somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিমূর্ত আর বিষন্নতায়

০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উপসাগরের তীর ঘেষে টানা বালিয়াড়িটা চলে গেছে দুরে জেলেদের গ্রাম পেরিয়ে দুরে আরো দুরে, তারই উপর বসে আছে মেয়েটি ।পরনে তার ছাই রংগা প্যান্ট আর লাল রংয়ের গলা বন্ধ সোয়েটার । পা জোড়া দু হাতে পেঁচিয়ে ভাজ করে বুকের সাথে ঠেকানো ।
একটু দুরেই পাইন আর কচি কচি আ্যলডার ঝোপের সারি। দু একটা লাইলাক ফুল আর কিছু রোগাটে বার্চের ঝাড়ও রয়েছে ওপাশে।
উড়ন্ত গাংচিলগুলো মাঝে মাঝে ছোঁ দিয়ে ঠোটে করে মাছ তুলে নিচ্ছে।

সাগর থেকে হু হু করে ভেসে আসছে ঠান্ডা ঠান্ডা নোনা বাতাস।যার ঝাপটায় এক সময়ের সোনালী চুল যা এখন রুপোলী রং ধরেছে এদিক ওদিক উড়িয়ে নিয়ে চলছে অবিরত। কিন্ত কোনদিকেই মন নেই আনাস্তাশিয়ার।সমুদ্রের নীল ঢেউগুলো যে সফেদ ফেনার মুকুট পড়ে আছড়ে পড়ছে বেলাভুমিতে তাও নজরে আসছেনা তার।সবকিছু ছাড়িয়ে সুদুর দিগন্তে অবিচল চেয়ে আছে, কিছু একটা খুজে বেড়াচ্ছে আঁতিপাঁতি করে। সুক্ষ চিকন একফালি সুতোর মতন, ধরতে গিয়েও হারিয়ে যাচ্ছে বারবার।

দিন কয়েক হলো বালিয়াড়িটার পেছনেই এক গ্রীষ্মাবাসে এসে উঠেছে সে।বেশ কিছুদিন ধরে আকুল হয়েছিল সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে একটু নির্জনতার জন্য।এমন একটি জায়গা যেখানে বসে সে চুপি চুপি মিলাতে পারবে তার জীবনের হিসাব নিকাশ।
বান্ধবী লিদিয়া তাকে খোজ না জানালে তার চেনার কথা নয় মস্কো থেকে এত হাজার মাইল দুর এই সমুদ্রতীরটিকে। শীত আসি আসি করছে ,প্রায় সবাই চলে গেছে গ্রিষ্মাবাস থেকে , শুধু সে আছে একা স্থানীয় এক মেয়েকে সাথে নিয়ে।

মনে পড়ছে সেই কবেকার কথা, বয়স তখন ছয় কি সাত। স্কুলের ক্লাশে বসে লিখছিল মনযোগ দিয়ে , কি লিখছিল মনে নেই। এমন সময় টিচার এসে তাকে নিয়ে গেল অফিস রুমে।সেখানে দেখলো তার খালু বসে আছে প্রিন্সিপালের সামনে বিষন্ন মুখে। খালু তাকে নিয়ে হাজির হলো এক হাসপাতালে। সেখানে খালামনি বসা চোখে রুমাল চেপে আছে। কি হয়েছে জানতে চাওয়ার আগেই নার্স এসে খবর দিল, অনেক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্ত দুজনের কাউকে বাচানো যায়নি ।

এভাবেই গাড়ী দুর্ঘটনায় ছোট্ট নাস্তাশিয়ার জীবন থেকে জীবনের মত হারিয়ে গেল তার প্রিয় বাবা মা। আর রেখে গেল তাকে ভাইবোনহীন একদম একা এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। ঠাই হলো তার সেই খালার দুই রুমের ছোট্ট এপার্টমেন্টে। তখন কমিউনিষ্ট শাসন জীবন ছিল অনেক রকম নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে বন্দী । অসচ্ছল সংসার তারপরও খালা -খালু দুজনের আদর আর শাসনে বেড়ে উঠছিল আনাস্তাশিয়া, তাদের আদরের নাস্তাশিয়া।

স্কুল পাঠ চুকিয়ে শুরু হলো কলেজ জীবন। সেই সাথে তারও আঠারো বছরের যৌবনের জয়গান সারা শরীর জুড়ে। স্বর্নালী চুল একহারা গড়নের মিষ্টি মেয়ে নাস্তাশিয়া দৃষ্টি কাড়তো অনেক নবীন যুবকেরই।

এসময়ই এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হলো এক বিদেশী ছেলের সাথে। নাম তার শাকিল, দেশ বাংলাদেশ। পড়তে এসেছে সরকারী বৃত্তি নিয়ে, ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র।তবে প্রথম দেখায় খুব একটা আঁচড় কাটেনি তার মনে। নাস্তাশিয়ার বন্ধুদের সাথে এক টেবিলে বসেই গল্প করছিল সে। এর পর আরো দু একবার দুর থেকে তাকে দেখেছে হেটে যাচ্ছে ওভারকোট আর টুপিতে চোখ মুখ ঢেকে দীর্ঘদেহী শাকিল।

নাদিয়া আর শাকিলের বন্ধু নিকোলাই এর জন্মদিন। নাস্তাশিয়ারও সেখানে নিমন্ত্রন।পার্টিতে অনেক গল্প আড্ডা আর নাচ শেষে বিদায়ের পালা। শাকিলের সাথে করমর্দন করতে গিয়ে হঠাৎ করেই মনের মধ্যে ভেসে উঠলো এই কি শেষ দেখা তাদের ! নাস্তাশিয়ার চোখ আর চেহারায় সুস্পষ্ট আকুলতা বুঝতে পেরে মুখ ফুটেই জানালো শাকিল, পরের সপ্তাহে সে আসবে দেখা করতে, তার কি সময় হবে ??

