somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চীন-ভারতের পথে বাংলাদেশের অর্থনীতি....

০৩ রা নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় গ্রাম। বছর বিশেক আগেও এখানে ছিলো কেবল ফসলের ক্ষেত। সরু রাস্তায় যান ছিলো শুধু বাইসাইকেল। এখানে-ওখানে চরে বেড়াতো অল্প কিছু গবাদি পশু।

আজ বিশ বছর গ্রামটিতে গেলেই চোখে পড়ে বিরাট ইটের ভাটা। রাস্তা দিয়ে একটু পর পর ছুটে যায় গাড়ি, মোটরসাইকেল। গবাদি পশুর পাল চোখে পড়ে একটু পরপর। প্রযুক্তির ছোঁয়া চোখে পড়ে জনজীবনে। সব মিলিয়ে, একটা পরিবর্তনের আভাস যেন স্পষ্ট।

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের এ দেশে বেশি খনিজ সম্পদ নেই, নেই প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালে দেশটিকে মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালের তিন তিনবার সামরিক অভ্যুত্থান। আর বিরামহীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তো আছেই।

bangladesh-Economistকিন্তু তারপরও দেশটির গত বিশ বছরের চিত্র বিশ্লেষণ করলে অন্য কিছু ধরা পড়বে চোখে। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ১০ বছর বেড়ে ৫৯ বছর থেকে ৬৯ বছর হয়েছে, যা ভারতীয়দের চেয়ে ৪ বছর বেশি। অথচ ভারতীয়দের গড় সম্পত্তির পরিমাণ বাংলাদেশিদের চেয়ে অন্তত দুই গুণ বেশি।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুধু ধনীদেরই নয়, গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে হতদরিদ্রদেরও।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের দিকে তাকালেও দেশটির চমকপ্রদ কিছু অর্জন চোখে পড়বে। যেমন- ২০০৫ সালে ৯০ শতাংশের বেশি মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়, যা ছেলেদের চেয়েও বেশি। ২০০০ সালে এ সংখ্যা অর্ধেক ছিলো। ১৯৯০ সালে শিশুমৃত্যুর হার ছিলো প্রতি হাজারে ৯৭ জন, আর ২০১০ সালে এ সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩৭ জনে।

একই সময়ে মাতৃত্বকালীন উচ্চ মৃত্যুহার নেমে এসে প্রতি লাখে মাত্র ১৯৪ জনে দাঁড়িয়েছে। নারীদের গড় আয়ু যেখানে ছিলো পুরুষদের চেয়ে এক বছর কম, সেখানে তাদের বর্তমান গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে দুই বছর বেশি। স্বাস্থ্যখাতের এই বিস্ময়কর উন্নতির তুলনা করা যায় শুধু নব্বই শতকের শেষদিকে জাপানের মেইজি বিপ্লবের সঙ্গে।

এই উন্নতি কিন্তু নেহায়েত মানুষের আয় বাড়ার জন্য নয়। মাথাপিছু ১৯০০ ডলার আয় নিয়ে বাংলাদেশ এখনও একটি দরিদ্র দেশ।

স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি মাত্র দুই শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নব্বই দশকের পর থেকে এই বৃদ্ধির হার স্থায়ীভাবে ৫ শতাংশের উপর রয়েছে। ফলে যেখানে ২০০০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিলো ৪৯ শতাংশ, সেখানে ২০১০ সালে তা মাত্র ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এই অভূতপূর্ব উন্নতির জন্য চারটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়।

প্রথমত, পরিবার পরিকল্পনা ও নারীর ক্ষমতায়ন। ১৯৭৫ সালে যেখানে নারীর গড় সন্তান ধারণের হার ছিলো ৬.৩ জন, সেখানে ১৯৯৩ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩.৪ জনে। আর বর্তমানে সন্তান ধারণের হার মাত্র ২.৩ জন, যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আদর্শ হারের একেবারে কাছাকাছি।

bangladesh-Economist১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আলাদা হওয়ার সময় দুই দেশেরই জনসংখ্যা ছিলো সাড়ে ৬ কোটির মতো। আজ পাকিস্তানের জনসংখ্যা ১৮ কোটি, কিন্তু বাংলাদেশের ১৫ কোটি।

এর পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র দূর করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সরকারের চেষ্টায় নারীশিক্ষার হার বিস্ময়করভাবে উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে গত ২০ বছরে বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক উন্নতি ও ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে শতভাগ উপার্জনক্ষম হয়েছেন নারীরা।

দ্বিতীয়ত, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো কৃষি শিল্পের ধ্বস নামেনি বাংলাদেশে, যা দেশটিকে চূড়ান্ত দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এমনকি চলতি বছর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে দেশটি। অথচ ২০ বছর আগে এ দেশেরই মোট জনসংখ্যার তিনভাগের অন্তত একভাগ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো। ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দুইবার ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে, তিন দফায় খাদ্যের দাম বেড়েছে বিশ্বব্যাপী। সে সময় অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবার ধ্বস নামবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে সারা বিশ্বে কর্মরত ৬০ লাখ বাংলাদেশি। ২০১২ সালের জুন মাসে শেষ হওয়া অর্থবছরে তারা প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠান দেশে, যা দেশটির মোট আয়ের ১৪ শতাংশ। এসব প্রবাসীর একটি বড় অংশের নিবাস বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে। তারা নিজেদের পাশাপাশি নিজেদের পরিবারকেও স্বাবলম্বী করেছেন, যার ফলে বিদেশ থেকে আসা টাকা জমিয়ে দেশেও কৃষি কিংবা কুটির শিল্প গড়ে তুলছেন অনেকে। সারা বিশ্বে গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মান যেখানে নিম্নমুখী হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান সবসময়ই বৃদ্ধির দিকে।

bangladesh-Economistচতুর্থত, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও ক্ষুদ্রঋণ বরাবরই বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ কোন না কোনভাবে ব্র্যাকের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে। আর তাদের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। মানুষকে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও বিনিয়োগে তারা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে, যার ফলে আজ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা প্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৮ কোটি। ব্যাংকটি এ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এই ব্যাংক বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কার।

অপরদিকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি খাতে অবদান রেখে ব্র্যাক বাংলাদেশের জন্য অনেকটা স্যামসাং গ্রুপের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতেও স্যামসাংয়ের অবদান অনুরূপ। এছাড়াও ছোট-বড় কয়েক হাজার এনজিও অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান যোগানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছে।

বড় ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ, আধুনিক শিল্পের প্রসার ছাড়াও যে একটি দেশ স্বাবলম্বী হতে পারে, বাংলাদেশই তার প্রমাণ। দেশটির সবচেয়ে বড় সম্পদ তাদের মানবসম্পদ। সারা বিশ্বে যেখানে গ্রামগুলো অধিক উপার্জনের জন্য ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ গ্রামকেই বেছে নিয়েছে উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে। এর ফলে সবসময় মজবুত থেকেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি।

তবে রাজনীতির কালো হাত বারবার দেশেটির উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের ফলে প্রতিটি খাতই কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে নির্দিষ্ট কিছু শক্তির হাতে। তারপরও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সব উপেক্ষা করে যেভাবে দেশটির উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে, তাতে বলা যায়, রাজনীতি আর দুর্নীতির প্রকোপ থেকে মুক্তি পেলে দেশটি চীন কিংবা ভারতের মতোই দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে এগিয়ে যাবে।
লিংক
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×