somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পঞ্চম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা প্রসঙ্গে

০২ রা নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন ।জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ নামে যা’ পরিচিত।বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত রকমের নীতি প্রণীত হয়েছে সেসবের প্রত্যেকটিরই ভিতরে এবং বাইরে স্ববিরোধিতা থেকে গিয়েছে । জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর ব্যাতিক্রম নয় ।সরকারগুলোর কোন প্রকার লিখিত নীতির প্রয়োজনই পড়ত না যদি জনগণের দাবি না থাকত ।সে কারণেই দেখা যায় এসব লিখিত নীতির মধ্যে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী কিছু গণতান্ত্রিক উপাদান থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না ।জনগণের চাহিদা এবং তা নিয়ে সংগ্রাম অনুযায়ী সরকারগুলোকে লিখিত নীতির মধ্যে কিছু গণতান্ত্রিক উপাদান সংযোজন করতে দেখা যায় বটে ।কিন্তু এর ভিতরেই আবার সেসবের বৈপরীত্য এবং স্ববিরোধিতা দেখতে পাওয়া যায় । ফলে বাস্তবায়নের প্রতারণাতো থেকেই যায়, এসব নীতির ভিতর থেকেই জনগণের সাথে প্রতারণার কাজ শুরু হয়ে যায় ।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এখানে বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ।এই রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পিছনে মানুষের যেসব সংগ্রাম ছিল,গণমানুষের যেসব সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে তার মধ্যে বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরূদ্ধে সংগ্রাম ছিল অন্যতম ।কিন্তু নতুন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাক্ষেত্রে সেই বৈষম্যমূলক নীতির পরিবর্তন হয়নি ।স্বাধীনতার পর ড. কুদরাত এ খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছিল।সেখানে বহুধাবিভক্ত বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিল করে একটি গণমূখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছিল এমন নয়।অথচ জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি স্বাধীন এবং নতুন রাষ্ট্রের জন্য এমন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নে কোন বাধা ছিল না ।কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তার কারণ জনগণের পক্ষ থেকে একটি বৈষম্যহীন শিক্ষানীতির দাবি থাকলেও যাঁরা ক্ষমতায় বসেছিলেন তাঁদের জন্য বৈষম্যমূলক বহুধাবিভক্ত এবং বহুধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল ।সেজন্যই জনগণের সংগ্রামের দিক এবং শাসক শ্রেণির প্রয়োজনকে সমন্বিত করেই ড. কুদরাত এ খুদার শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ।জনগণের সংগ্রামকে সমন্বিত করতে এ শিক্ষানীতির মধ্যে যেসব গণতান্ত্রিক উপাদানের সংযোজন করা হয়েছিল বোধগম্য কারণেই সেগুলোকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায়নি ।তখন থেকেই শিক্ষানীতির মধ্যে দুটি অংশ দেখা যায় ।এক অংশ থাকে লিখিত যা জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয় এবং তার মধ্যে যেসব গণতান্ত্রিক উপাদান থাকে তা সব সময়ই লিখিত অবস্থায়ই থাকতে দেখা যায়, কার্যকর হয়না।অপর অংশ যা’ কার্যকর হতে দেখা যায় , তার অধিকাংশই লিখিত থাকে না । আবার অনেক সময়ই লিখিত যা’ রাখা হয় কোন জবাবদিহিতা বা সংশোধন ছাড়াই যাচ্ছেতাইভাবে তার বিপরীত কাজ করা হয় ।যেমন এ বছরে মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে যা করতে যাওয়া হলো তা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর সম্পূর্ণ বিরোধী ।শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে ,‘মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া অব্যাহত থাকবে ।’ শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় নিশ্চয়ই কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করে এই অংশটি সংযোজন করা হয়েছে । অনেক কিছুই পাল্টে যেতে পারে এবং সে অনুযায়ী বিবেচনাও পাল্টাতে পারে ।কিন্তু আমরা দেখলাম যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গেল এবং এ নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটতে থাকলো এবং তা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালেও কি কারণে শিক্ষানীতিতে উল্লখিত সিদ্ধান্তের বিপরীত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তার উল্লেখ কোথায়ও দেখা গেল না ।বরং স্বাস্থ্য মন্ত্রীর আলোচনা থেকে জানা গেল এতদিন যা’ হয়ে এসেছে তার কোন যুক্তি নাই ।এ থেকে ধারণা হয় শিক্ষানীতির মধ্যে যে এমন একটি বিষয় আছে তা বুঝি মন্ত্রী মহোদয় জানেনই না !এ বছর আন্দোলনের চাপে সিদ্ধান্তটি বাতিল করা হলেও আগামি বছর থেকে শিক্ষানীতিতে উল্লেখিত সিদ্ধান্তটির বিপরীত কাজ করার ঘোষনা দেওয়া হয়েছে ।এখানে কিন্তু বিষয়টির ভাল মন্দের প্রশ্ন পরে , যা’ বলতে চাচ্ছি তা হলো এখানে নিজেদের তৈরী একটি শিক্ষানীতির তাদের নিজেদেরই তোয়াক্কা না করার বিষয়টি দেখার মত ।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ প্রাথমিক শিক্ষার স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়েছে ।এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ,শিক্ষক নিয়োগ , শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য কতটুকু প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে ।এসবের কোন কিছুই চোখে না পড়লেও প্রাথমিক স্তরকে আরো শক্তভাবে দুইভাগে ভাগ করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে কোন বিলম্ব ঘটেনি ।এখানেও শিক্ষানীতির বাইরে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ।জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়নেরও আগে থেকে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর ২০০৯ থেকেই জাতীয় পর্যায়ে পঞ্চম শ্রেণি শেষে ‘সমাপনী’ পরীক্ষা নামে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে ।অথচ জাতীয় পর্যায়ে পঞ্চম শ্রেণি শেষে পরীক্ষার কোন সিদ্ধান্ত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এ উল্লেখ নাই ।সেখানে যা’ আছে তা’ হলো ‘পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা/পৌরসভা/থানা(বড় বড় শহর)পর্যায়ে সকলের জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ।’শিক্ষানীতির মধ্যে যেসব পর্যায়ে পঞ্চম শ্রেণি শেষে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলো তার তোয়াক্কা না করে জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে । কেন?এর জবাব তারা কি দিবে তা না জেনেও একটি কথা বলা যায় তা হলো লিখিত এ ধরণের কোন নীতিরই এরা অর্থাৎ শাসক শ্রেণির কোন সরকারই কোন তোয়াক্কা করে না ।এখানে কিন্তু শিক্ষানীতির মধ্যে যা’ বলা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় ।এর মধ্যেও স্ববিরোধিতা স্পষ্ট ।প্রথমেই যে বিষয়টি বলা যায় তা হলো শিক্ষানীতির মধ্যে একদিকে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা হচ্ছে অপর দিকে পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষা নাম দিয়ে কিসের ‘সমাপনে’র ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে ?এখানে ‘সমাপনী’ নামটির দর্শনগত দিক বিবেচনা করলে তাকে কোন ক্রমেই তা নিছক একটি নিরীহ নাম বলে মনে হয় না ।এর পর যা’ বলা যায় তা হলো যেহেতু প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হলো তার পর আবার পঞ্চম শ্রেণী শেষে শিক্ষানীতিতে উল্লখিত পর্যায়েইবা পরীক্ষা নেওয়া কেন?যখন এসব নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায় তখন এসবকেও ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে!
