somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুপোলী নূপুর

০৮ ই নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১)

টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল মারুফ নিজেও জানেনা। যখন ঘুম ভাঙ্গলো, তখন তার বিছানা আর বালিশের বেশ কিছুটা অংশ ভিজে গেছে বৃষ্টির ছাটে। তড়িঘড়ি উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে গ্রিলের সাথে লেগে হাতে খানিকটা ছড়ে গেল মারুফের। রাগ উঠে গেলে নিজেকে সামলাতে পারেনা মারুফ, এক ঝটকায় বালিশটা মেঝেতে ফেলে দিলো সে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পাতলা কাঁথাটার সাথে পা জড়িয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল মেঝেতে। সামলে নিয়ে কাঁথা আর বিছানার চাদরটাও এক টানে নামিয়ে দিলো মেঝেতে। তারপর টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে সিগারেট ধরালো। মাথা দপদপ করছে রাগে। সামনে যা পাবে, ভেঙ্গে ফেলবে সে এখন। হাজার চেষ্টা করেও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা মারুফ। মাঝে মাঝে সে জন্য বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে, কিন্তু সে নিরুপায়।

আজকের সকালটা শুরুই হলো বাজে ভাবে। হয়তো সারাটা দিন এভাবেই যাবে। সিগারেট শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো মারুফ। টানা বারান্দাটার শেষ মাথায় বৃষ্টির পানি পড়ে পিচ্ছিল হয়ে ছিল, পা হড়কে গেল তার। মেজাজটা আবার সপ্তমে চড়ে গেল মারুফের। বেশ শব্দ করেই কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিল সে, কাকে উদ্দেশ্য করে, কেউ জানেনা। তারপর ক্যান্টিনে গিয়ে ঢুকলো। তিনটা পরোটা, ডিম আর আলু ভাজি অর্ডার দিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আজকে সকালে আর কারও সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারবে না সে, বুঝেই গেছে। মারুফের এই চেহারার সাথে পরিচিত ক্যান্টিনের সবাই, সাবধানে ওর নাস্তাটা টেবিলে দিয়ে গেল রাজীব নামের পিচ্চি ছেলেটা। গ্লাস ভাল করে ধুয়ে পানি দিয়ে এলো এরপর। এত সকালে মারুফকে ক্যান্টিনে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছে ওরা সবাই। ততক্ষণে অবশ্য খেতে শুরু করে দিয়েছে মারুফ। আড় চোখে একবার শুধু দেখলো রাজীবকে। এই দৃষ্টিতেই ভয় পেয়ে গেল ছেলেটা, পালিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। একজন দুজন করে ক্যান্টিনে আসতে লাগলো হলের অন্য ছেলেরা, ভরে উঠতে লাগলো ক্যান্টিন।

সকাল বেলাতেই রফিক স্যারের ক্লাস, খাতা কলম গুছিয়ে শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসলো মারুফ। বরাবর এখানেই বসে সে। মন মেজাজ ভাল থাকলে অন্যদের সাথে দু একটা কথা বলে, কিন্তু আজকের দিনটা ভাল না, তাই চুপ করে বসে রইলো সে। সীমাহীন রাগের কারণে ওকে কিছুটা ভয়ই করে সহপাঠীরা। সহজে ওকে ঘাটাতে চায়না কেউই। আজকেও ওর চেহারা দেখেই ওরা যা বোঝার বুঝে গেছে, কেউ এগিয়ে এসে কথা বললো না ওর সাথে। মারুফও মনে মনে এটাই চাইছিল। বলা যায় না, কার কি কথায় আবার রাগ উঠে যায় ওর। কিছুক্ষণ পর ক্লাসের বোকাসোকা আলাউদ্দিন এসে বসে ওর পাশে। কমন সেন্সের যথেষ্ট অভাব আছে এই ছেলেটার। কাকে কখন কি বলতে হবে, কিছুতেই বোঝেনা সে। বিরক্ত হয় মারুফ, কিন্তু কিছু বলে না।

