somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দরজার ওপাশে!

০৮ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দরজার ওপাশে!
( হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর)
জুলাই ২৫, ২০১২

তাঁর কোন বইটি কিম্বা লেখাটি আমাকে প্রথম নাড়া দিয়েছিলো? কোন বইটি পড়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছি? আবার কোন লেখাটি পড়তে পড়তে ওপাশ ফিরে শুয়েছি( চোখের পানি না আবার কেউ দেখে ফেলে- এই শঙ্কায়! )?ঠিক মনে করতে পারি না। ভাবতে ভাবতে তাঁর অনেক লেখাই( সব নয়) মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথার চারপাশে ঘুরতে থাকে। চরিত্র গুলো অদ্ভুত নীরবতায় ডুবে গিয়ে বলে, দরজার ও পাশের মানুষটার কী খবর? ঘুমোতে পারছে তো শান্তিতে?

মনে আছে, একবার কী কারণে যেন মন খারাপ। মন খারাপ হলে আমি যা করতাম তাই করছিলাম। ওপাশ ফিরে চিলতে আকাশ দেখছিলাম আর এলেবেলে ভাবছিলাম। আব্বা অফিস থেকে ফিরে এসে বললেন, আজকে একটা কাণ্ড হলো।

জানতে চাইলাম, কি রকম?

বললেন, অফিসে হুমায়ূন এসেছিলো। বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো। লোকটা এমন মজার মজার সব গল্প বলে। হাসতে হাসতে কাহিল। আমি ওঁর বই তেমন একটা পড়িনি দেখে একটা বই উপহার দিয়েছে। আর বলেছে- হান্নান ভাই, আমি আপনাকে বলি না আমার বই পড়েন। এই বইটা বাসায় নিয়ে যান। যাকে ইচ্ছা তাকে দেন পড়তে। আপনার পরিবারের যে কোনো একজন পড়লেই হলো। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আরে কি যে বলেন। আপনার লেখা তো বাসার সবাই পড়ে। আমারই কেবল তেমন সময় হয়ে ওঠে না। সংসার চালাতে গিয়ে কাজে কর্মে এমন ব্যস্ত থাকি। লোকে ভাবে এতো বড়ো চাকরি করি। আমার আবার সংসার চলে না কী করে! সত্যি কথা বলতে কি, এই কদিন আগেও আমি টিউশনি করেছি। ছেলে মেয়েরা বড়ো হচ্ছে। তাই ছাত্র পড়াতে একটু লজ্জাই লাগে। এখন তো তাও প্রুফ-ট্রুফ দেখে আর সম্পাদনা করে কোনো মতে চলে যায়। আচ্ছা বইটা দিন, এটা আমি পড়বোই।

আব্বা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন একটা চকচকে নতুন বই, 'রজনী'। হুমায়ূন আহমেদ নীল কালিতে লিখেছেন, সংসার চালানোয় হিমসিম খাওয়া হান্নান ভাইকে শুভেচ্ছা।

বই পড়ার আগে আমি সবসময় উৎসর্গ পত্রটি পড়ি। আর উনারটা তো পড়তেই হবে। কারণ, একেকটা উৎসর্গপত্রই তো একেকটা অণু গল্প। আমি পড়তে শুরু করলাম, উনি লিখেছেন(যত দূর মনে পড়ে) ... এলিফ্যান্ট রোডের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা জটলা চোখে পড়লো। বিষয়টা কী জানার জন্য কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, একজন লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর লোক জন তাঁকে ঘিরে আগ্রহ নিয়ে দেখছে। আমি দেখি, হুমায়ূন ফরিদী। আমার এই বইটি সেই জন নন্দিত অভিনেতার জন্য...

আমি পড়তে লাগলাম বইটি। যখন শেষ করলাম, তখন রাত একটা বাজে। আমি আর পলাশ (আমার ছোটো ভাই) এক বিছানায় থাকতাম, দেখি ও তখনো জেগে। আমার শেষ হবার পর সে শুরু করবে এই জন্যই বুঝি জেগে ছিলো। ও হলো ফাস্ট রিডার। দ্রুত গতিতে পড়ে যায়, আর মাঝে মাঝে থেমে এক চোট হেসে নেয়। আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, কোন জায়গাটাতে রে তুই এখন...? ও বলে ... বাবার কাশির অংশে... হি হি হি।। দেখো বাবাটা একদম আব্বার মতো। আর মায়ের চা বানানোটা দেখো, একদম আম্মা যেমন করে চা বানায়... পঁচিশ বছরেও এখনো চায়ের কাপে সর ভাসে... হিহিহি...

আমি বলি, হয়েছে, এখন ঘুমা... বলি ঠিকই ওকে। কিন্তু নিজের চোখেই আমার ঘুম নেই... স্বপ্ন বাস্তবতার কী অপূর্ব অভীক্ষন! মানুষের এতো ক্ষমতা!

এ রকম কতো শত বই! কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো। 'তোমাকে' বইটি যে কতবার আমি পড়েছি, ঠিক বলতে পারবো না... প্রতিবার পড়েছি আর নতুন নতুন সত্য আবিষ্কার করে চমকে উঠেছি। দুই যমজ বোনের বন্ধন, আবার এক মানুষকেই দুজন ভালোবাসে, একজন চুপি চুপি প্রীতির অংশটা নিয়ে সরে যায়। শুধু স্বপ্নে পুকুরে গোসল করতে গিয়ে ভেসে ওঠে সেই মানুষটির মুখ...ভালবাসাতো আসলে এমনই, তাই না... অসাধারণ!


