somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন নিডো গার্লের কাহিনী

০৮ ই নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ ভুতু মিয়া,ও ভুতু মিয়া,সকাল হইসে তো,ঘুম থেকে উঠবানা?’প্রতিটা সকালে কাজল খালার ডাকে এভাবেই ঘুম ভাঙত আমার।খালা চুলে বিলি কেটে না দিলে ঘুম যেন ভাঙতে চাইত না আমার।কাজল খালা আমার আপন খালা না।আমাদের কোন দূরসম্পর্কের কোন আত্মীয় হবেন হয়তো।জ্ঞান হবার পর থেকে মা বাবাকে খুব কমই একসাথে দেখেছি।প্রেমের বিয়ের পর তাদের ভালবাসাটা টিকেনি বেশিদিন।বাবাকে সপ্তাহে একবার দেখতাম আর মা বাসায় প্রডাকশন হাউস নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।বাসায় যে একটা দুধের শিশু আছে সেটা তার খেয়ালই থাকতো না।যখনি তাদের একসাথে দেখতাম তখনি তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় মত্ত।একবার আমার প্রায় নিউমনিয়া হয়ে গিয়েছিল।শেষে কাজল খালা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।বড় হয়ে শুনেছিলাম আব্বুআম্মুর আমাকে এই পৃথিবীতে আনার কোন ইচ্ছাই ছিল না।আমি ছিলাম তাদের অনাকাঙ্খিত সন্তান।কাজল খালা আমাকে মায়ের মতই আগলে রাখতেন।এই মহীয়সী নারী তার জীবনের সংসার,আরাম আয়েশ সব ত্যাগ করেছেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

ক্লাস ফোরে থাকতে বাবা-মার মধ্যে সেপারেশন হয়ে যায়।তখন আমাকে নিয়ে তাদের টানাটানি শুরু হল।তখন আমি ভিআইপি হয়ে গেলাম।পরে সিদ্ধান্ত হল আমি বাবার কাছে থাকবো।কাজল খালা থাকাতেই মায়ের অভাবটা তেমন টের পেতাম না।কিন্তু ক্লাসমেটদের মায়েরা যখন টিফিন এনে খাওয়াতেন তখন শুধু শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম।একদিন পেন্সিল বক্স না আনাতে মিস আমাকে অনেক বকা দিলেন। আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন।ক্লাসের সবাইর সামনে আমার কাহিনী মিসকে বললাম।পরের দিন স্কুলে গিয়ে দেখি আমার ব্যাগে একটি পেন্সিল বক্স রাখা। ভাবলাম কেউ হয়তো ভুলে রেখে গেছে।আমি এটা মিসের কাছে দিতে যাচ্ছিলাম,তখন একটা মেয়ে এসে বলল,তোমারতো পেন্সিল বক্স নেই...আমার দুটা ছিল একটা তোমাকে দিয়ে দিলাম।নাম তার মাহিয়া।আমাদের পুরো ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়ে।এদিকে আমার অন্য বন্ধুরা আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগল।আমি নাকি ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে।অনেকেই আমাকে ব্রোকেন-বয় বলে খেপাত।খুব অসহায় লাগতো।মুখে কোন কিছুই বলতাম না।মাঝে মাঝে মাহিয়া প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতো।আমার মনের কান্নাটা বোধ হয় সে টের পেত।

ধীরে ধীরে মাহিয়ার খুব কাছের বন্ধু হয়ে গেলাম।বাসায় কাজল খালা আর স্কুলে মাহিয়া,এইদুজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল আমার পৃথিবী।ও আমার বড় বোনের মত হয়ে গেল।ও যা বলত তাই সুবোধ বালকের মত শুনতাম।মাঝে মাঝে যে ঝগড়া হতো না তা না।একবার ক্লাসটেস্টে অঙ্ক ভুল করাতে আমাকে গাধা বলল।আমি বললাম,আমিতো ছোট,আমারতো মুখ থেকে মায়ের দুধের গন্ধ যায়নি।ব্যস এর পর থেকে আমাকে ও ডানোবয় বলে ডাকা শুরু করল। আমিও ওকে নিডোগার্ল বলে ডাকতাম।আসলে ছোট বেলা থেকে কেউ আমাকে এভাবে কেয়ার করেনি,তাই হয়তো কোথাও একটু আদর পেলেই মাথা গুজে দিতাম।

ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি আর মাহিয়া ‘রোমিও ও জুলিয়েট’ নাটক করলাম। নাটকের ৮ দিনের মহড়ায় আমি যেন অন্য মাহিয়াকে আবিস্কার করলাম।নির্ঘুম রাতের ভাবনায় আশ্রয় নিল সে।আর এজন্যই হয়তো মুল অনুষ্ঠানে ডায়লগ ভুলে গেলাম।মুল অনুষ্ঠানের দিন ওকে জুলিয়েটের সাজে পরীর মত লাগছিল।অনেক ভেবে দেখলাম বামুন হয়ে চাদের দিকে হাত বাড়িয়ে লাভ নেই।অযথা ওর সাথে সম্পর্কটা নষ্ট হবে।আর ও পড়াশুনার বাইরে ও কিছু ভাবত না।একটু আঁতেল টাইপ স্টুডেন্টরা যা হয় আরকি।হয়তো ভারি ফ্রেমের আড়ালে চোখগুলো আমার চোখের ভালবাসাটা পড়তে পারেনি।তাই আমার ভালবাসাটা কষ্টের পাহাড়ে চাপা দিয়ে রাখলাম।ও যে আমাকে অবহেলা করে তা নয়।এতো পড়াশুনার মাঝেও আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয়া,নোট ফটোকপি করে দেয়া,পড়াশুনার খোজখবর নেয়া সবই করতো।মাঝে মাঝে আমার বাসায় আসতো।কাজল খালাকে ও অনেক পছন্দ করতো।কাজল খালাও ভাল রান্না হলে ওকে খবর দিতে ভুলতেন না।

এইচএসসি পরীক্ষার পর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।ওর সাথে দেখা হয়না প্রায় ২ মাস।অথচ গত ৯টা বছর একসাথে পরেছি।মাহিয়া ছাত্রী ভাল হওয়াতে একসাথে চান্স পাওয়ার সুযোগও নেই বললেই চলে।একবার ভাবলাম ভাল রেজাল্ট হলে ওকে মনের কথাটা জানাবো।১৩ই অক্টোবর দুপুর বেলায় রেজাল্ট দিল।মাহিয়া প্রত্যাশামত এ+ পেল।আমার রেজাল্ট তখনো জানতে পারিনি। হঠাৎ ভিড় ঠেলে মাহিয়া দৌড়ে এসে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে চিৎকার করে বলল,ডানোবয় তুমি এ+ পেয়েছ।আশেপাশের মানুষ তখন হা করে তাকিয়ে দেখছে।মাহিয়া তা বুঝতে পেরেই লজ্জা পেয়ে দৌড়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল।এরকমটা ঘটবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।সে হয়তো নিজেও ভাবেনি।তবে ওইদিন ওর ভারী ফ্রেমের আড়ালে চোখগুলোতে ঠিকই ভালবাসাটা পড়ে নিয়েছিলাম।ওই দিন রাতে ওর অনেক জ্বর উঠল।পরের দিন খালাকে নিয়ে ওর বাসায় গিয়ে দেখলাম ও কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।আমি ওর পাশে বসাতে লজ্জা পেয়ে কাথা দিয়ে মুখ ঢাকতে চাইল।আমি তখন আমার নিডোগার্লের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।আর কেউ না দেখতে পেলেও আমি তখন টের পেয়ে গেছি আমার নিডোগার্লের হাতটা কাঁথার নিচ দিয়ে আমার হাতে আশ্রয় নিয়েছে।খুব ইচ্ছা হচ্ছিল ওর রেশমি চুলগুলো কপালের যেখানে হারিয়ে গেছে সেখানে একটা চুমু খাই।