"একটা নতুন মেয়ে আসছে ক্লাসে, দেখেছিস মারুফ?" ফিসিফিসিয়ে বলে আলাউদ্দিন। ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকায় মারুফ। মেয়েদের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন সে, ক্লাসে নতুন কে আসলো, কে চলে গেল, এ ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই ওর। আর তাকেই কি না এই ছেলে বলছে নতুন মেয়েটাকে দেখেছে কি না। স্টুপিডিটির একটা সীমা আছে, এই ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে বোঝা যায় ওর স্টুপিডিটির আসলে কোন সীমা পরিসীমা নেই। মারুফের ঠাণ্ডা চোখ দেখেও দমে গেলনা আলাউদ্দিন। বড় বড় চোখ করে আগ্রহের সাথে বলতে লাগলো - "মেয়েটা বিরাট সুন্দরী রে, ময়দার বস্তার মত ফর্সা, ইয়া বড় বড় চোখ, কলিজা কেমন করে যেন তাকাইলে। আর মেয়েটার নাম নদী"। মারুফের হাসি পেয়ে গেল ওর কথা শুনে। এইসব ছেলের ওপর সব সময় রাগ করাও যায় না, ওরা আজগুবি টাইপের কথা বলে হাসতে বাধ্য করে সবাইকে।

২)

সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর ক্লাসের সবার সাথে মিশে গেল নদী। হাসি ঠাট্টায়, গানে, আনন্দে মাতিয়ে তুললো আড্ডা গুলোকে। ক্লাসের বাইরেও অনেকের সাথে কথা বলতে দেখা গেল ওকে। হাসি ছাড়া কথা বলতে পারেনা নদী। দিনে দিনে কলেজের কালচারাল ইভেন্ট গুলোতে সাবলীল হতে দেখা গেল ওকে। ক্লাস ব্রেকের বিরক্তিকর সময়ে এখন ক্লাসেই বসে থাকে বেশীরভাগ ছেলেমেয়ে, নদী খালি গলায় গান গেয়ে শোনায় সবাইকে। মেঘলা দিনে বৃষ্টির গান, কারও মন ভার থাকলে আনন্দের কোন গান গেয়ে সবার অতি আপন একটা মানুষ হিসেবে স্থান করে নিলো মেয়েটা। কেবল একটা ছেলের সাথেই ওকে কথা বলতে দেখা যায়না, সে হচ্ছে মারুফ। মারুফের যে নদীকে ভাল লাগেনা, তা নয়। সে বরাবরই এসব ব্যাপারে নিঃস্পৃহ, কোন কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই তার।

একদিন লাইব্রেরী থেকে জটিল একটা নোট নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বেড়িয়ে আসছে মারুফ, করিডোরের অপর প্রান্তে তখন নদী, লাইব্রেরীতে আসছে। হাতের ইশারায় মারুফকে থামালো নদী -

- আমি নদী, আপনার নাম তো মারুফ, না?
- হু, আমার নাম মারুফ।
- একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না, আপনি এত ভাব নিয়ে থাকেন কেন সবসময়?
কি জবাব দেবে খুঁজে পায়না মারুফ। মেজাজ খারাপ হবার মত কথা, কিন্তু কেন যেন রাগ করতে পারছেনা মারুফ, শুধু হাসে।
- আমরা সবাই বন্ধু না? বন্ধুদের মাঝে কেউ মুখ গোমড়া করে থাকলে কি ভাল লাগে, বলেন? এই দেখেন, একই ক্লাসে পড়ে আমি আপনাকে আপনি করে বলছি। বন্ধুদের সাথে এই দূরত্ব রাখা কি ঠিক?
- আসলে আমি কথাই কম বলি।
- কথা বেশী বলবেন ... বলবে, আচ্ছা? আমি এখন থেকে তুমি করে বলবো, তুমিও, আচ্ছা? এই দেখো, 'আচ্ছা' বলাটা কিন্তু আমার মুদ্রা দোষ। ওকে ... এখন যাই, ভাল থেকো কিন্তু।

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে আসে মারুফ, জবাবে কিছু একটা বলা দরকার ছিল নদীকে, কিছুই গুছিয়ে বলতে পারেনা সে। কিন্তু মন ভরে থাকে অদ্ভুত এক আনন্দে। মেয়েটা আসলেও অন্য রকম। আকাশ ভরা রোদ যেন সাথে নিয়ে চলে সে, আলোকিত করে দেয় চতুর্দিক। এক নিমিষে উড়িয়ে দেয় দূরত্বের দেয়ালটা।