'নক্ষত্রের রাত' পড়তে পড়তে ফারগো রাজ্যের তুষারে হারিয়ে যাওয়া হাজারো ধীমান বাঙ্গালীর পরিণতি দেখি যেন। পাশাপাশি প্লেটোনিক আদলে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সও বুঝি উঁকি- ঝুঁকি দেয়। শেষের অংশে এসে বিভাজিত মন বলে, নাহ, ভালো হয়েছে। নাসিমের প্রতিই তো সে থেকে যাবে বিশ্বস্ত। চিঠি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যাওয়া- সে তো আসলে নিরাপদ ভালোবাসাই। পাশা হারিয়ে যাক, অনন্ত বরফে, একজন এলিয়েন হয়ে।


এমন আরো কতো! কোনটাকে বাদ দিবো? বুনো ভাইকে আমি ভালবেসেছিলাম সেই কবেই! 'আমাদের সাদা বাড়ি' এমন উঁচু হয়ে কালো মেঘে ঢাকা আকাশে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন একটুকরো সাদা মেঘ। অজগরের মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুনো ভাই শুধু বই পড়তো। অথচ, যে কোনো গভীর অনাচার সুক্ষ্মতার বিচারে ধরা দিতো তারই বোধে। অমন একটা মানুষ খুঁজে চলেছি আমি সারাজীবন, পেয়েছি কি? কই, আমার তো তালাশ থেমে যায় নি!


হিমু, শুভ্র, মিসির আলী- এঁদের অস্তিত্ব এতটাই প্রবল(প্রকট নয় মোটেই) যে আমার মতো মৃদু ভাষণ কারী ওদের নিয়ে কিছু বললেই কী আর না বললেই কী। আমার আগ্রহ চলে যায় 'নির্বাসনের' সেই ছেলেটির দিকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে যে দেখেছে তারই নীল পদ্ম রাতের আলোক সজ্জা ম্লান হবার আগেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে দিয়েছে সব হারানোর যন্ত্রণা। জরির বিদায়টা যেন শেষ নিঃশ্বাসের মতোই। বাকিটা সময় তো কেবল অসাড় হয়ে শুয়ে থাকাই।

পাশাপাশি আমি যেন হয়ে যাই 'সাজঘরের' কোনো এক আসিফ, অভিনয় ছাড়া কিছুই সে শেখে নি জীবনে। জীবনের সব টুকু পাওয়া তো তাঁর ঐ অভিনয় শৈলী দিয়েই। আর না পাওয়াও বুঝি তাঁর জন্যই। সে কারণেই, অমন ত্যাগ। সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে, একজন সাদামাটা সংসারী মানুষ। 'বাকিটা সময়, এমনিই তো হয়...' । যাপিত জীবনের আনাচে কানাচে কতোই না অমন হীরে পড়ে আছে। কে কার খবর রাখে। অটোগ্রাফের ঝলকানিতে সম্বিত ফেরে তাকিয়ে দেখি নিজেরই পরিজনের দিকে। আরে, আমি তো কোনদিন এভাবে দেখিনি তাঁকে! কী অদ্ভুত আমাদের এই মানব জন্ম!


কতদিন এমন হয়েছে, টিউশনি সেরে পাগলের মতো রিকশা খুঁজেছি। এমনিতে খুব একটা চরতাম না রিকশায়। হেঁটে চলে আসতাম বাস স্টপে। এক বা দু টাকায় হয়ে যেতো কাজ। কিন্তু, কোনো কোনো দিন আমি রিকশা খুঁজতাম। পেতাম না, রাত বেড়ে গেলে ওরা রায়ের বাজার যেতে চাইতো না। আমি থেমে থাকতাম না। হন হন করে হাঁটতাম। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বাসাতেই চলে আসতাম। ভালো করে লক্ষ্য করতাম, রাত ন'টার মধ্যেই চারদিক শুনশান। কেমন অদ্ভুত রকম নিঃশব্দ। আর হবেই বা না কেন, আজ যে ' এই সব দিনরাত্রি' নাটক। সবাই কাজ সেরে বসে গেছে টিভি সেটের সামনে। নাটকের প্রথম অংশটা বুঝি মিস হয়ে গেলো আমার।

এমন আরও কতো আনন্দ বেদনার কাব্য। ভাবতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। আমার বিস্মৃতি পরায়ণ মনের গহীনে সব তলিয়ে যায়। হাতড়ে তুলে আনতে কষ্ট হয় খুব। কোনটা যে গল্প আর কোনটা নিজের জীবনের গাঁথা, গুলিয়ে ফেলি। গল্প-উপন্যাস আর নাটকের চরিত্রগুলো কখন যে নিজের জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, টের পাই নি। হয়তো তাই হঠাৎ যখন এইসব দুরাচার দেখি, চমকে উঠি। মনে মনে ফিস ফিস করে নিজেকেই বলি, লোকটি ভালো আছে তো।?শান্তিতে ঘুমোতে পারছে তো দরজার ওপাশে?!

৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×