শুকিয়ে আসছে।
- আগে কোথাও লেখা ছাপা হয়েছে??
- ...জ্বী না, তেমন না। মানে.. এই প্রথম..
- তোমার তো অনেক সাহস দেখা যায়। কোথাও লেখা ছাপা হয়নি এখনও, আর তুমি সোজা চলে এসেছো আমার কাছে? যাও, আরও লেখার অভ্যাস করতো থাকে। আর ভাল লেখা দরকার। এখন যাও।
- কিন্তু সম্পাদক সাহেব!!
- আবার কী? বললাম তো যাও। আরে বাবা, পরে এসো আবার।
- আমাকে মাওলানা পাঠিয়েছেন।
আকরাম খাঁ মাথা উঁচু করলেন। এই প্রথম চোখ তুলে ভাল করে আগন্তুকের দিকে তাকালেন। তাকে তো চেনা চেনা মনে হচ্ছে না।

- মাওলানা তোমাকে চিনেন কিভাবে? তিনি যে আমার ভাতিজা, এইটা জানো তুমি?
- জ্বী, আমি তার কাছে পড়েছিলাম। তখন শুনেছিলাম। তখন থেকেই টুকটাক লেখার শখ জেগেছিল। কিন্তু কালকে এই লেখাটা নিয়ে যখন তাকে দেখাতে গেলাম, মাওলানা বড়ই খুশি হয়েছেন। তিনিই বললেন আপনার কাছে আসতে। মাওলানা আমার লেখার উপর নোট লিখে দিয়েছেন আপনার জন্য।
ও আচ্ছা! লেখাটা বের করো, দেখি!

এতক্ষণে বেচারা আগন্তুক সুযোগ পেল মুখবন্ধ খাম খুলে ভাজ করা লেখাটি বের করতে। সে দ্রুত তা বের করে সম্পাদক সাহেবের হাতে দিল।
আকরাম খাঁ চশমা একটু উঁচিয়ে নিলেন। গড়াতে গড়াতে তা এতক্ষণ নাকের ডগায় চলে এসেছিল।
- হুমমম, মাওলানারই তো লেখা। তিনি তো ইংরেজীতেই লিখেন আমার কাছে। ঠিক আছে, যাও, রেখে যাও। কাল পরশু খোঁজ রেখো, ছাপা হয়ে যাবে। মাওলানাকে আমার সালাম দিও।
আকরাম খাঁর হাতে ধরা তরুণ লেখকের লেখার উপরে বামদিকের কোণায় ইংরেজিতে একটি বাক্য লেখা। এর অর্থ- চাচা, এ তরুণ উদীয়মান লেখকের লেখাটি ছেপে তাকে উৎসাহিত করলে খুশী হব। -আপনার ভাতিজা শামসুল হক।
..............................................
শেষ জীবনে এসে মানুষ পূণ্যসঞ্চয়ে মনোযোগী হয়। বুড়া মানুষগুলো তখন নামায কালামে মগ্ন হয়। আল্লাহ আল্লাহ করে দিন কাটায়। আযরাইল এসে যেন তাকে ফাও কাজে না দেখে, এ নিয়ে সারাক্ষণ আতংকে থাকেন বয়স্ক মানুষগুলো। শিক্ষিত বুড়ারা এ সময় নবী রাসূলের কাহিনী পড়েন। জানা গল্পগুলো নতুন করে পড়েন। হাতে তসবীহ, বিছানো জায়নামাজ। এক কোণে কাঠের রেহালে পবিত্র কুরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ। নকশী করা সাদা রুমাল দিয়ে তা ঢেকে রেখেছেন সযতেœ।

গভীর মগ্ন হয়ে তাফসীর লিখছেন মাওলানা আকরাম খাঁ। শেষ বয়সে এসে কুরআন শরীফের তাফসীর লেখা শুরু করেছেন। এর নাম দিয়েছেন তাফসীরুল কুরআন। জীবন শেষ হতে হয়তো বেশিদিন বাকী নেই। তাই তড়িঘড়ি করে লিখছেন তিনি।

এ তাফসীর লেখায় তিনি অনুসরণ করলেন স্যার সৈয়দ আহমদকে। স্যারের মতো বেচারা আকরাম খাঁও ভুল করে বসলেন।
কুরআনে বর্ণিত রাসূলগণের মুজিযাসমূহকে তিনি সাধারণ ঘটনা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করলেন। ঠিক যেমনটি করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ।
.............................................

মাওলানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি সমাজ সচেতন।
আজ কিংবা কাল, কোথায় কি হচ্ছে, তিনি নিখুঁতভাবে তার খবর রাখেন। তার কাছে আসা যাওয়া করেন সমাজের সর্বস্তরের সুধীজন। তাদের কাছ থেকেও খবর পান। সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক- যে কোন অঙ্গনে কোথায় কি ঘটছে, তা তিনি গভীরভাবে খোঁজ নিচ্ছেন।

মাওলানা তার আলো-আধাঁরঘেরা কামরায় বসে আছেন। এ সময়টায় তিনি নিজের পড়াশোনা করেন। তার হাতে নতুন তাফসীরুল কুরআন। লেখক- মাওলানা আকরাম খাঁ।
তিনি উবু হয়ে পাতা ওল্টাচ্ছেন। তার কপালে আবারও ভাজ জমছে। এসব কি পড়ছেন তিনি? কি লিখেছেন তার চাচা মাওলানা আকরাম খাঁ?
বিভিন্ন সুপ্রসিদ্ধ ও প্রমাণিত সত্যকে তিনি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি একে একে এর পড়া শেষ করলেন।
..........................................
তারপর কয়েকদিন মাওলানা খুব ব্যস্ত। দিনরাত তিনি লিখছেন। শিষ্য শাগরেদরা আসছেন, তারা মাওলানার ব্যস্ততা দেখে চুপ হয়ে আছেন।
মাওলানা কয়েকদিনের মধ্যেই লিখে ফেললেন।
লেখা শেষ হল। পুস্তিকাটির নাম- ‘তাফসীরের নামে সত্যের অপলাপ’।
বাজারে তা প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মানুষের হাতে। মাওলানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
.....................................................
দৈনিক আজাদের অফিসে মুখ ভার করে বসে আছেন মাওলানা আকরাম খাঁ। এক তরুণ এসে ঢুকলো এক বিকেলে।
- আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনি?
- এইতো আছি। বসো।
- জনাবের অসুখ নাকি? মুখ ভার দেখাচ্ছে যে?
- আর কি বলবো বলো? ধূর অসুখ না। কিন্তু আমার ভাতিজা মাওলানার কান্ড দেখছো?
- না তো? কি করেছেন তিনি?
- আমার তাফসীরের ভুলভ্রান্তি নিয়ে মাওলানা বই লিখে ফেলেছে। কাজের কাজ করেছে। ঠিক আছে। কিন্তু বইটির প্রথমদিকের কয়েক লাইন পড়ে দেখো..মাওলানা লিখেছেন, ‘আকরাম খাঁ নামে জনৈক এক ব্যক্তি..আচ্ছা, মাওলানা কি আমাকে চেনেন না? এই অফিসে বসে চাচা ভাতিজা কত গল্প করি, আর তিনি আমাকে এক ব্যক্তি লিখেছেন..
- জনাব, আপনি শান্ত হোন। আপনি তো আপনার ভাতিজা মাওলানাকে চিনেন। তার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। এটাও জানেন। আপনার সামনে তিনি চাচাজ্বী বলে যে সম্মান দেখান, তা একান্ত তার ভদ্রতা ও বিনয়। আর বইটিতে তিনি যা লিখেছেন, তা তার দ্বীনী আত্মসম্মানবোধের বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তিগত পরিচয় আর সুসম্পর্কের খাতিরে তিনি নিজের দ্বীনী সম্মানবোধ বিসর্জন দিতে পারেন না। এটাই তার স্বভাব। এ নিয়ে অন্য কিছু ভাববেন না। আপনার শরীর স্বাস্থ্য কেমন?
- কি বলছ তুমি? তুমিও কি এ তাফসীরের বিরুদ্ধে নাকি? তুমিও ভাতিজার মতো কথা বলছো দেখি।
- জনাব, আপনাকে সম্মান করি, আপনি আমার গুরুজন। আপনাকে ভালবাসি। তাই বলছি, শুধু মাওলানা কিংবা আমি না, দেশের আলেমরা আপনার উপর ক্ষেপে আছেন।
আকরাম খাঁ গম্ভীর হয়ে গেলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আর কথা বলতে চাচ্ছেন না।
- তো বসো তুমি। চা খেয়ে যাও। এই তোরা কে আছিস? চা দিতে বল।