এরপর থেকে ক্লাসে টুকটাক কথা হয় ওদের, কিন্তু মারুফ তার স্বভাব বদলাতে পারেনা সেভাবে, শামুকের খোলসে ঢেকে রাখে নিজেকে, কেন রাখে নিজেও জানে না। কিন্তু কোন ভাবেই নিজেকে বদলাতে রাজী না সে, ও যা ও তাই, মারুফ নামের ছেলেটা একটু অন্য রকম, এটাই ওর পরিচয়। নিজেকে বড় কিছু বা সবার চাইতে আলাদা কিছু ভাবা নয়, এমনিতেই সে অন্য রকম।

দিন গড়িয়ে যায়, এক সময় অবাক হয়ে মারুফ লক্ষ্য করে ক্লাসের বেশীরভাগ সময় ওর চোখ থাকে নদীর দিকে। ক্লাসের পরের সময়গুলোতেও মাঝে মাঝেই নদীর কথা মনে পড়ে ওর। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও এক সময় মারুফ বুঝতে শুরু করে, সে নদীকে পছন্দ করে। কিন্তু ওর পক্ষে কোন মেয়েকে প্রোপোজ করা এক প্রকার অসম্ভব। নিজের কাটা গণ্ডীতে আটকা পড়ে আছে মারুফ নিজেই। সেখান থেকে বের হবার পথ জানা নেই ওর।

৩)

সেদিন ক্লাসে তেমন কেউ আসেনি, গতকাল থেকে অসম্ভব বৃষ্টি বাইরে। শহর ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। একটা মাত্র ক্লাস ছিল, নাজনীন ম্যাডামের। উনি এসে ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা দেখে রোল কল করে চলে গেছেন। মারুফের কেন যেন রুমে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সে বসে আছে করিডোরের শেষ মাথায় বারান্দার ছোট দেয়ালে পা তুলে। আনমনে বৃষ্টি দেখছে। সামনের ঝাঁকড়া আম গাছটার ডালে শালিক পাখীর বাসায় মা আর বাবা শালিক তাদের ছানাপোনাদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাচ্চা গুলো মনে হয় শিশুদের মতই চঞ্চল। মা বাবার ডানার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের ছোট্ট মাথা বেড়িয়ে আসছে। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। এমন সময় কে যেন এসে দাঁড়ায় ওর পাশে, মারুফ মাথা ঘুরিয়ে দেখে - নদী। এই বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা এলো কিভাবে?

- আজকে ক্লাস হয়নি? আমি তো লেট করে এলাম, যা বৃষ্টি বাইরে, এসে দেখি ক্লাসে কেউ নেই। এই ঝড় জলে ভিজে ভিজে আসাটাই লস হলো আজকে। - হেসে হেসে বলে নদী। জবাবে মারুফ শুধু হাসে, কিছু বলে না।
- আচ্ছা, তোমার সমস্যা কি? কথা বলোনা কেন তুমি? বুঝেছি, তোমাকে স্পিচ থেরাপি দেয়া লাগবে।
- আমি আসলে কথা গুছাতে পারিনা, সে জন্য বলিনা।
- সব সময় গুছিয়ে কথা বলতে হবে এমন দিব্বি কে দিয়েছে আপনাকে? হু?
- না, আসলে সেটা না, ছোট বেলা থেকেই কম কথা বলি আমি।
- এখন থেকে বেশী বেশী কথা বলবে, আর গান শুনবে অনেক, সুন্দর সব গান, আচ্ছা? আর কবিতা পড়বে। কবিতা পড়লে গান শুনলে মানুষের হৃদয় বিশুদ্ধ হয়।
- আমার হৃদয়টা কালো, সেখানে শুধুই কষ্ট আর কেমন যেন গুমোট ধরা অন্ধকার।
- বাহ, এই তো তুমি কি সুন্দর করে কথা বলতে পারো। আমি আগেই বুঝেছিলাম যে তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বলবে।
- কেমন করে বুঝেছিলে? আমি তো কথাই বলিনা।
- বোঝা যায়, আমি মানুষ চিনি। তোমার মনে এত কষ্ট কেন সেটা জানতে চাইবো না, কিন্তু চেষ্টা করবো তোমার ভেতরটা আলোকিত করতে - নদীর গলার স্বরটা কেমন উদাস শোনায়। মারুফ মুখ ঘুরিয়ে দেখে নদীকে। আকাশী নীল জামাতে মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজকে। কপালে লেপটে আছে ভেজা এক গোছা চুল। অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছে নদীকে।

- আমি একটু বসি এখানে, সরো তো - মারুফ দেয়াল থেকে পা নামিয়ে সরে বসে।
- কি দেখছিলে ওদিকে এত মনোযোগ দিয়ে? বৃষ্টি?
- দেখবে? ওই খানে দেখো, শালিক পাখীর বাসাটা, ওখানে শালিকের বাচ্চাগুলো কি করছে।
- কই কই, দেখি?

