লেকের দুধারে গাছপালা ভাল-ই । মেঘলা আকাশ, লেকে ছায়া পড়ে গেছে একেবারে । লেকের পাড়ে একটা গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে কল্প । রবীন্দ্র সরোবরে আশেপাশে এত মানুষের কোলাহল যেন কানেই আসছিল না ওর । চারিদিকে কেমন একটা স্তব্ধ ভাব মনে হচ্ছে । লেকের জলের মত সবকিছুই স্থির লাগছিল ওর কাছে । অনেকক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে কাটল । ঘোর কাটতেই কল্প লক্ষ্য করল লেকের মাঝখানটাতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা যেন জোনাক হয়ে ঝিকিমিকি করে জ্বলছে । কানে একটা চাপাস্বর আসতেই চমক ভাঙ্গল কল্পের । ‘কল্প তুমি এখানে-’
‘কি, এসে গেছ তাহলে, আমি তো ভাবলাম আরো দেরি হবে’, মুখে শান্ত একটা হাসি ফুটিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিল কল্প । ‘আসবো না ? আফটার অল বিয়ে বলে কথা’, বলেই ফিক করে হেসে দিল অনিতা । অনিতার মায়াভরা চোখ দু’টোর দিকে তাকালে কল্পের বুকের ভেতরটা কেমন জানি শীতল হয়ে আসে । এমন অপূর্ব চোখ মনে হয় সে কখনও দেখেনি । একবার তাকালে মনে হয় শুধু ঐ চোখ দু’টোর দিকে চেয়েই জীবনটা পার করে দেওয়া যায় । আজ প্রায় তিনটা বছর হয়ে গেল অনিতার সাথে পরিচয় । অথচ কখনও এ কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারেনি কল্প । আজও খুব ইচ্ছে করছে বলে দিতে । কিন্তু প্রতিবারের মত এবারও কে জানি ওর গলা চেপে ধরেছে ।
‘কি হল ? চুপ করে রইলে ?’
‘কিছু না । তোমার হাতে ওটা কি ?’
‘পাঞ্জাবী ।’
‘পাঞ্জাবী ?’
‘ওমা ! পাঞ্জাবী ছাড়া কেউ বিয়ে করে ! দেখ না আমি আজ শাড়ি পরে এসেছি ।’ অনিতার মুখে হাসি যেন ধরে না ।
‘ও ! তাই তো ।’ এতক্ষণ কল্প খেয়ালই করে নি অনিতা আজ শাড়ি পরে এসেছে । হালকা নীল রঙের । খুব মানিয়েছে ওকে । অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে, সাথে ওর মুখের দীপ্তিভরা হাসি । বারবার দেখেও মন ভরে না । শুধু কি জানি একটা নেই নেই মনে হচ্ছে । অনেকক্ষণ পর লক্ষ্য করল অনিতা টিপ পড়ে নি । টিপ পড়লে আরো ভালো হত । বোকা মেয়েটা । শাড়ি পড়েছে, অথচ কপালে টিপ নেই ।
‘অমন করে কি দেখছো ?’
‘কিছু না । কবিতা লিখছি ’, বলে হাসার চেষ্টা করল কল্প ।
‘কি !’
ছোট্ট একটা বৃষ্টির ফোঁটা অনিতার ঠিক কপালের মাঝখানে এসে পড়ল । আর কল্প বলে উঠল,
‘ বৃষ্টি ফোঁটায় টিপ বানিয়ে
পড়লি কপাল মাঝে
মেঘবালিকা ঠোঁট বাঁকালো
অপূর্ব তোর সাজে ।’
‘ওয়াও ! খুব সুন্দর ।’ খুশিতে অনিতার চোখ-মুখ ভরে উঠল ।
‘বৃষ্টি ভালো করেই আসবে মনে হয় । চল যাওয়া যাক ।’
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ক্রমে বাড়তে শুরু করল । ওরা দ্রুত হেঁটে গিয়ে একটা রিক্সায় চাপল । এই প্রথম রিক্সায় অনিতার পাশে বসে কল্প আড়ষ্ট হয়ে গেল । প্রথম থেকেই অনিতা খুব খুশি । খুব এক্সাইটেড । পালিয়ে বিয়ে করছে ! এক্সাইটেড হবে না ? অবশ্য এমন একটা সিরিয়াস কাজে অনিতার খুশিতে এক্সাইটেড হওয়া কল্পের কেন জানি ভালো লাগছে না । ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । প্লাস্টিক টেনে দিয়ে রিক্সার ভেতর কল্প গুটিসুটি মেরে বসে আছে । অনিতা সমানে বক বক করে যাচ্ছে । কিন্তু কোন কিছুই কল্পের কানে ঢুকছে না । ঝুম বৃষ্টিতে রিক্সা ধীরে ধীরে চলতে লাগল । বৃষ্টি তার প্রবল বর্ষণে যেন চারপাশটা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । আজ কল্পের মনের ভেতর এ কি শুরু হল ! কেমন জানি ঘোর ঘোর লাগছে । মনে হচ্ছে ও স্বপ্ন দেখছে ! ও, অনিতা, বিয়ে- এ সব কিছুই স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন । সত্য নয় ।
নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে ওরা যথাস্থানে এসে পৌঁছাল । ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে । ঝুম বৃষ্টির শেষে প্রকৃতি যেমন হঠাৎ নীরব হয়ে যায়, ঠিক তেমনি কল্পের ভেতরটা এখন শান্ত- স্থির । দু’জনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ । অনিতা নীরবতা ভেঙ্গে বলল, ‘কি হল ? আর কতক্ষণ ? আমার কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে ।’ অসহায় মুখে কল্পের দিকে তাকালো ও । কল্প একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘বিয়ের আগে সব মেয়েরই অমন লাগে । ব্যাপার না, একটু পরই সব ঠিক হয়ে যাবে ।’ পরম তৃপ্তিতে কল্প সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল । অনিতা খানিকটা বিরক্ত মুখে বলল, ‘এই ছাইপাশ না খেলে হয় না ?’ ‘হয় বৈ কি’, নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল কল্প । অনিতার বিরক্তি ক্রমশ বেড়ে গেল । কল্প সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পকেট থেকে ছোট্ট একটা খাম বের করে অনিতার হাতে দিচ্ছিল । অনিতা অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি এটা ?’ কল্প একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল । হঠাৎ লক্ষ্য করল তিনটা লোক ওদের দিকেই আসছে । খামটা আবার পকেটে পুরে নিল সে । মুখে শুষ্ক একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ওই তো এসে গেছে ।’ অনিতার ফ্যাকাশে মুখখানায় সাথে সাথে অপূর্ব একটা হাসি ফুটে উঠল ।
‘এসে গেছ তোমরা ? কতক্ষণ হল ? পথে কোন সমস্যা হয় নি তো ? কল্প, ভাই তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব । জানোই তো আমার কোনমতেই ওকে আনতে যাওয়া সম্ভব ছিল না । এমন একটা সমস্যায় আটকে পড়েছিলাম- যাই হোক । তোমায় কষ্ট দিলাম ভাই ।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো শেষ করে হাঁফ ছাড়ল আসিফ ।
‘কি যে বলেন আসিফ ভাই, এ আর এমনকি ’- বলে জোর করে হাসার চেষ্টা করল কল্প ।
‘চল তবে কাজী অফিসে যাওয়া যাক ।’
‘আসিফ ভাই আমার তো কাজ শেষ । আমায় এক্ষুণি যেতে হবে । খুব জরুরী কাজ আছে ।’
‘কী !’ অনিতার মন খারাপ হয়ে গেল । বলল, ‘আমার বিয়েতে থাকবে না তুমি ? এই তোমার বন্ধুত্ব ?’
‘বন্ধু বলেই তো এতদূর এসেছি পাগল !’ ভদ্রতার হাসি হেসে কল্প বলল, ‘আসিফ ভাই আমাকে যেতেই হবে ।’ আসিফ বুঝতে পারল বাঁধা দিয়ে লাভ নেই । ‘ঠিক আছে, যাও তবে । কি আর করা !’ ‘ভালো থাকবেন আসিফ ভাই । ভালো থেকো অনিতা, হ্যাভ আ হ্যাপি ম্যারিড লাইফ’- বলে শুষ্ক একটা হাসি দিল কল্প । অনিতার চোখ ছলছল করছিল । ততক্ষণে কল্প হাঁটতে শুরু করল ।
ট্রেনের শেষ হুইসেলটা বেজে উঠল । এক্ষুণি ঢাকা ছেড়ে যাবে । শুকনো মুখে কল্প ট্রেনের দরজায় এসে দাঁড়ালো, ওর চোখে- মুখে গভীর বিষাদের স্পষ্ট ছাপ । আস্তে আস্তে ট্রেন চলতে শুরু করল । পকেট থেকে খামটা বের করে ফেলে দিতেই বাতাসে উড়ে দূরে মিলিয়ে গেল । ক্রমশ সবকিছু দূরে সরে যেতে লাগল ওর কাছ থেকে । সাথে সাথে ওর অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যৎ সবকিছুই । চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এল । তীব্র একটা যন্ত্রণায় কল্পের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল ।