somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডোরেমন প্রজন্মের উদ্বেগজনক বেড়ে ওঠা

০২ রা নভেম্বর, ২০১২ রাত ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুদিন আগে টিভিতে একটি খবরে দেখলাম দশ-বারো বছরের দুটি বাচ্চা অনর্গল হিন্দীতে কথা বলছে। তাদের মুখে ডোরেমন নামের কার্টুনের সংলাপ। এমন সব হিন্দী শব্দ তারা বলে চলছে যে, এর কয়েকটির অর্থও জানা সোজা নয়। অবুঝ এ দুটি শিশু শুধু নয়, আমাদের ঘরে ঘরে প্রায় সকল শিশুর মুখে আজ ডোরেমনের সংলাপ। তাদের চিন্তা চেতনার বিশাল একটা অংশ জুড়ে আজ চেপে বসেছে নমিতা, সিজুকা, ডোরেমন।

আমাদের ছোটবেলায় কার্টুন বলতে একমাত্র সম্বল ছিলো বিটিভির নির্দিষ্ট সময়ে প্রচারিত কয়েকটি কার্টুন সিরিজ যার ভেতর ছিলো থান্ডারক্যাটস, নিনজা টার্টেলস, ডিফেন্ডার্স অব দ্য আর্থ, প্যান্ডা মোনিয়াম ইত্যাদি। সপ্তাহে শুধু শুক্রবারে একদিন দেখতে পাওয়া ব্যাপক জনপ্রিয় কার্টুন ছিলো থান্ডারক্যাটস। এর গান, এর চরিত্রগুলো এবং এর মিউজিক সবই ছিলো আমাদের প্রজন্মের ভীষণ পছন্দের। তবে সে সময়কার শিশু-কিশোরদের বড় একটা অংশ এই কার্টুন দেখতে পেতো না ঘরে টিভি না থাকা এবং টিভি থাকলেও এর প্রচার সময় ভর দুপুরে হবার কারণে। ঐ সময়টা হলো মূলত মানুষের ঘুমের বা একান্ত বিশ্রামের সময়। অনেক মা-বাবাই সে সময়টাতে সন্তানদের বিশ্রাম ছাড়া অন্য কিছুর জন্য অবকাশ দিতেন না। স্কুলের টিফিন টাইমে অন্য বন্ধুর মুখে থান্ডারক্যাটসের গল্প শুনেই এই গ্রুপের শিশুদের চমকৃত হতে হতো।

সপ্তাহে একদিন দেখার জন্যই হোক কিংবা না দেখে বা অল্প দেখে শিশুকাল পার করার জন্যই হোক, সে সময়কার কোন শিশু আদ্যোপান্ত থান্ডারক্যাটস বা অন্য কোন কার্টুন দ্বারা আমূল প্রভাবিত হয়নি। কখনো কোন অলস টিফিন টাইমে স্কেলের ভেতর রাবার ব্যান্ড দিয়ে পেন্সিল বেঁধে থান্ডারক্যাটসের তলোয়ার তৈরী করে খেলা পর্যন্তই ছিলো সে সময়কার কার্টুন প্রভাবের সর্বোচ্চ দৌড়। এখন সময় বদলেছে। শুধুমাত্র কার্টুনের জন্যই বেশ কয়েকটি চ্যানেল আছে যারা বিরামহীনভাবে দেখিয়ে চলেছে ডোরেমন কিংবা বেন টেন জাতীয় কার্টুনগুলো। একদিন-দুইদিন-তিনদিন এভাবে দেখে দেখে আসক্ত হয়ে পড়ছে আমাদের কোমলমতি শিশুরা। ধীরে ধীরে তাদের মন মগজে ঢুকে পড়ছে ডোরেমন, নমিতা, জিয়ান, সিজুকারা। অবাস্তব এক স্বপ্নময় জগত কেড়ে নিচ্ছে তাদের সোনালী সময়গুলোর পুরোটা।

বাচ্চাদের তীব্র আসক্তির রহস্য জানার জন্য ডোরেমনের দু-তিনটি সিরিজ আমি দেখেছি। ডোরেমন নামের এক এলিয়েন নমিতা নামের এক শিশুর সাথে থাকে এবং তাকে নানা সুপার পাওয়ারফুল বস্তু বা ক্ষমতা দিয়ে সাহায্য করে। এর সাথে সেমি ভিলেন সেমি বন্ধু হিসাবে থাকে জিয়ান আর নমিতা-জিয়ানের পার্শচরিত্র হিসাবে থাকে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে-এই হলো মোটামুটি এর সেটিংস। আপাতদৃষ্টিতে এর ভেতর খারাপ কিছু নেই। তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে এর ভেতর এমন অনেক শিক্ষা রয়ে গেছে যা থেকে সহজেই বাচ্চারা ভুল জিনিস কিংবা ভুল বার্তা পেতে পারে। যেমন, স্কুলের পড়া বা হোমওয়ার্কের প্রতি নমিতার বিষোদগার, মায়ের আদেশ না শোনা বা না মানার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে অবাস্তব সুপার পাওয়ারের প্রতি আসক্ত হয়ে ঘোরের ভেতর থাকা ইত্যাদি। উদ্বেগজনক শিক্ষার এই ঘটনাগুলো যদি সামান্য সময়ের জন্য এরা পেতো তাহলে তা অতটা প্রভাব ফেলতে পারতো না। তবে যখন এগুলো প্রতিদিন তাদের মাথায় ঢুকবে তখন তা সবার অজান্তেই তাদের মন মগজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। আর এরকম কার্টুনের প্রভাব যতটা সহজে একটি শিশুর উপর পড়ে, বাবা-মা, শিক্ষক ও অন্য গুরুজনদের উপদেশ ততোটা সহজে প্রভাব ফেলতে পারে না।