গাছের ডালে শালিক পাখীর বাসা খুঁজতে ব্যস্ত হয় নদী। মারুফ এদিক ওদিক দেখে। ওরা এভাবে বসে আছে দেখলে অনেকেই হয়তো উলটো পালটা ভেবে বসবে। কিন্তু কিছুই করার নেই, মারুফের অবশ্য ভালই লাগছে। নিঃসঙ্গতাটা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এত নিঃসঙ্গ হয়ে ছিল সে, বোঝেনি কখনও।

- আমার না খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে, গান শুনবে? রবীন্দ্র সঙ্গীত? ভাল লাগে তোমার?
- হু, শুনবো।
- ভাল না লাগলেও চুপ করে বসে থাকবে, কানে আঙ্গুল দেবে না, ঘুষি দিয়ে নাক ভেঙ্গে ফেলবো তাহলে।
- তুমি ভাল গান করো, আমি জানি, শুনেছি - হাসতে থাকে ওর কথা শুনে মারুফ। গান ধরে নদী -

এই যে তোমার প্রেম ওগো
হৃদয়হরণ ...
এই যে পাতায় আলো নাচে
সোনার বরন ...
এই যে মধুর আলস ভরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ ...
এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ
প্রভাত আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে
এই তোমারি প্রেমের বাণী
প্রাণে এসেছে
তোমারি মুখ ওই নুয়েছে
মুখে আমার চোখ থুয়েছে
আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ
হৃদয়হরণ ...


- নদী তুমি কাঁদছো? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মারুফ
- কই, না তো, আসলে গানটার সাথে মিশে গেছিলাম আমি
- গানটা অনেক সুন্দর, কথা গুলো অনেক সুন্দর
- আমি কেমন গাইলাম? পঁচা? - কপট অভিমান নদীর গলায়
- আরে না, তুমি খুব সুন্দর গাও তো
- থ্যাঙ্ক ইউ

নদীর বা হাতটা রাখা দেয়ালের উপর। ওর রিং ফিঙ্গারে ছোট্ট একটা আংটি। আংটির ওপর ছোট্ট সাদা পাথরটা জ্বলজ্বল করছে। মেয়েরা বিয়ের আংটি এই আঙ্গুলেই পড়ে। মারুফের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকার নদী -

- জ্বি না স্যার, আপনি যা ভাবছে তা নয়, এটা মা দিয়েছেন আমাকে আমার জন্মদিনে। হেসে ফেলে নদী
- ও আচ্ছা। কথা খুঁজে পায়না মারুফ
- আমি অবশ্য ওটা প্রোটেকশন হিসেবে ইউজ করি। অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। জানো তো, মেয়েদের অনেক রকম যন্ত্রণা সইতে হয়।

হেসে ফেলে মারুফ। এই মেয়েটা সত্যি অনেক ভাল আর অনেক সরল। ঠিক তখনই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামে। নদী তাড়াহুড়ো করে পিছিয়ে আসতে যায়, ওর হাত গিয়ে পড়ে মারুফের হাতের উপর। ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে শীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে মারুফের অস্তিত্বে। স্পর্শের একটা জীবন্ত অনুভূতি আছে, মুহূর্তে পালটে দিতে পারে যে কোন পরিবেশ, সে কোন সময়।

কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা হাতড়ে কাগজের একটা প্যাকেট বের করে আনে মারুফ। নদীর অবাক দৃষ্টির সামনে প্যাকেট খুলে বের করে একটা রুপোর নূপুর। তারপর বলে -