মাওলানার একনিষ্ঠ এখলাস, মুসলিম উম্মাহ এবং স্বদেশের জন্য মাওলানার ভালোবাসার কথা আকরাম খাঁ জানতেন। তিনি অন্যদের সাথে মাওলানার কর্মকান্ড নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। কখনো কখনো তিনি তার এ ভাতিজাকে ‘এখলাসের পুতুল’ বলে ডাকতেন।
....................................................

মাওলানা রাতের খাবার খেতে বসেছেন। সাদা ভাতের সাথে সামান্য ডাল আর তরকারী নিয়ে রাতের আহার। ছোট্ট পিরিচে লবণ দেয়া আছে। মাওলানা হাত ধুয়ে খেতে বসেছেন। এমন সময় মাদরাসার একজন শিক্ষক এসে হাজির।

কী ব্যাপার!! তুমি এ সময়ে?
হুজুর ! সামান্য ব্যাপার। মাদরাসার ক্ষেতে ছাত্র শিক্ষক- আমরা সবাই মিলে কিছু মূলা চাষ করেছিলাম। মাশাল্লাহ! ফসল ভালো হয়েছে। ছাত্র শিক্ষকের জন্য এ ফসল বরাদ্দ। সেখান থেকে আপনার জন্য একটি তাজা মূলা নিয়ে এলাম। একদম কচি। খেয়ে দেখেন, ভালো লাগবে।
হু, তা এই মূলার দাম কত?
তওবা তওবা!! আপনে দামের কথা বলছেন কেন? মাদরাসার জায়গা যমীন তো আপনাদেরই দেওয়া। আর এ ফসল আমাদের হাতে চাষ করা। আপনার জন্য কি একটি মূলা আমরা আনতে পারি না?
হু, কিন্তু দাম না ধরা পর্যন্ত আমি তো এই মূলা খাব না। এ মূলা মাদরাসার। আপনাদের সবার সম্পদ।

মূলা নিয়ে আসা লোকটির মুখ লজ্জায় ছোট হয়ে আসছে। আরও কিছু মূলা মিলিয়ে তিনি সামান্য কয়েক আনা দাম ধরলেন। মাওলানা উঠে গিয়ে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে আনা বের করলেন।
হুম, এবার দাও। দেখি, মূলা কেমন হয়েছে? বসো, তুমিও খেয়ে যাও।
না হুজুর! আমি যাই। আরেকদিন। ইনশাল্লাহ।

লোকটি ফিরে আসছে। চারিদিকে যখন অন্যের সম্পদ নিয়ে লুটোপুটি খেলছে মানুষ, এমন দিনেও মাওলানার মতো লোক দুনিয়ায় আছেন। বড়ই তাজ্জবের ব্যাপার।
............................

