somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

০৭ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন । সেই দিনটিতে, যেই দিনটিতে ঠিক ৫৮ বছর আগে চলে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কত বড় কবি ছিলেন কিংবা কত বড় কথাশিল্পী ছিলেন তার মূল্যায়ন তো এইরকম চট জলদি লেখায় করা যাবে না, করা সংগতও নয় । একজন শিল্পী-সাহিত্যিক নানা ভাবে আবিস্কৃত হন তাঁর মৃত্যুর পরে ,সুনীলের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটবেনা ।
কিন্তু একথা যদি বলি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক হিসাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাহলে বোধ করি বিতর্কের কোন যায়গা থাকেনা । অথচ একথাও তো ভুল নয় যে রবীন্দ্র কাব্যধারার বিরোধীতা করে ‘মধ্যরাতের কলকাতা শাসন’ অভিপ্রায়ী চার যুবকের একজন হয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়এর আবির্ভাব । ৬১-৬৫’র হাঙ্গরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা পেরিয়ে, গল্প উপন্যাসে অনাবশ্যক ও গা ঘিনঘিনে যৌনতা প্রকাশের পথ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক বা বাঙালি মননের বিবেক হয়ে উঠলেন কি করে সেটাই বিস্ময়কর, অন্তত আমার কাছে ।

আসলে সময় ও সমাজের দ্বান্দিক পরিবর্তনের পর্যায়গুলিতে তিনি নিজেকেও পরিবর্তীত করেছেন তাঁর ষাট বছরের সাহিত্য পরিক্রমায় । নিজেকে পরিবর্তীত করার প্রক্রিয়াই তাঁকে আজকের যায়গায় নিয়ে এসেছে । আর সেই পরিক্রমার পরতে পরতে সময় ও মানুষকে চেনা ও নিজেকে ঢেলে নেওয়া । সেই পরিক্রমায় উনিষ শতকে বাংলার নবজাগরণ , বাংলার সমাজ ও বাঙালি জাতীসত্তার আবেগ – অভিমান,দেশ বিভাগের যন্ত্রণা এবং রবীন্দ্রনাথ এমনকি সত্তর দশকের বাংলাও ছায়াপাত ঘটিয়েছে তাঁর সৃজনে ।

রবীন্দ্র কাব্যধারার বিরোধীতা করেই তাঁরা মানে সুনীল, শক্তি, শরৎ কুমাররা এসেছিলেন বাংলা কাব্য ক্ষেত্রে ঝড় তোলার লক্ষ্য নিয়ে । কবিতার জন্য ‘অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’ বলে শুরু করলেন ‘কৃত্তিবাস’ মধ্য পঞ্চাশে । অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত প্রেমেন্দ্র মিত্রদের ‘কল্লোল যুগ’ও শুরু হয়েছিল ত্রিশ এর দশকে ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’ বলে । সেই ‘পথ’ তাঁদের আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিলোনা – থাকেনও নি বেশিদিন । সুনীলরাও পালটালেন । সুনীল গদ্যে এলেন এবং বলা যাক সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধেই হাঁটা শুরু করলেন । ১৯৬৫তে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ ।
এই ষাটের দশকেই বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রের কয়েকটি ঘটনা নিশ্চিত ভাবেই তখন ৩১ বছরের যুবক সুনীলকে প্রভাবিত করেছিল । ১৯৬১তে ‘বিটি রোডের ধারে’ ‘গঙ্গা’র মত উপন্যাসের লেখক, ‘মানুষ রতন’এর মত গল্পকার, পীড়িত মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখা কথাকার সমরেশ বসু লিখলেন ‘বিবর’। প্রাতিষ্ঠানিক আলোচকরা যাকে চিহ্নিত করলেন ‘বাংলা সাহিত্যের মাইল ফলক’ বলে’ । মাইল ফলক ! আর এই পথ বেয়েই ‘প্রজাপতি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাতভ’র বৃষ্টি’, সাহিত্যে শ্লিলতা- আশ্লিলতার প্রশ্নে আলোড়ন ইত্যাদি । ১৯৬০এ জার্মান বীট কবি এলেন গিনসবার্গ পাটনা বেনারস কলকাতা ঘুরে গেলেন । ১৯৬১তে শুরু হল হাংরি জেনারেশন আন্দোলন । মাত্র চার বছর স্থায়ী হয়েছিল এই আন্দোলন । সুনীল , শক্তি, বিনয় মজুমদার, উৎপল বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা হাংরি দর্শনেই প্রভাবিত হয়ে তাদের কাব্যজীবন শুরু করেছিলেন । সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’ অবশ্য ঘোষণা করেছিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেও তাঁর অবস্থান পরিস্কার করে জানিয়েছিলেন “আমি হাংরি জেনারেশান পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে),আমি ওদের কিছু-কিছু পাজী ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৪ তেই হাংরি সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন । বিনয় মজুমদার, উৎপল বসুরাও মূল স্রোতে ফিরে বাংলা কাব্য জগতকে দারুণ সমৃদ্ধ করলেন ।

স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ – ষাট - সত্তর দশকের সময় কালটা বাংলার সমাজ জীবনের এক ক্রান্তিকাল বলেই চিহ্নিত । একদিকে তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধী গণ আন্দোলন যাকে আরো তীব্রতর হওয়ার রসদ যোগাচ্ছিল সেই সময়ের সাহিত্য, নাটক । এবং ৬৯’এ তরাই’এর নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহ । যে সময়কালে কবিতা- গল্প- উপন্যাসে মানুষ কান পেতে আরো বেশি ‘সময়ের প্রতিধ্বনি’ শুনতে চাইছে , তখনই ১৯৬৫তে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’এ সুনীল সেই সময়ের যৌবনের বর্ণনা দিলেন এইভাবে ...“ফ্রীস্কুল স্ট্রীট, সোনাগাছি টালিগঞ্জের ধাপে ধাপে নেমে আসা বেশ্যার দল, ভাঙ্গা টিউবওয়েলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা মদের বোতল – এসবের মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে শক্ত ও খাঁটি করে তুলবো” ; এই জীবন দর্শন সেই সময়ের সত্যনিষ্ঠ বাস্তব ছিলনা । সেই জন্যই বলেছি প্রথম উপন্যাসে সুনীল সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটা শুরু করলেন ।

তারপর অনেকটা পথ পরিক্রমা । সময়ের সঙ্গে নিজেকে ঢেলেছেন সুনীল । আমরা যারা সেদিনের কুড়ি বাইশের তরুণরা মোটেই সুনীলকে পছন্দ করতামনা । সুনীল কিন্তু বদলালেন এবং সেই বদলে যাওয়া সুনীলকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হ’লনা । হয়ে উঠলেন নতুন বাংলা গদ্য ধারার অবিসংবাদি পুরোধা , নবীন প্রজন্মের কবিদের নিশ্চিত ভরসা স্থল, হয়ে উঠলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ও এপার-ওপার মধ্যবিত্ত বাঙালি মননের অভিভাবক ।
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×