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষা একটি আবশ্যকীয় এবং অপরিহার্য্য বিষয় ।সেসব পরীক্ষার নানাবিধ লক্ষ্য থাকে ।উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার যে লক্ষ্য থাকে ঠিক একই রকম লক্ষ্য নিশ্চয়ই মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য প্রযোজ্য নয় । আবার মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার লক্ষ্য আর প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষার লক্ষ্যও একই হতে পারে না । প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে কতকগুলো শব্দ প্রায়ই উচ্চারিত হয় যেমন- ‘সর্বজনীন’, ‘বাধ্যতামূলক’। সরকারের লোকেরা যখন এসব শব্দগুলো বলতে থাকেন ‘সর্বজনীন’ শব্দটিকে নিতান্তই আলংকারিক মনে হয়। ফলে এটা বলার মধ্য দিয়ে তাঁদের দায়দায়ীত্বের কোন লক্ষণ দেখা যায় না।অপরদিকে বাধ্যতামূলক বলার মধ্যদিয়ে তাঁরা এমন ভাব ফুটিয়ে তোলেন যেন মনে হয় এই বাধ্যতা হলো যাঁরা বিদ্যালয়ে তাঁদের সন্তানকে পাঠাতে পারছেন না তাঁদের।সবার শিক্ষা নিশ্চিৎ করার দায় নেওয়ার বাধ্যবাধকতা যেন সরকারের বা রাষ্ট্রের নয় ।সে কারণেই নিজেদের দায়কে প্রতারণামূলকভাবে পাশ কাটাতে তথাকথিত উপবৃত্তি,বিদ্যালয়ে চাল-গম দেওয়ার কর্মসূচী তাঁরা চালু করেছেন ।এসবের মধ্য দিয়ে কখনোই প্রতীয়মান হয় না যে ,রাষ্ট্র বা সরকারগুলো সবার জন্য অন্ততঃ প্রাথমিক শিক্ষার দায়টুকু নিচ্ছেন ।যে স্তরেই হোক না কেন জনগণের শিক্ষা যেখানে রাষ্ট্রের দিক থেকে নিশ্চিৎ করা বাধ্যতামূলক সেখানে পরীক্ষার যে লক্ষ্য নির্ধারিত হবে সেখানে পরীক্ষার বাড়াবাড়ি অসম্ভব ।যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে এমনকি বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলোও যত কম আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে নেওয়া সম্ভব তাই করা প্রয়োজন ,সেখানে আমাদের শিশুদের হাতেখড়িই হচ্ছে পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতাকে স্মরণ করিয়ে । নির্মোহ এবং প্রশ্ন করে অগ্রসর হওয়ার স্বতঃস্ফুর্ততা একেবারে শুরু থেকেই বন্ধ ।পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া তথাকাথিত ভাল ফলাফল করাই শিশুর পড়ালেখার একমাত্র লক্ষ্য ।শিশুকে জানানো , শেখানোর দায় এখন নিঃশেষিত প্রায় ।পরীক্ষাকেন্দ্রীক শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশুকে চিন্তাহীন, স্বার্থপর এবং নির্বোধ করে গড়ে তোলার সরকারী আয়োজন অনেক পুরাতন।তবে বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজনের মধ্যদিয়ে তা’ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর সাথে নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে ।যা’ সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষার ধারণাকে বহুদুরে নিক্ষেপ করে ।