মাদরাসার বার্ষিক সভা হবে। অতিথিরা আসবেন। মাদরাসা এবং গ্রামজুড়ে উৎসবের আবহ। লোকজন ঘরদোড় পরিস্কার করছে। বার্ষিক মাহফিলের সময় আত্মীয় স্বজনরাও বেড়াতে আসেন। দিন কয়েক থেকে ওয়াজ শুনেন। বড়ই আনন্দময় সময়।
মাদরাসার ছাত্ররা মহাব্যস্ত। মাদরাসার মাঠ পরিস্কার করা হচ্ছে। গাছের শুকনো পাতা ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। ঘরের কোণায় মাকড়সার জাল ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। মাঠের আগাছা ও পুরনো লাউগাছের পাতাগুলো টুকরী ভরে ভরে ময়লার গর্তে ফেলা হচ্ছে।

মাস্টার ওমর ফারুক। মাদরাসার একজন স্টাফ। দুপুরের পর ময়লার গর্ত থেকে লাউয়ের মরা পাতাগুলো একত্র করে মাওলানার বাড়ীতে গেলেন। বাড়ীর পেছনে গোয়ালঘর।

মাওলানার কয়েকটি গরু গাভী আছে। দুধ তার বড়ই পছন্দসই পানীয়। লাউয়ের পাতাগুলো তিনি গোয়ালঘরের কোণায় ফেলে দিয়ে আসলেন। গরুগুলোর আজকের আহার হিসেবে যথেষ্ট।

আসরের নামাজের পর মাওলানা হাটাহাটি করছেন। গোয়ালঘরে গিয়ে গরুগুলোকে দেখে আসা দরকার। নিরীহ প্রাণিগুলোর দায় দায়িত্ব সম্পর্কেও আল্লাহ পাক জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

গোয়ালঘরের ভেতর লাউয়ের জীর্ণ পাতাগুলো দেখে মাওলানা এদিক ওদিক তাকালেন। কই, আশেপাশে তো লাউগাছ নেই। তো এই পাতা এল কোত্থেকে?
খবর পেয়ে মাস্টার ওমর এসে হাযির।
- এই পাতা কি তুমি এনেছো?
- জ্বী হুজুর! ছাত্ররা এসব ময়লার গর্তে ফেলে দিয়েছিল। আমি উঠিয়ে এনেছি। গরুর ঘরে আমিই রেখেছি।
- হু, ভাল করেছ। মাশাল্লাহ! কাজের কাজ হয়েছে। মাদরাসার ম্যানেজারকে ডাকো।
- কেন হুজুর!
- এই লাউপাতাগুলোর একটা দাম ধরা দরকার। মাদরাসার পাতা আমার গরু মাগনা খাবে নাকি?
- ইয়া মাবুদ! হুজুর!! এগুলো তো ফেলে দেওয়া পাতা। ময়লার গর্তের পাতা।
- আরে মিয়া! এই পাতাগুলো মাদরাসার ময়লার গর্তে পঁচলেও তো একটু মাটি হইতো, তাই না? ঐটুকু মাটিতেও মাদরাসার উপকার হইত। আমার গরুকে দিলে তো আর এটুকু উপকার মাদরাসার হল না। তাই দাম দিয়ে দিব। তুমি যাও, ম্যানেজারকে আসতে বল।

মাস্টার সাহেব হয়রান। তিনি দ্রুত হাঁটছেন। মাওলানাকে চেনা আছে তার। দাম না ধরা পর্যন্ত তিনি গরুকে মুখ দিতে দিবেন না।
ম্যানেজার এসে দাম ধরতে বাধ্য হল। দাম ধরা হল চার আনা। তিনি পকেট থেকে বের করে দিলেন। ম্যানেজার নীচের দিকে তাকিয়ে তা হাতে নিল। মাওলানার মুখে হাসি। নিজের দায়িত্ব আর হক আদায় করে তিনি এমন নির্মল হাসি হাসেন।

- মাস্টার মিয়া! দাড়ায়ে আছ কেন? যাও, পাতাগুলো গরুর মুখের কাছে দিয়ে আসো। দেখো, খায় কিনা?
মাওলানা বাড়ীর ভেতরে ঢুকে গেলেন।
....................................................................

