somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা মধ্যবিত্ত.......

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এই লেখাটা আমার বন্ধু আরেফিন এর লেখা। এটা পড়ে এতটাই মুগ্ধু হলাম যে সবার সাথে শেয়ার করার ইচ্ছাটা ছাড়তে পারলাম না। খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে এখানে।)

আমরা মধ্যবিত্ত।

আমাদের বাপ জীবনে বিরাট কিছু করতে পারেননি, ‘৭১ এ যুদ্ধের বাজারে দাদা সম্পত্তির পাহাড় বানিয়ে যাননি। আমরা থাকি ভাড়া বাসায়। ঢাকায় থাকতে পারা আমাদের জীবনের বড় সার্থকতা। আপোষ করে বেঁচে থাকতে পারা আমাদের বড় বৈশিষ্ট্য।

আমরা মাসে দশ হাজার টাকা আয় করি, ব্যয় করি বারো হাজার। তারপরেও কীভাবে দিনের পর দিন আমরা চলছি আর চলছি, সেটা একটা বিরাট রহস্য। আসল আয়ের কয়েকগুণ বেশি জাঁকজমকের স্বপ্ন দিনের পর
দিন দেখে যাই আমরা, বাস্তবে সেটাকে ফলতে না দেখে কষ্ট পাই। মিশি আমরা উচ্চবিত্তদের সাথে, এবং তাল রাখতে গিয়ে খাবি খাই।

আমাদের বাবাদের কাছে প্রতিটি পয়ষার হিসেব দিতে হয়, কোথায় খরচ করেছি, কীভাবে করেছি। বাবাদের আমরা ভয় পাই, এবং যাবতীয় অভিযোগ করি মায়েদের কাছে। গৃহবধূ মা, বেচারিরা কোথা থেকে যে টাকা পান, কীভাবে পান - সেটা আমরা জানার চেষ্টা করি না। শুধু শখের কিছু চাইলে কোথা থেকে যেনো টাকা এনে দেন - এটুকু আমরা জানি।

আমরা রিকশায় চড়ি, লোকাল বাসে ঝুলি। একান্ত দরকার ছাড়া সিএনজিতে আমরা খুব একটা চড়ি না। কারও প্রাইভেট কারের সামনের সিটে বসতে পারলে নিজেকে আমরা গাড়িটার মালিক বলে মনে করি।

আমাদের প্রেম, ভালোবাসা ইত্যাদি আবেগ সম্পর্কিত ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামালে চলে না। যারা ঘামায় তারা কেউ ইতিহাস হতে পারেনি, তারা হেরে গিয়েছে। বাবা-মায়েরা তাই আতংকিত থাকেন আমাদের জীবনে প্রেমের গন্ধ পেলে। আর ভুলে যদি কেউ ভালবেসেই ফেলে সেক্ষেত্রে মা- বাবার কাছে ছেলে বা মেয়ের সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে, তাকে আমরা পছন্দ করেছি, আমাদের মা- বাবা নয়।

আমরা শিল্প ভালোবাসি, সাহিত্যও ভালোবাসি। পরিবারে আমাদের গান-বাজনার চর্চাও থাকে অল্পবিস্তর। তবে সন্তানদের মধ্যে কেউ শিল্পকে পেশা বানাতে চাইলে আমরা বিস্তর আপত্তি জ্ঞাপন করি। আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি আবৃত্ত বাক্য হচ্ছে, "এসব করে পেট চলে না।"

আমাদের সন্তানদের ওপরে আমরা চাপিয়ে দিই জীবনে মেলাতে না পারা যত অপূর্ণ চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলে ভালো, না হলে দিনের পর দিন আমরা বিসিএস পরীক্ষা দেই। পায়ের তলে শক্ত মাটি খোঁজা আমাদের চিরন্তন অভ্যাস।

আমরা ছেলে-মেয়েদের সরকারী ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে চাই, এর বেশি খরচ করার সাধ্য আমাদের কোনওদিনও ছিলো না। ভাবখানা এমন, আমাদের সংসারে মধ্য-মেধার সন্তান জন্মাতে নেই। যদি ভুলে একটা কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েই নেয়, তবে তার ওপরে সব রাগ ঝেড়ে মনে মনে অশ্রুপাত করি, আর বলি, "এর বেশি সামর্থ্য ছিলো না আমাদের।"

