‘’আমার প্রিয় বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ, ধরুন...’’
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার জন্য তিথী চর্চা করছিল। একেকদিন একেক শিক্ষক তাদের তত্ত্বাবধান করে থাকেন। আজকেও একজন শিক্ষক আছেন। তিথী যখন তার লেখা বক্তব্যটা একমনে পড়ে শোনাচ্ছিল, এমন সময় ঐ শিক্ষক হঠাৎ তার হাত ধরল। চমকে গিয়ে তিথী বলল,’’ এটা কী করলেন, স্যার?’’
--‘’কেন, তুমিই তো বললে ধরতে। আচ্ছা, বাকিটা পড়ে শোনাও।‘’
তিথী তার বক্তব্যের বাকি অংশ পড়ে শোনাতে থাকে। আসলে এভাবে স্যারের হাত ধরে ফেলার ঘটনাটা নতুন নয়। অমন একটু আধটু স্পর্শ করে থাকেন প্রায় সময়ই। কিন্তু তিথী কিছুই বলতে পারে না। যদি তিনি পরে কোন ক্ষতি করেন? পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেন? কথাগুলো বাবা-মাকেও বলতে ইচ্ছে করে না। বাবা-মা অহেতুক দুঃশ্চিন্তা করবেন। কাজের কাজ তো কিছুই হবে না, উলটো তিথীর আর বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেবেন না। তার চেয়ে, অমন একটু আধটু হয়েই থাকে, ব্যাপারটা মুখ বুজে একটু মেনে নিলেই হয়ে যায়।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়া মেধাবী ছাত্রী বর্ণা । ওর কলেজ পড়ুয়া কাজিন নেহাল সুযোগ পেলেই ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করতে চায়, চুমু খেতে চায়। বর্ণা ওকে বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছে, ‘’মাকে আমি সব বলে দেব।‘’ ১৭ বছরের নেহাল ওর কথাকে কোন পাত্তাই দেয় না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘’পারলে বলো, বলে দাও।‘’ বর্ণার আরো অসহায় লাগে। মাকে কথাগুলো কী করে বলবে? বললে মা কি বিশ্বাস করবে? উলটো বর্ণাকেই আরো বকাঝকা করবে না তো? আর মাকে বললেই বা কী? মা কি এসবের কোন সমাধান করতে পারবে? মা যদি এসব কথা চাচা-চাচীকে বলেন, তারা কি তাদের ছেলের বিরুদ্ধে বলা এসব কথা সহজে মেনে নেবেন? বর্ণাকে কি খারাপ প্রমাণিত করার কোন চেষ্টাই করবেন না? এসব ভেবে বর্ণার কান্না পেয়ে যায়। ওর চোখে পানি দেখলে নেহালের মজা লাগে। নেহাল আবারও ওকে স্পর্শ করতে চায়। বর্ণা হুমকি দেয়, ‘’খবরদার, আমাকে টাচ করবে না! আমি মাকে সব বলে দেব।‘’
‘’দাও না বলে, তোমাকে মানা করেছে কে?’’ বলে নেহাল হাসে। বলি বলি করেও মাকে আর কথাগুলো বলা হচ্ছে না বর্ণার। এসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে করে পড়ালেখাও মন দিতে পারছে না ও ঠিক মত।
এইরকম আরো অনেক তিথী আর বর্ণা রয়েছে, যাদের কথা আমরা কোনদিন জানতে পারি না। আমাদের চারপাশেই রয়েছে ঐ শিক্ষকটির মত কিছু মুখোশ পড়া মানুষ (?), এদেরকেও আমরা কোনদিন চিনতে পারি না। অনেক সময় চিনেও না চেনার ভান করে থাকি। যে নেহালদের এখন সময় ছিল নতুন কিছু ভাবার, নতুন কিছু করার, ওরা এভাবেই উচ্ছন্নে যাচ্ছে। ওদের কেউ মাদকাসক্ত, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, অনেকেই বিকারগ্রস্থ। ওদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেবার মতও নেই কেউ।
তিথী বা বর্ণারা তাদের সমস্যার কথা অকপটে বাবা-মায়ের কাছে শেয়ার করতে পারে না বলেই এ ধরনের ঘটনাগুলো নিশব্দে ঘটতে থাকে আমাদের চারপাশে। ওরা এসব কথা বাবা-মায়ের কাছে শেয়ার করতে পারে না, কারণ বাবা-মায়ের সাথে সহজ সরল সুন্দর বন্ধুত্ব থাকে না। বাবা-মা তাদের সমস্যার সমাধান দিতে পারেন না। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে চান না, তথাকথিত লোকলজ্জার ভয়ে। এভাবেই প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ঐ ব্যক্তিগুলো একসময় হয় উঠে ধর্ষক। এসব পরিস্থিতি কীভাবে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করতে হয়, বাবা-মায়েরা সে শিক্ষা মেয়েদেরকে তো দেনই না, উলটো ওদের আত্নবিশ্বাসটাকে ভেঙ্গে তছনছ করে দেন। অহেতুক দুঃশ্চিন্তা করে মেয়েদের গণ্ডিকে করে দেন সীমাবদ্ধ। মেয়েরা বেড়ে উঠে ভীতু আর দুর্বল হয়ে। নিজেদের ব্যর্থতা মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেন নানা রকম বিধিনিষেধের বেড়াজালে। সাবাস ঠুনকো লোকলজ্জা!
আর এদিকে নেহালদের বাবা-মায়েরা শেখান না মেয়েদের সাথে কিভাবে সম্মানজনক আচরণ করতে হয়। আমাদের এ সমাজে এখনো নারী-পুরুষের মধ্যে পরস্পর শ্রদ্ধাশীল, সুস্থ, মানবিক, বন্ধুত্বপূর্ণ, সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। বাবা-মায়েরা নিজেরা যা চর্চা করেন নি, সেটা ছেলেমেয়েদের কীভাবে শেখাবেন? নেহালেরা বেড়ে উঠছে অন্তঃসারশূন্য হয়ে। এরা শেষ পর্যন্ত কোন কাজেই আসে না, শুধু যৌন বিকৃতি প্রকাশ করা ছাড়া। এরা সবখানে তাদের যৌনবিকৃতি প্রকাশ করতে থাকে। রাস্তায়, ঘরে, মোবাইলে, ফেসবুকে। এরা বিপরীত লিংগের যে কারো সাথেই তাদের বিকৃতি প্রকাশ করতে পারে, সেটা অচেনা কেউ হোক বা সহপাঠিনী, কাজিন, কাজের মেয়ে, মায়ের বয়সী কেউ, বোনের মত কেউ। কাজকর্ম না থাকলে যা হয় আর কি! এদের না আছে খেলার সুযোগ, না আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ। অবশ্য বাবা-মায়েরা নিজেরাই তাদেরকে এসব ঝামেলার কাজে অংশ নিতে অনেক সময় বাধা দিয়ে থাকেন।