আজ মঙ্গলবার।
১৯৬৯ সাল। ২১ জানুয়ারী।
১৩৭৫ সন। ৭ ই মাঘ।

গত কয়েকদিন ধরে মাওলানার শরীরে অসুস্থতা বোধ হচ্ছে। পেটে ব্যাথা এবং এর সাথে শ্বাস ক্রমাগত ঘন হয়ে আসছে।
মাওলানা চেষ্টা করছেন স্থির থাকতে। হাউমাউ কিংবা হৈ রৈ তার অপছন্দ। ফজরের নামায শেষ হয়েছে। মাওলানা নামায আদায় করে বারান্দায় চৌকিতে শুয়ে আছেন। তার পাশে ছেলে ওমর এবং রুহুল আমীন। বয়সে তখনও তারা কিশোর।
সকালের স্নিগ্ধ আলো মাওলানার ভাল লাগছে। তারপাশে কয়েকজন শিষ্য ও স্থানীয় লোকজন বসে আছেন। সবাই নীরব নিশ্চল। মাওলানা এ সময়টা যিকিরে যিকিরে কাটিয়ে দেন। ছেলে ওমর তাকে ওযু করিয়ে দিচ্ছে।

মাওলানা খবর পেলেন, মাদরাসায় তার জন্য খতম পড়া হচ্ছে। ছাত্র শিক্ষকরা তার জন্য দু হাত তুলে আকুল হয়ে কাঁদছে। তিনি বাড়ীর ভেতরে খবর পাঠালেন। মাদরাসার ছাত্রদের জন্য পায়েস রান্না বসাও। তারা আমার জন্য খতম পাঠে ব্যস্ত। তাদেরকে মেহমানদারির আয়োজন কর।

বেলা শুরু হয়েছে। মাওলানার পেটে ব্যাথ্যা খানিক বেড়েছে। গরম সেঁক দেয়া হচ্ছে। তাতে সামান্য আরামবোধ অনুভব করছেন তিনি।
গ্রামের মুরব্বীরা আসছেন। মাওলানার কাছে বসে তারা দ্বীন দুনিয়ার গল্প শোনেন। আজ মাওলানা অসুস্থ। তারা আগেভাগেই চলে আসছেন।
ডাক্তার আব্দুল ওয়াদুদ এসেছেন। পাটগাতি বাজারের নামকরা চিকিৎসক তিনি। মাওলানা নিয়মিত তার কাছ থেকে ওষুধপত্র খেতেন।
তিনি এসে মাওলানার নাড়িনক্ষত্র পরীক্ষা করলেন। কয়েকটি ট্যাবলেট দিলেন। মাওলানা নিজেই তা খেলেন।

বেলা সাড়ে বারটা। মাওলানা তখনও শুয়ে আছেন।
বাড়ীর উঠানে মাদরাসার ছাত্র এবং গ্রামবাসী জড়ো হয়ে আছেন। তাদের মনে শংকা, চেহারায় বিষাদের কালোছায়া। কি হল হুজুরের!!

মাওলানা তার বড়ছেলে ওমরকে কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার চেষ্টা করছেন তিনি। ওমরের চোখের কোণায় চিকচিক করছে পানি।
- কাঁদবে না বাবা। শোনো, তোমার মা আমার যে সেবা করেছেন জীবনভর, এ পৃথিবীতে এর কোন তুলনা নেই। হতে পারে না। তুমি যতদিন বেঁচে আছো, মায়ের খেদমত করবে। মনে প্রাণে। এটা আমার ওসিয়ত রইলো তোমার কাছে। আর শোনো, তুমি হাফেজ হয়েছো। আলহামদুল্লিাহ। এখন খাঁিট আলেম হবে। তোমার ছোট ভাইটিকে হাফেজ আলেম বানাবে।

মাওলানার ভেতর কেমন যেন অনুভব হচ্ছে। কি এক অদৃশ্য ডাক যেন তাকে ডাকছে। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কে যেন তাকে বলছে, এবার বিশ্রামের পালা।

