somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে এই মাওলানা !!! কি তার পরিচয় ! -৩

২৫ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৬৫ সাল।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এক জরুরী সফরে ঢাকায় এসেছেন। ঢাকার কয়েকটা দিন তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসে থাকবেন। চারিদিকে সীমাহীন ব্যস্ততা। বিশিষ্ট ও সুধীজনরা আসছেন। লৌহমানবের পা ছুঁয়ে সালাম করে যাচ্ছেন।

আজকের সকাল আইয়ুব খানের কাছে একটু ভিন্ন আমেজ বয়ে আনছে। সূচী অনুযায়ী আজকে তার কাছে পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ আলেম সমাজ তাশরীফ আনবেন। তিনিই তাদেরকে সাক্ষাতের আমন্ত্রন জানিয়েছেন।

এ নিয়ে আইয়ুব খান তেমন চিন্তিত নন। আলেমরা নিরীহ প্রজাতির মানুষ। সামান্য হাদিয়া তোহফা দিয়ে তাদেরকে খুশী রাখা যায়। সামনের নির্বাচনে জিততে হলে ঢাকার আলেমদের সমর্থন প্রয়োজন। সেজন্যই আজকের সাক্ষাত অনুষ্ঠান।

তিনি গভর্ণরকে বলে দিলেন, হুজুরদের মেহমানদারীতে যেন কোন বেয়াদবী না হয়। মুনায়েম খান জো হুকুম বলে কাজে তদারকি করতে ব্যস্ত হলেন।

মাওলানা আগে থেকেই আইয়ুব খানের উপর রেগে আছেন। এ অঞ্চলের জাতীয় ইস্যু এবং ইসলাম পাকশাসকদের ধোঁকাবাজি তিনি ধরে ফেলেছেন।

সকাল থেকেই তার কামরায় বসে আছেন ঢাকার কয়েকজন সম্মানিত আলেম। তাদের একান্ত অনুরোধ, প্রেসিডেন্ট যেহেতু ডেকেছেন, আপনি চলুন দয়া করে। আপনাকে ছেড়ে আমরা যেতে পারবো না।

ঢাকার বিশিষ্ট ও মুরব্বী আলেমদের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসে যেতে রাজি হলেন। আলেম প্রতিনিধি দল মাওলানাকে নিজেদের সাথে পেয়ে সাহস অনুভব করলেন। তাদের চেহারায় ও কপালরেখায় প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ত ভাব স্পষ্ট হল।

গভর্ণর হাউসের বৈঠকহল। আইয়ুব খান সবাইতে স্বাগত জানিয়ে আসন গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। তার মন্ত্রী ও আমলারাও এসেছেন আজকের অনুষ্ঠানে। তাদের একটিই কাজ, আইয়ুব খানের কথা মন দিয়ে শোনা।

তাদের চোখে আইয়ুব খান গোটা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, একালের লৌহমানব।

তার মুখের উপর কথা বলা তো দূরের কথা, তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো কইলজা এখনও জন্ম হয়নি, তাদের বাপদাদার কল্পরাজ্যেও এমন বেয়াদবী সম্ভব নয়।

যথাসময়ে আইয়ুব খান তার গমগম গলায় ভাষণ শুরু করলেন। চারিদিকে থমথম পরিবেশ। আলেমরা বসেছেন তার আশেপাশে। নিঃশব্দ নীরবে তারা মহামান্য প্রেসিডেন্টের ইসলামী ভাষণ শুনছেন।

আইয়ুব খান বক্তৃতা করছেন। তার শাসনামলে তিনি ইসলামের জন্য কী কী করেছেন, সেসবের ফিরিস্তি শোনাচ্ছেন।

মুহতারাম হাযেরীন, আমি শোকরগুযার যে আপনারা তাশরীফ এনেছেন। আপনারা জানেন, পবিত্র ইসলামের জন্য আমরা কি কি কুরবানী করেছি। আমরা ......

পূণ্যধর্ম ইসলামের জন্য ফিল্ড মার্শালের এমন খেদমত দেখে কেউ কেউ মারহাবা মারহাবা বলার প্রস্তুতি নিয়ে গলার আওয়াজ সঞ্চয় করছেন।

বড় গলায় মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ বলতে হবে। তারা গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। কোন কোন আলেম ও পীরের মুখে মুচকী হাসির আভাস। তারা বড়ই খোশমেজাজে বয়ান শুনছেন।

খামোশ!!

সবাইকে অবাক করে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন একজন মাওলানা। উপস্থিত সবার চোখ আইয়ুব খান থেকে সরে গিয়ে মাওলানার দিকে নিবদ্ধ হল।

তার চেহারায় ঔদ্ধত্য নেই, আত্মসম্মানবোধের প্রবল বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়েছে তার শান্ত চেহারায়। ইসলামের নামে আইয়ুব খানের মিথ্যাচার দেখে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল।

খামোশ! মাননীয় প্রেসিডেন্ট!! ইসলামের জন্য আপনি কিছুই করেন নি। যা করেছেন, এর সবকিছুই ধোঁকাবাজি। আপনি মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিচ্ছেন। এ অঞ্চলের মানুষের সাথে তামাশা করছেন।