আমাদের দেশে সাধারণভাবে মানুষের মনে শিক্ষা সম্পর্কে যে ধারণা প্রথিত আছে তা পরীক্ষার বাইরে কিছুই নয় । শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সারণভাবে যে ধারণা বিরাজ করে তার ভিত্তিমূলে থাকে অর্থনৈতিক ,রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি । এ কারণে রাতারাতি শিক্ষার ধারণা পাল্টে ফেলা সম্ভব নয় এবং তার কোন প্রয়োজনও নাই ।রাতারাতি না পাল্টালেও ধারণাগুলো পাল্টে যায় ।দুই দিকেই পাল্টাতে পারে ।সামনের দিকে যেতে পারে , যাকে বলা যায় প্রগতি ।অপরদিকে ধারণাগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকতে গেলে সমাজ প্রগতির সাথে তা হয়ে ওঠে সাংঘর্ষিক এবং এর ফলে যে গতির সৃষ্টি হয় তা সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে না নিয়ে এক জায়গায় থেকে টালমাটাল ঘূর্ণী সৃষ্টি করে জনজীবনকে অস্থির আর বিশৃঙ্খল করে তোলে ।শাসক শ্রেণি নিজেদের স্বার্থের কারণে প্রচলিত ধারণাগুলোকে শুধু আঁকড়েই ধরে না, সুযোগ বুঝে প্রতারণামূলকভাবে সেগুলোকে আরো বেশি শক্ত করে তাদের টিকে থাকার পথকে বিপদমুক্ত রাখে ।বাংলাদেশের মানুষের সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এমন সব প্রতারণার ঘূর্ণীতে বিশৃঙ্খল এবং লন্ডভন্ড। এর মধ্য দিয়ে শাসক শ্রেণি মানুষের শ্রম-শক্তিতো দখল করছেই তার সাথে সাথে দখল করে নিচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক এবং সুষ্ঠু চিন্তা করার ক্ষমতাটুকুও ।আর চিন্তা দখলের জন্য এবং তাদেরই মত করে চিন্তা করিয়ে নেওয়ার জন্য যে জায়গায় খুব বেশি আয়োজন করতে হয় তা হলো শিক্ষার ক্ষেত্রে ।এ করতে শাসক শ্রেণি যত রকমের প্রতারণামূলক আয়োজন সম্ভব তার সবই করছে। সেই আয়োজনেরই একটি হলো পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষার নামে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন ।
জনগণকে যেসব প্রতারণায় শাসক শ্রেণির কার্যসিদ্ধি এবং কৃতিত্ব দুই-ই বাড়ে তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরীক্ষা এবং পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে প্রতারণা অন্যতম ।পৃথিবীর কোন্ দেশে এমন বয়সের শিশুদের এবং এমন স্তরে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ?পরীক্ষা কি শিক্ষার মান নির্ধারণ করে ? সম্পূর্ণ মতলবহীন পরীক্ষাও শিক্ষার মান নির্ধারক হতে পারে না ।তা হতে পারে প্রদত্ত মানের সূচক মাত্র ।যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক বলা হচ্ছে সেখানে এর অর্থ কি ? এর অর্থ কি এই নয় যে, প্রতিটি শিশুর জন্য এই স্তরের শিক্ষাটুকু নিশ্চিৎ করতে রাষ্ট্র এবং তার নির্বাহী সরকার বাধ্য? যখন এই স্তরের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন এই সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা আর সরকারের কার্যকরণের মধ্যকার বিশাল ফাঁক প্রকাশ হয়ে পড়ে । আর এই ফাঁক বন্ধ করার জন্য তারা নানা রকম প্রতারণামূলক কৌশল গ্রহন করে থাকে । নিজেদের দায়কে আড়াল করতে এ স্তর থেকেই ‘মেধাবি’নামক শব্দের এক খোলস তৈরী করা হয় ।২০০৯ সালের আগে এ খোলসটি ছিল ছোট, শুধুমাত্র তথাকথিত বৃত্তি পরীক্ষার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল ।২০০৯ সাল থেকে এ খোলসের কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে ।পঞ্চম শ্রেণি শেষে কেন জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তার কোন গ্রাহ্য যুক্তি উপস্থাপন করা হয়নি ।আগে কেন এ পরীক্ষা নেওয়া হতো না এবং এখন তা কেন নেওয়া হবে এ বিষয়ে অবশ্যই একটি ব্যাখ্যা থাকার প্রয়োজন ছিল ।কিন্তু অন্য অনেক বিষয়ের যেমন কোন ব্যাখ্যা থাকে না এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা নাই । একটি কথা শোনা যায় তা হলো ,বৃত্তি পরীক্ষাকে সর্বজনীন করার জন্যই নাকি এ ব্যবস্থা !