somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড় ও আমার ঈদের পাঞ্জাবীর গল্প

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঈদের নতুন পাঞ্জাবীটা পড়েছি, কনকনে শীতের সকালের রোদটা গায়ে লাগাবো বলে, সেই দুরের রাস্তায় দাড়িয়ে আছি। তখনও ঈদের জমায়েত শুরু হয়নি, বাবা ও বাড়ির বড়দের জন্য অপেক্ষা করছি। ছেলেবেলার সমবয়সী বন্ধুরা যার যার বাবার কনিষ্ঠ আঙ্গুলের মুষ্টিবদ্ধে পায়ে পায়ে ঈদগায়ের দিকে হেঁটে চলছে। ঈদের সকালটাই যেন কেমন, সম্পুর্ন অন্য রকম। শুভ্র, শান্ত ঈদের এই দিনটাতে, মনে হয় যেন, নতুন একটি দিনের পুনঃজনম হয়। যেন চারিদিকে উল্লাস, উচ্ছ্বাস আর আনন্দের বন্যায় মুখরিত হয়ে উঠে।

দীর্ঘদিন পর মিয়া-ভাই বাড়ি এসেছেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সেই যে কোথায় চলে গেলেন। দীর্ঘ প্রায় বারটি মাস পর বাড়ি ফিরেছেন। সাথে করে কত্তকি যে নিয়ে এসেছেন। সবার জন্য অসম্ভব অসম্ভব সব দামী জিনিষ। এর আগে, কোন ঈদের সময় আমরা এত এত জিনিষ কখনও পাইনি। মিয়া ভাইয়ের বাড়ি ফেরা তাই আমাদের জন্য বাড়তি এক উল্লাস আর আনন্দের কারণ হয়ে রইল।

কিন্তু কোথায় গিয়েছিলেন মিয়া-ভাই? খুব ছোট ছিলাম বলে বুঝতেও চেষ্টা করিনি। তবে মিয়া-ভাই যেদিন চলে গেলেন সেদিনের সেই ক্ষণটা খুব মনে আছে। তিনি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পূর্ব থেকেই, আমাদের বাড়িতে, বেশ উৎসব উৎসব আমেজ ছিল। মন কয়েক রসগোল্লা এনে বিলিও করেছেন পাড়া-মহল্লায়। মানুষের মুখে মুখে বলাবলি হয়েছে, আহা, এমন চাকরী কজনের ভাগ্যে জোটে! মিয়া-ভাইয়ের এয়ারফোর্সের সেই চাকুরীটা পাওয়ার পর ধীরে ধীরে বাবার কাঁধের উপর বোঝাটাও অনেক কমতে শুরু করল।

দীর্ঘদিন পর মিয়া-ভাই বাড়ি এসেছেন তাই এই ঈদটা আমাদের জন্য অবশ্যই অন্য রকম। তাছাড়া আমাদের নতুন নতুন জামাকাপড়। অনেকগুলো একটাকার কচকচে, চকচকে নোট। আর আমার ভাবটাই অন্য রকম। কারণ আমি সবার ছোট ভাই বলে, আমার প্রতি মিয়া-ভাইয়ের এক বিশেষ মনোযোগ। সেই ঈদে কত্তকি যে পেয়েছি, সব মনে করতে পারছিনা। তবে ডোরাকাটা বাঘের দাগের উপর নকশী করা পাঞ্জাবী আর নকশী করা বিদেশী টুপি পেয়ে আমি যেন হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছিলাম।

শীতের সকালে সেই যে ঈদের জামাতের জন্য দুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। বেশ ভালই লাগছে। বন্ধুরা সবাই আমাকে অন্য রকম দাম দিচ্ছে। দামী বিদেশী পাঞ্জাবী আর টুপি। শরীরে চমৎকার আতরের গন্ধ আর পকেট ভর্তি চকচকে একটাকার নোট। কিন্তু তখনও বুঝিনি এই চকচকে নোটগুলোই আমার ঈদটা মাটি করে দিবে।

আমার ছেলেবেলায় এলাকার বড়ভাইরা, সবাই দল বেঁধে সিনেমা হলে গিয়ে মুভি দেখার একটা রেওয়াজের মত ছিল। এখনকার মত ঘরে ঘরে তখন তো আর স্যাটেলাইট, টিভির ব্যবস্থা ছিলনা। তাই ঈদের নামায পড়ে, দল বেঁধে সবাই মুভি দেখতে চলে যেত। আর আমরা ছোটরা অপেক্ষা করতাম, কখন বড় ভাইরা এসে মুভির সেই গল্পগুলো বলবে।