প্রতিনিয়ত এসব কার্টুন ছবি দেখার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে আরো বেশ কিছু উদ্বেগজনক ব্যাপার ঘটে যায় আমাদের অজান্তেই। চ্যানেল পরিবর্তনের ফাঁকে ফাঁকে অশ্লীল হিন্দী কিংবা ইংরেজি গান বা ছবির সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা। এক সময় যেসব দৃশ্য বাবা-মা’র সাথে বসে দেখার সুদূর কল্পনাও আমাদের ছিলো না, তার চেয়ে আরো অশ্লীল দৃশ্য আমাদের ছোট শিশুরা নির্বিকারভাবে বসে বসে দেখতে শিখে যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসী এই যুগের এমন নিরব প্রশ্রয় বা উদাসীনতা সামনের সময়ে বীভৎস রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে।

আমাদের সময় আমরা যে সকল কার্টুন বা টিভি সিরিয়াল কালে ভদ্রে দেখতাম সেগুলোর প্রভাব যে আমাদের উপর পড়েনি তা নয়। আমার স্কুল জীবনের পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীর কথা। বন্ধুদের ভেতর একজন হঠাৎ একদিন তার মাথা অদ্ভুতভাবে ছেঁটে ক্লাসে এসে উপস্থিত। তার মাথা সে কামিয়েছে ‘দি এ টিম’ এর মিস্টার টি’র মতো করে। আমরা সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছি আর মজা পাচ্ছে সেও। ক্লাস টিচার ক্লাসে এলে সবাই চুপচাপ হয়ে গেলাম। রোলকল শেষ করে স্যার পড়াতে শুরু করেছেন কি যেন। হঠাৎ সে বন্ধুটির দিকে নজর পড়তেই বললেন, “কিরে, তোর চুলের এই অবস্থা কেন?” সে মাথা নীচু করে নিরুত্তর আর আমরা বাকীরা হিহি করে হাসছি। স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, “চুল এইভাবে কামিয়েছিস ক্যান?” বন্ধুটি এবারো চুপ। কেউ একজন বললো, “স্যার, ও দ্য এ টিমের মিস্টার টি’র মতো কাট দিয়েছে”। স্যার যেন রাগে ফুঁসে উঠলেন। বই রেখে বন্ধুটির কাছে এসে ভয়ংকরভাবে মারতে লাগলেন তাকে। এক পর্যায়ে মারের চোটে ক্লাস থেকে দৌড়ে বেরিয়েই গেলো বন্ধুটি। সেদিন স্যার আর পড়ালেন না। বললেন, “টিভি দেখে সে যদি এটাই শিখে তাহলে এই টিভি ভেঙে ফেলা উচিৎ তার বাবা-মা’র”। পরদিন বন্ধুটি আবার যখন স্কুলে এলো তখন তার মাথা ন্যাড়া। মিস্টার টি’র কোন চিহ্ন আর সেখানে নেই। আমার বন্ধুর এই দ্রুত অনুতাপ ও পরিবর্তনের নেপথ্যে ছিলো আমাদের বাবা-মা ও শিক্ষকদের যথার্থ শাসন।

শিশুরা হলো নরম কাদার মতো। ছোটবেলাতে তাদের যেভাবে গড়ে তোলা হবে, বড় হলে তার ছাপই তাদের জীবনে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। মধ্য প্রজন্মের এই আমাদের বাবা-মায়েরা যথেষ্ট মোরাল দিয়ে আমাদের গড়ে তুলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের আদর ও শাসন দুটোই ছিল যথার্থ। আমরা যারা আজ ছোট বাচ্চাদের বাবা-মা’র আসনে বসে আছি এখন এসেছে তাদের পালা। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই বিপর্যয়কর যুগে যেখানে আমাদের হওয়া উচিৎ ছিলো এসব ব্যাপার নিয়ে আরো অনেক বেশী সচেতন, তখন আমরা সন্তানদের টিভির সামনে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের যতটুকু ভয় পেয়েছি বা সম্মান করেছি আজ আমাদের সন্তানদের থেকে ততটা কেন পাচ্ছি না তার হিসাব মেলানোর সময় এসে গেছে। আমরা যদি এখনো উদাসীন থাকি তাহলে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের জন্য শুধুমাত্র বৃদ্ধাশ্রমের নিষ্ঠুর দরজাই হয়তো খোলা থাকবে।
৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×