- নদী, তুমি এই নূপুরটা পড়বে? আমি খুব খুশী হবো তুমি এটা পড়লে। নদী কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে
- কবে যেন কিনেছিলাম নূপুরটা। সব ছেলের মনেই একটা প্রজাপতি মেয়ের ছবি থাকে। হয়তো তার কথা মনে করেই কিনেছিলাম। কোনদিন কাউকে দিতে পারবো, ভাবিনি। আজকে এই মুহূর্তে এটা তোমাকে দিতে খুব ইচ্ছে করছে।

নদী তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওর চোখে ভরে ওঠে জলে। মারুফের বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে ওর অশ্রু দেখে। খুব ইচ্ছে করে নদীর চোখ ছুঁয়ে অশ্রুকণাটা মুছিয়ে দিতে।

- জানো, ছোটবেলায় মা খুব সখ করে আমার নাম রেখেছিলেন নূপুর। কিন্তু এই নামটা ধরে শুধুই মা ডাকতেন আমাকে। তার খুব সখ ছিল নাচ শেখার। একা একাই কিছুটা নাচও শিখেছিলেন। ছোট বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তার সেই সখ কখনও পূরণ হয়নি। মা আমাকে দিয়ে তার স্বপ্নটা পূরণের চেষ্টা করতেন। একটু আধটু বুঝতে শেখার সময় থেকে আমি আমার পায়ে নূপুর দেখে এসেছি। স্কুলে যাবার সময় মা আমাকে একই সাথে নাচের স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই সারাক্ষণ নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ তুলে ঘুরে বেড়াতাম আমি।
- এখন তো তোমার পায়ে নূপুর নেই। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মারুফ।
- আমার মা চলে গেছেন আমার এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে। ক্যান্সার ধরা পড়েছিল তার কয়েক মাস আগে। সে সময়ে ডাক্তার বলেই দিয়েছিলেন, তেমন কিছুই আর করবার নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় কষ্ট পেতেন মা, আর মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন সেই ঘরে নূপুর পড়ে হাটতে। নূপুরের শব্দে তার কষ্ট কমে যেত। আমি সারাক্ষণ তার আশে পাশে হেঁটে বেড়াতাম, নাচ দেখাতাম। যেদিন মা চলে গেলেন, আমি তখনও ঝুম ঝুম শব্দ তুলে হাঁটছিলাম তার আশে পাশে। এক সময় দেখলাম মা ঘুমিয়ে পড়লেন, আমিও হাটা থামিয়ে তার পাশে বসলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম মা'র মুখটা কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে দেখি কি ভীষণ ঠাণ্ডা। সেদিন থেকে আর নূপুর পরিনা আমি।

চোখে এক সমুদ্র জল নিয়ে বসে আছে নদী। মনে হচ্ছে যে কোন মূহুর্তে শুরু হবে বর্ষণ। নদীকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে জানেনা মারুফ। ওরা দুজনেই তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে। এক সময় মৌনতা ভাঙ্গে মারুফ -

- নদী, আমার স্বপ্নের প্রজাপতি মেয়েটাও নূপুরের শব্দ তুলে হেটে বেড়াতো। নূপুরের শব্দে আমারও মন ভাল হয়ে যায়। মা'র অভাবটা তো কখনও পূরণ হবার নয়, তবুও আমার মনে হয় তুমি আবার নূপুর পায়ে হাঁটলে মা দূর নক্ষত্রের দেশ থেকে সেই ঝুমঝুম শব্দ ঠিকই শুনতে পাবেন। উনি খুশী হবেন দেখে যে, তার ভীষণ আদরের মেয়েটা আবারও নূপুর পড়ে হাঁটছে।

নদী মুখ ঘুরিয়ে তাকায় মারুফের দিকে।

- নদী, নেবে না নূপুরটা?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে নদী
- না, হাত বাড়িয়ে নেবো না আমি। হাত বাড়িয়ে কখনও কিছুই নেবো না তোমার কাছ থেকে। তুমি ইচ্ছে হলে পড়িয়ে দিও আমাকে।

নদীর গাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসে তপ্ত অশ্রু। মাটিতে পড়ার আগেই সেটা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় মারুফ। ওর হাতে জ্বল জ্বল করে এক খণ্ড অশ্রুকণা অথবা এক দানা মুক্তো।

~ সমাপ্ত ~

** অর্জুন চক্রবর্তীর কন্ঠে - এই যে তোমার প্রেম - গানটি শুনতে ক্লিক করুন এখানে
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×