আমি জাহাঙ্গিরনগর আর ও ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেল।প্রতি বৃহস্পতিবারে ওকে দেখতে ঢাকা যেতাম।সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় ওকে বাসায় পৌঁছে দিতাম।ওর আব্বু-আম্মু আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। ভার্সিটি লাইফটা মসৃণভাবেই চলছিল।ফাইনাল ইয়ারে মাহিয়া তার ভাললাগার কথা বাবাকে জানাল।ওর বাবা আমাকে ডেকে আমার ফ্যামিলি সম্বন্ধে জানতে চাইল।সত্যি কথাটা শুনার পর আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন আরশোলা দেখছেন।বাবা-মার দোষে আমিও দোষী হয়ে গেলাম।মাহিয়াকে আর ভার্সিটিতে যেতে দেয়া হল না।ওর বান্ধবীর কাছে শুনলাম ওর নাকি কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
একমাস পর ভার্সিটিতে ওর সাথে দেখা হল। চোখের নিচে কাল দাগ,দেবে যাওয়া গালে ওকে চেনা যাচ্ছিল না।ও শুধু আমাকে বলল...আমার জন্য অপেক্ষা কোরো।এটা বলেই চলে গেল...আমি ওর পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।কথাটার মানেটা বুঝতে পারলাম না।

ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে হয়েও কখনো উশৃঙ্খল হয়ে যাইনি।ভাল থেকে কি লাভ...তার চেয়ে বরং সত্যিকারের ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেই হয়ে যাই।কাজল খালা কিছুই জানতেন না।একদিন আবেগ সামলাতে না পেরে খালাকে সবকিছু খুলে বললাম। খালা বললেন ,চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।সেটা যে পরের দিনই ঠিক হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।সকালবেলা উঠে দেখি মাহিয়া আমার মাথার কাছে বসে আছে।সে একেবারে চলে এসেছে।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আসলে মাহিয়া আগেই সব খালাকে জানিয়েছিল,শুধু অপেক্ষা করছিল ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা কখন শেষ হয়।

৩ বছর পরের কথা।মাহিয়া এখন শুধুই আমার।বাবা আমাদের বিয়ে মেনে নেননি।বাবার মানার পরোয়াও করিনি।২৪বছরের জীবনে কখনো বাবার দায়িত্ব পালন করেননি।অথচ বিয়ের অনুমতি চাইতেই পুরোদস্তুর বাবা হয়ে গেলেন।তাই বাবার বাড়ি ছাড়তে একটুও কষ্ট হয়নি।মাহিয়ার ফ্যামিলিও বিয়েটা মানেনি।বিয়ের পরের ২ বছর দুজন অনেক কষ্ট করে ২ রুমের একটা সংসার চালিয়েছি।সারাটা দিন চাকরি আর টিউশণী করেই কেটে যেতো।সে সময় কাজল খালা সাপোর্ট না দিলে কি হতো আল্লাহই ভাল জানেন।মাহিয়া প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকেই ওর বাবার রাগ কমতে শুরু করেছে।আল্লাহ আমাদের ঘর আলো করতে একটা নয়...একসাথে দুই-দুইটা অ্যাঞ্জেল দিয়েছেন।আইমা ও আয়ানের ৯ মাস চলছে।সারাটা দিন গাধার মত খাটার পর বাসায় ফিরে যখন দুই অ্যাঞ্জেলের দুইদাতের স্বর্গীয় হাসি দেখি ...কিংবা ওদের মুখে সদ্যফোটা বাব্বা....বাব্বা ডেকে যখন কোলে ঝাঁপিয়ে পরে... তখন ক্লান্তিগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়,...শরীরটায় খেলে যায় অমিয় শান্তির শিহরণ।ডানোবয়,নিডোগার্ল,কাজল খালা আর দুই অ্যাঞ্জেল ভালই আছে...আল্লাহর অশেষ রহমতে।ভালই চলছে আমাদের টোনাটুনির সংসার।

***মাহিয়া কিন্তু এখনও আমাকে ডানোবয় বলেই ডাকে।আর আমি কি ডাকি সেটা আপনারা বুঝে নেন...:P
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×