আইয়ুব খান থতমত খেয়ে গেলেন। বলে কি এই মুন্সী! এই জীবনে এমন বিব্রতকর অভিজ্ঞতা তার হয়নি। তার মুখের উপর কথা, তাও আবার প্রতিবাদ। এই মাওলানাকে তিনি চিনতে পারছেন না।

লৌহমানব আইয়ুব্ খান ফুঁসে উঠলেন, হল কাঁপিয়ে চিৎকার করে বললেন,

মাওলানা! আপনি কার সামনে কথা বলছেন খবর আছে? আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, আপনি জানেন? আমি পাঠানের বাচ্চা পাঠান।

মাওলানার গলা এবার আরও উঁচু হল। তিনি গর্জে উঠলেন। আইয়ুব খানের চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন,

আপনার খবর আছে? আমি মুসলমানের বাচ্চা মুসলমান। আমি একা নই। আমাকে একা ভাবলে ভুল হবে। আমার পেছনে আছে দশ কোটি মুসলমান। আপনি সাবধানে কথা বলুন। ধোঁকাবাজি বন্ধ করুন।

বাতাসভরা ইয়াবড় বেলুন ফুটে গেলে পিসসসস করে তার বাতাস বেরিয়ে যায়। মূহুর্তে তা চুপসে যায়। সেদিনের লৌহমানব আইয়ুব খানের অবস্থার বর্ণনার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা এর চেয়ে আর ভালো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাননি।

আইয়ুব খানের চেহারায় ঘাম দেখা দিল। তিনি পানির ঢোক গিললেন।

তারপর গলা নামিয়ে বললেন,
আপনি বলুন মাওলানা! আমি কি কি ধোঁকাবাজি করছি ইসলামের নামে??

আপনি ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট করেছেন ঠিক, কিন্তু তার পরিচালক বানিয়েছেন ইসলামকে বিতর্ককারী এক লোককে। আপনি পূর্ব পাকিস্তনে ইসলামিক একাডেমী করেছেন ঠিক, কিন্তু এখানেও পরিচালক বানিয়েছেন ইসলাম সম্পর্কে বিকৃত ধারণাসম্পন্ন এক নাস্তিককে। আপনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছেন ঠিক, কিন্তু এর জন্য কোন শিক্ষকের পদ রাখেননি। এসব কি করছেন আপনি?

মাওলানার তেজস্বী গলা আর চেহারার গম্ভীরতায় আইয়ুব খান অবাক হয়ে গেলেন।

তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন, শিক্ষামন্ত্রী এটিএম মোস্তফা কোথায়? মুনায়েম খান কোথায়? তাদেরকে ডেকে আনো? মাওলানাকে বোঝাও তোমরা!

এতদিনের লৌহমানবের এমন হায় হুতাশ দেখে মন্ত্রীদের করুণা হল। তারা এটাকে অপমান ভাবলো নিজেদের জন্য। মাওলানার কাছে গিয়ে একজন বলল, আপনি মহামান্য প্রেসিডেন্টের সাথে কি শুরু করলেন হুজুর!

মাওলানা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে কে ডেকেছে? তোমার সাথে কথা বলার জন্য তো এখানে আসিনি আমি। যাও, এখান থেকে!!

আইয়ুব খান কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কপালে বিন্দু বিন্দু জমা ঘাম মুছছেন তিনি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের এ অসহায় দশা ও মাওলানার হাতে ধরা খাওয়া দেখে বৈঠকের একজন মুনাজাত শুরু করলেন।

মাওলানা সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। সশস্ত্র প্রহরীরা দূরে সরে তাকে পথ করে দিতে বাধ্য হল।

আইয়ুব খান মুনাজাতের জন্য হাত উঠিয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে মাওলানার চলে যাওয়া তাকিয়ে রইলেন।
..........

খুব সংক্ষেপে বলছি, পরের বছর আইয়ুব খান অনেক কৌশলে এ মাওলানাকে ডেকেছিলেন।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, নির্বাচনের সময় মাওলানাকে তার পাশে পাওয়ার জন্য তিনি তৎকালের ‌‌১০ লাখ রুপীর চেক সসম্মানে মাওলানার পকেটে তুলে দিয়েছিলেন।

এক ঝাটকায় তিনি ঐ চেক প্রেসিডেন্টের টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে এসেছেন।

এমন আরও অবিশ্বাস্য দৃশ্য ঘটেছে তার জীবনে...........সেসব তুলে ধরা হবে অন্যান্য পর্বে।

..................................................
আজ থেকে আমার ছুটি। তাই সকাল থেকে নতুন দু পর্ব লিখলাম। তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই এবং তারপর লেখা, কিছু সময় লাগছে।

আগামীকাল কাতারে ঈদ। সব ব্লগার ও পাঠকবন্ধুদেরকে মরুর এ দেশ থেকে আরবীয় ঈদ মুবারক। আগামীকাল শুক্রবার এখানে ঈদ করে রাতে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা হব। শনিবার ঈদের দিন সকালে ঢাকায় নামব।

দুই দেশে পরপর দুই দিন কুরবানীর ঈদ করার এক দারুণ অভিজ্ঞতা আমার জন্য অপেক্ষমান। সবার জন্য শুভ কামনা।


এই ধারাবাহিকের ২য় পর্ব ......

প্রথম পর্ব....................
২১টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×