তিনি মাথা কাত করে বাড়ীর উঠানে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর দিকে তাকালেন। মুরব্বীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবসময় এক আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখবেন আপনারা। যেটুকু সম্ভব, এখলাসের সাথে আল্লাহর দ্বীনের খেদমত করে যাবেন। আপনাদের জন্য এটাই আমার ওসিয়ত।

যোহর নামাযের সময় হয়েছে। মাওলানা সবাইকে নামায পড়ার তাগিদ দিলেন। বাড়ীর ভেতর খবর পাঠালেন, নাামযের সময় হয়েছে। সবাই যেন নামাজে দাঁড়ায়। তিনি নিজেও শুয়ে নামাজের নিয়ত বাঁধলেন।

নামায পড়ে সবাই আবার মাওলানার আশেপাশে। তিনি নিজের চেহারা ডানদিকে কাত করে শুয়ে আছেন। বাড়ীর পরিবেশ নিরব নিস্তব্ধ। কেউ কেউ সামান্য উচ্চশব্দে যিকির করছেন। মাওলানা প্রশান্ত স্থির চোখে কি যেন দেখছেন গভীর মনোযোগে। তিনি অনবরত দুআ পড়ছেন, আমাকে মাফ করো হে মাবুদ, প্রিয়তম বন্ধুর সান্নিধ্য পেতে আমি বড়ই ব্যাকুল। আল্লাহুম্মাগ ফিরলী ওয়ারহামনী, ও আলহিকনী বির রাফিকীল আলা। প্রিয়তম নবী তার মৃত্যুর পূর্বক্ষণে এ দুআ পড়েছেন। মাওলানা অবিরাম তা উচ্চারণ করছেন।

ও আলহিকনী বিররাফিকীল আলা’’..একটু জোরেই যেন মাওলানা শেষবারের মত উচ্চারণ করলেন। সবার চোখ মাওলানার চেহারায় স্থির। মূহুর্তেই তার চোখ বুঁজে গেল। এক অপার্থিব আলো আর স্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল তার মুখাবয়বে। তিনি পৌঁছে গেলেন তার পরম করুণাময়ের ছায়াতলে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা দুটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

ততক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সবাই। বাবার শরীর জড়িয়ে কাঁদছে মাওলানার সন্তান। ঘরের ভেতর কান্নার রোল। নিঃশব্দে উঠান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে মানুষজন। ঘরের মহিলারা শেষবারের মত দেখে নিতে চান তাদের প্রিয় মানুষটিকে।

চারিদিকে মধ্য দুপুরের আলো। শীতের সূর্যকিরণ সবাইকে আলো ছড়াচ্ছে। সূর্যাস্ত হতে তখনও অনেক বাকী। তার আগেই ডুবে গেল মাওলানার জীবনসূর্য। যে সূর্যের আলোয় অসত্যের পোকামাকড় গর্তের ভেতর পালিয়ে থাকত। আজ নিভে গেল সত্য ও ন্যায়ের এ জীবনপ্রদীপ।

পর্ব- ০৯
পর্ব-০৮
পর্ব- ০৭
পর্ব- ০৬
পর্ব- ০৫
পর্ব - ০৪
পর্ব- ০৩
পর্ব- ০২
প্রথম পর্ব


পর্বগুলো পড়ার জন্য সবাইকে আমার সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ। খুব শিগগির্ই বই আকারে প্রকাশিত হবে আমার এ পর্বগুলো। কিছু সংশোধান এবং সংযোজন তাতে থাকবে। এ ঘটনাগুলোর কাগুজে সূত্র তো আছেই, এর জীবন্ত সাক্ষীরা এখনও বেঁচে আছেন।




২৯টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠিক কোন বিষয়টা মৌলবাদী পুরুষরা শান্তি মত মানতে পারে???"

লিখেছেন লেখার খাতা, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৭


ছবি - গুগল।


ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, রোজগার এর একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্মও। একটু স্মার্ট এবং ব্রেন থাকলে ফেসবুক/ইনস্টাগ্রাম থেকে রোজগার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×