কি উত্তর দিয়েছিল বা আদৌ দিয়েছিল কিনা মনে করতে পারে না আজ।
মনে আছে পরের সাপ্তাহিক ছুটিটা তারা কি মধুর ভাবেই না কাটিয়েছিল গল্প করে। আবার পরের সপ্তাহে আসবে বলে চলে গেল শাকিল। এমন করে দু এক সপ্তাহ যাবার পর নাস্তাশিয়ার মনে হলো সে যেন গভীর প্রেমে পড়েছে সে এই শ্যামল দর্শন বিদেশী যুবকের। নাহলে সারাক্ষন তার কথা ভাববে কেন সে !
আচ্ছা সেও কি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে যেমনটি সে বেসেছে! মনের মধ্যে প্রশ্নটি সবসময় তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। থাকতে না পেরে একদিন প্রিয় বান্ধবী নাদিয়াকেই জিজ্ঞেস করলো ।
'শোন, যদি সে তোকে ভালোই না বাসে তবে এত দুর থেকে সে কেন ছুটে ছুটে আসে বলতো বুদ্ধু কোথাকার !
খুশীতে ঝলমল করে উঠে নাস্তাশিয়ার চোখ মুখ। সত্যিই তো কেন আসবে সে !
এবার যখন রোববার দেখা হবে তখন সে অবশ্যই ব্যপারটা জানতে চাইবে কেন সে আসে ! কিন্ত তার জানতে চাওয়া হলো না, রোববারের আগেই শাকিল ছুটে আসলো তার হোষ্টেলে। ডেকে নিয়ে গেল বাইরে।মাঠের ধারে বিশাল ওক গাছটার নীচে দাড়িয়ে তার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ' নাস্তিয়া তুমি আমার সম্পর্কে কি ভাবো বলোতো '??
থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে নাস্তিয়া জানালো ' আমি মনে করি তুমি খুব ভালো ছেলে'।
'শুধু এটুকুই! বিস্মিত শাকিলের প্রশ্ন।
'আর কি জানতে চাও বলো ?'
এরপরই শাকিলের সেই চিরন্তন প্রশ্ন, 'তুমি কি আমার মত আমাকে ভালোবাসো নাস্তিয়া' !
এর উত্তর আর মুখে দেয়া সম্ভব নয়। খুশীতে ঝলমলে মুখটা কোনমতে শাকিলের ওভারকোটে ঢাকা বুকের মাঝে লুকোতে পারলেই বাঁচে।
এক হাত দিয়ে নাস্তিয়ার মুখটা তুলে চোখের উপর থেকে ঝাকড়া সোনালী চুলগুলো সরিয়ে জানতে চাইলো শাকিল , 'নাস্তিয়া আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই তুমি কি রাজী ? ঠিক করে বলো'??
খুশীতে গলা বুজে আসা নাস্তিয়া ঢোক গিলে মাথা নাড়ে কথা বলতে পারে না।
ফাইনাল পরীক্ষা কাছে চলে এসেছে শাকিলের, এরপরই ফিরে যেতে হবে দেশে। তিন ভাই বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই আর সবার বড় সে । সরকারী কর্মকর্তা বাবা মারা গেছেন ৬ বছর । মা অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন। বোনদের বিয়ে দিতে হবে বিশেষ করে বড়টির যে কি না তার পিঠাপিঠি। অনেক দায়িত্ব। সবই খুলে বলেছে সে তার আদরের নাস্তিয়াকে। নাস্তিয়া সানন্দে জানিয়েছে শাকিলের পরিবারের সব কাজেই রয়েছে তার অকুন্ঠ সমর্থন।
বিয়ের ব্যাপারে নাস্তাশিয়ার খালা খালু একটু গররাজী ছিলেন, বিদেশী ছেলে কেমন হবে কে জানে ? তাছাড়া সেই দেশ সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাও নেই।
শাকিল মা কে জানালো নাস্তাশিয়ার সাথে প্রেম আর তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তের কথা। অনেক আশা নিয়ে বসে থাকা মা তাৎক্ষনিক কিছু বলতে পারে না । কত কল্পনা ছেলে জন্ম নেয়ার সময় থেকেই । কি হবে, কি করবে, কেমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে, কেমন করে খুজে আনবে লাল টুক টুকে রাজকন্যা । কিন্ত সব স্বপ্ন মুহুর্তে চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে পড়লো ছ বছর আগের হাতের সেই চুড়ির মত, যেদিন শাকিলের বাবা মারা গিয়েছিলেন।

তারপরও মা ছেলের অনুরোধ উপরোধ ফেলতে না পেরে মৌন সন্মতি জানালেন। প্রবাসী এক পরিচিত লোকের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন একটি লাল কাতান শাড়ি আর হাজার অভাবের মধ্যেও সযত্নে রাখা তার হাতের দুটো সোনার বালা ।

চলবে----
২য় পর্ব
Click This Link

ছবিটি নেট থেকে নেয়া ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:২৯
৫৫টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×