এখন প্রশ্ন হচ্ছে বৃত্তি পরীক্ষারই বা প্রয়োজন কি ?সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে বৃত্তি পরীক্ষা নামক পরীক্ষা কেন ?বহু সংখ্যক শিশুর মধ্য থেকে কয়েকজন মাত্র শিশুর মাথায় মেধাবির মুকুট পরিয়ে দিয়ে সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলা মস্ত বড় তামাশা ছাড়া আর কি ? এই তামাশা বন্ধ করার জন্যই নাকি এখন শিশুদের জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা গ্রহন করা হচ্ছে ,কেউ কেউ তাই বলে থাকেন!এর জবাবে বলা যায় তামাশাটা এতদিন ছিল বটে তবে সর্বজনীন ছিল না ।২০০৯ সালের আগে পত্র পত্রিকার বিজ্ঞাপণের পাতায় না তাকালে এ তামাশা খুব একটা নজরে আসত না । এখন এ তামাশার মধ্যে সবাইকে জড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
তবে এ পরীক্ষা তামাশা মার্কা কথা বলে নেওয়া শুরু করা হলেও এর ফল শুধুই তামাশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না ।আমি জানি না বাংলাদেশে শিশু মনস্তত্ত্ববীদ বলে যদি কেউ থেকে থাকেন তাঁরা কিভাবে শিশুদের ওপর এতবড় চাপের বিষয়টি মেনে নিচ্ছেন!শিশুরা অত্যন্ত সংবেদনশীল হয় , তারা কোন ভাবেই নির্বোধ নয় । এসব সংবেদনশীল এবং সরল বোধসম্পন্ন শিশুদের ওপর শিক্ষার মত একটি জীবনের গতি নির্ধারণী বিষয় নিয়ে প্রতিযোগিতার এতবড় চাপ তাদের কি ভয়নক এবং স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে তা ভেবে দেখার মত কি একটিও বোধ সম্পন্ন বুদ্ধিজীবি বা শিশুমনস্তত্ত্ববীদ আমাদের দেশে নাই ? এতো গেল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক পঙ্গুত্ব বরণের বিষয় । এই পরীক্ষা বর্তমানে কি অবস্থার সৃষ্টি করেছে?
শিক্ষা নিয়ে যে বহুমূখি ব্যবসায় বিরাজমান বলা চলে তার সবই পরীক্ষাকেন্দ্রীক ।একথা পূর্বেই উল্লখ করা হয়েছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরীক্ষা থাকবেই । কিন্তু পরীক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের দ্বারা নির্ধারিত হয় শিক্ষাটাই পরীক্ষাকেন্দ্রীক কিনা ।শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই যদি হয় পরীক্ষাকেন্দ্রীক তবে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সংকীর্ণ হতে হতে প্রায় অন্তর্হিত হয় ।শিক্ষা নিয়ে নানা ধরণের বাণিজ্য গড়ে ওঠা তখন অনিবার্য হয় ।এখন তাই হয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রীক শিক্ষা নিয়ে চারদিকে বাণিজ্যও বেশ রমরমা ।তবে এতদিন এ বাণিজ্যে ঢাকায় তথাকথিত ভাল স্কুলে ভর্তির প্রতিযোগিতা ছাড়া সারা দেশের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরেই এমন ব্যপকত্ব ছিল না ।এ বাণিজ্য মূলত শুরু হতো এস.এস.সির মত পাবলিক পরীক্ষাকে সামেন রেখে নবম শ্রেণি থেকে ।এখন দুই দুটি পাবলিক পরীক্ষা বাড়তি যুক্ত হওয়ায় চতুর্থ শ্রেণির পর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে মানুষকে এ বাণিজ্যের শিকারে পরিণত হতে হচ্ছে ।চতুর্থ শ্রেণির পর থেকেই পাবলিক পরীক্ষাকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হতে হচ্ছে ।যাদের সে সঙ্গতি নেই কার্যত তাদের শিক্ষাজীবন এখানেই শেষ হতে বাধ্য ।শিক্ষামন্ত্রী এ পরীক্ষার ফলে ঝরে পড়া হ্রাসের কথা বলেছিলেন । তিনি কোন যুক্তিতে এ কথা বলেছিলেন বলা মুশকিল ।বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এ পরীক্ষার ফলে এ স্তর থেকই শিক্ষার ব্যয়ভার ব্যপক হারে বেড়ে গিয়েছে , যার সংকুলান গরীব মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এমনকি মধ্যবিত্তের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়েছে ।প্রাইভেটতো আছেই এ ছাড়া নানা রকমের গাইড এবং নোট বই ক্রয় করতে বাধ্য হতে হচ্ছে ।সেসব নোট বই এবং গাইড বইয়ের প্রচার এবং তার মধ্যকার তথ্য থেকে যে কোন মানুষ বিভ্রান্ত হতে বাধ্য যে এগুলো না পড়ে বা না কিনে কারো পক্ষেই এ পরীক্ষায় ভাল কিছু করা সম্ভব নয় । যেমন তথাকথিত সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা এবং ধরণ যা সম্পর্কে বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ কিছুই জানেন না অথচ এসব গাইড বইতে তা আছে । ওপর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর সম্বলিত বিভিন্ন ঘোষনা এবং পরীক্ষার রুটিন , রেজাল্টের তারিখ , সনদ পত্র বিতরণের তারিখ এসব গাইড বইতে শোভা পাচ্ছে । যা’ থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসায় সরকারি লোকজনের সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।
এই পরীক্ষার ফলে শিশুদের শেখা-জানার কি দশা হচ্ছে?এ স্তরের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যেখানে শিশুকে চিন্তা করতে শেখানো ,সেখানে এতবড় পাবলিক পরীক্ষার আয়োজনের ফলে কি হচ্ছে ?এই এতবড় পাবলিক পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয় শিশুর ঘাড়ের ওপর যত পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়েছে তাতে কি শিশুর দম ফেলবার সময় আছে?কিভাবে সে স্বতঃষ্ফুর্ত চিন্তা করতে শিখবে ? কিভাবে তার বিকাশ হবে ? এতসব পরীক্ষার আয়োজনের মধ্যে তার পক্ষে গোগ্রাসে মুখস্ত করে গেলা ছাড়া আর কি করা সম্ভব ? তার আনন্দ কোথায়? তার প্রশ্ন করার সুযোগ কোথায় ?এমনিতেই বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে ঢাকার বিদ্যালয়গুলোতে শিশুর জন্য খেলার কোন মাঠ নেই । রাস্তা থেকেই শ্রেণিকক্ষ শুরু এবং সেখানে তার মাথায় ‘পেরেক ঠুকে’ শিক্ষাদান(!) । এই হলো শিশুর অবস্থা । তারপর আবার পঞ্চম শ্রেণি শেষে বড় আয়োজনে জাতীয় পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজনে শিশুর জন্য সকল আনন্দ-বিনোদন হারাম হয়ে গিয়েছে ।
কাঙাল হরিনাথ ।অনেক বড় কোন শিক্ষিত মানুষ তিনি ছিলেন না ।তবে মানুষ হিসেবে অনেক বড়ই ছিলেন ।তাঁর চিন্তা করার ক্ষমতাও ছিল তাঁর সমান বড় ।গ্রাম বাংলার মানুষের খবর ছাপতেন সেই সেকালে-ব্রিটিশের শাসনের কালে ।তিনি কিছুকাল শিক্ষকতাও করেছিলেন ।সে সময়ে অষ্টম শ্রেণির সিলেবাসে জ্যামিতি যুক্ত করাকে তিনি ‘মাখনের ওপর পাথর ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছিলেন ।তাঁর পক্ষেই এমন বলা সম্ভব কারণ তিনি অসারকে সার ভাবতে পারতেন না , সংকীর্ণতাকে বড় বলে মানতে পারতেন না ।আসল বড়কে তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন ।আজকে তিনি থাকলে বা সেকালেই যদি পঞ্চম শ্রেণির শিশুদের জন্য জীবনের গতি নির্ধারণী এমন এতবড় প্রতযোগিতার আয়োজন দেখতেন তবে তিনি কোন্ উপমা ব্যবহার করতেন আমার কল্পনায় তা ধরা দিল না ।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×