ছাত্রজীবনে অনেক আশা নিয়ে প্রবেশ করি আমরা, ভাবি বিরাট কিছু করে ফেলবো। পাশ করে বের হয়ে মামা, চাচাদের খোঁজে দৌড়াই। মিলে গেলে ভালো, না মিললে বেকার বসে থাকতে হয় আর "কিছু একটা হয়ে যাবে" ভাবতে ভাবতে দিন পার করতে হয়।

সন্তানদের বিদেশ পাঠাতে পারলে আমাদের চেয়ে সুখী আর কেউ হয়না। বিদেশ গিয়ে সেই সন্তান যখন আমাদের ভুলে যায়, তখনও আমরা বড় গলা করে বলি, " আমার ছেলে বিদেশ থাকে।"

অবচেতন মনে আমরা ছেলেই চাই, মেয়ে হলেও অবশ্য আপত্তি নেই, তবে তাকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। মেয়েদের পড়ালেখা আমাদের কাছে মূল্য রাখে অবশ্যই, তবে ছেলেদের মতো নয়।

জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাদের আশা থাকে একটি রাজকন্যা পাওয়ার, এবং পাই মফঃস্বলের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, মোটামুটি ধরনের মেয়ে। আমাদের বিয়েগুলো পারিবারিক পছন্দে হয়। আমরা বিবাহ বিচ্ছেদের ঝামেলায় জড়াতে চাই না সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে পছন্দ না হলেও দিনের পর দিন আমরা সুখী দাম্পত্য জীবনের অভিনয় করে কাটিয়ে দেই ও আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

নিজ সন্তানের বিয়ের সময় আমরা যতটা না পুত্রবধু বা জামাতা খুঁজি তার চেয়ে বেশি খুঁজি একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চবিত্ত পরিবার। প্রতিটি সম্পর্ক আমাদের জন্য হয়ে ওঠে উপরে উঠার সিঁড়ি। আর এই সিঁড়িটির নাম রাখি আমরা সামাজিকতা।

আমাদের বার্ধক্য শুরু হয় পেনশন সংগ্রহের দৌড়ের মধ্য দিয়ে। কিছুদিন পর আমরা হয়ে উঠি নাতি-নাতনিদের রূপকথা শোনানোর মেশিন। আমাদের প্রাচীনপন্থী চিন্তাধারার জন্য নাতি-নাতনিদের বাবা মায়েরা অবশ্য আমাদের সব উপদেশে কান দিতে নিজের সন্তানদের নিষেধ করেন।

তাই পুরনো স্মৃতি রোমন্থন আর ছেলের বৌয়ের অপমানজনক কথাবার্তা শুনতে শুনতে নিজের পরিবারেই গলগ্রহ হয়ে আমরা ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই।

এই যে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনচক্র, এটা খুব সাধারণ। এর মধ্যে অসাধারণ কিছুই নেই। মধ্যবিত্তরা অসাধারণ শুধু স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে। জীবনে এমন কোনও স্বপ্ন নেই যেটা মধ্যবিত্তরা দেখে না, কিন্তু বেশির ভাগ স্বপ্ন হেরে যায় সামর্থ্যের কাছে।

স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নে বসবাস করা, নিজের চোখে সেই স্বপ্নের মৃত্যু দেখা, এবং এবং আবার কোনও স্বপ্ন তৈরি করে তার মধ্যে বসবাস শুরু করা - এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত জীবন। এখানে আর কোনও কিছুর স্থান নেই।

টাকা নামের এক মূল্যবান কাগজ দ্বারা চালিত এই পৃথিবীতে সব জায়গাতেই কেউ কেউ জিতে যায়, কেউ কেউ হেরে যায়। যারা জিততেও পারে না, হারতেও পারে না, মাঝখানে নির্লজ্জের মতো ঝুলে থাকে - তারাই মধ্যবিত্ত.........
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×