কিন্তু এই ঈদটা আমার জন্য সবদিকেই একটু ভিন্নতা নিয়ে এলো। আমিও প্রথমবারের মত, সিনেমা কক্ষে গিয়ে, মুভি দেখতে চলে এলাম। আকতার নামে এলাকার এক বড়ভাই আমাকে বলল, যাবে নাকি মুভি দেখতে? আমি বললাম, না না, আমি যাবনা। কিন্তু তখনও বুঝিনি যে আমার চকচকে টাকার উপর তাঁর নজর পড়েছে। সে বলল, চলো চলো খুব মজা পাবে। এই সেই বলে, আমাকে বাগিয়ে ফেলল। তারপর পরের ঘটনাগুলো আমার জন্য বিশাল ইতিহাস। আমার কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে আকতার ভাই তাঁর কাছে রাখলেন, বললেন, এগুলো আমার কাছে থাক। তোমার কাছে থাকলে হারিয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করে তাঁর কাছে টাকাগুলো দিলাম।

আকতার ভাই আমাকে এই কিনে দেন, সেই কিনে দেন। কোকাকোলা, ফানটা, বিস্কুট, হাওয়াই মিঠাই আরও কতকি। আমি মনে মনে ভাবলাম, আমি এক রাজপুত্তর। কিছুক্ষণ পর আকতার ভাই একটি সিগারেটের প্যাকেট কিনলেন। সিগারেটের নামটা এখনও আমার মনে আছে, “পুর্বানী”।

সিগারেট কিনে তাঁর কি যে ভাব। একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সিগারেটের প্যাকেটটাই শেষ করে ফেললেন।

এখনও সিনেমার টিকেটের বুথ খুলেনি। আমরা বেশ আগেই চলে এসেছি। মুভি শুরু হবে বারটা থেকে। তাই এতক্ষণ কি করি। আকতার ভাই আমাকে নাগর-দোলায় তুলে দিলেন। আমি ভয় পেয়ে সেকি কান্না। আমি বললাম, আমি আর থাকব না। বাড়ি চলে যাব। আসলে সেই সকালে, না খেয়ে এসেছি, প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে। তাছাড়া বাবা, মাকে ছেড়ে কখনও কোথাও যাইনি তো, তাই মনটাও খুব খারাপ লাগছিল। আকতার ভাই আমাকে বাটারবান আর একটি পেপসি কিনে দিলেন। বাটারবান আর পেপসিটা খাওয়ার পর, পেটটা একটু শান্ত হতেই, আমারও একটু ভাল লাগল। কিন্তু আমি তখনও বুঝিনি, দেবতার ফুলেই দেবতাকে খুশী করানোর জন্য এই পুজো-ভোগের ব্যবস্থা হচ্ছে।

এরই মধ্যে সিনেমার বুথ খোলা হোল, আর আমি সব ভুলে গেলাম। মুভি দেখতে বসেছি। খুবই এক্সাইটেড, ঢিসুম ঢিসুম সিনেমা টাইপসের একটি মুভি, মুভির নাম ‘বন্দুক’।

পাত্র-পাত্রীর নাম এখন আর মনে নেই। তবে মনে আছে বন্দুক নিয়ে ডাকাতি টাকাতির কাহিনী টাইপসের মুভি।

মুভি শেষে বাড়ি এসেছি, এসেই তো মহাকাণ্ড দেখতে পেলাম। চারিদিকে আমার জন্য মাইকিং হয়েছে।দুর দূরান্তে লোক খুঁজতে গেছে। আমাদের পরিবারের ঈদ আর ঈদের মত নেই। মা আমাকে পেয়ে যেন পাগল হয়ে গেলেন। হাজারো প্রশ্ন, কোথায় গেছি? কেন গেছি? কার সাথে গেছি? কি খেয়েছি? মায়ের হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত। আমি আঙুল দিয়ে আকতার ভাইকে দেখিয়ে দিলাম। আর আকতার ভাই যায় কোথায়। মিয়া-ভাই আকতার ভাইকে কান ধরিয়ে, ঘণ্টা-দুয়েক দাড় করিয়ে রাখলেন।

ঈদের দিন বিকেলে বড়রা সবাই দাড়িয়াবাঁধা খেলছে। অনেক দর্শক, আমিও দর্শক হয়ে খেলা দেখছি। আর এরই মধ্যে আমি ও বন্ধুরা মিলে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছি। ঘেমে গেছি বলে, পাঞ্জাবীটা পাশেই রেখে বিশ্রাম নিচ্ছি।

আমাদের এলাকার একলোকের একটি অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড় ছিল। বিশাল সেই ষাঁড়কে দেখাশুনার জন্য কয়েকজন লোক নিয়োগ ছিল। হঠাৎ দেখি, সেই ষাঁড়টা আমাদের দিকে ধ্যেয়ে ছুটে আসছে। আর আমরাও সবাই পালিয়ে, দে ছুট। কিন্তু আমার পাঞ্জাবীটা ওখানেই পরে রইল। ষাঁড়টা আমার পাঞ্জাবীর কাছে এসে, জিহ্বার টানে পাঞ্জাবীটা মুখে তুলে নিয়ে জাবড় কাটিতে কাটিতে থেমে গেল। যে লোকগুলো ষাঁড়টাকে দেখাশুনা করছিল, এরই মধ্যে ওরা এসে পাঞ্জাবীটা কেড়ে নেয়ার জন্য সবাই চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আমার বিদেশী পাঞ্জাবীর শেষ রক্ষা আর হলনা। ‘আমার পাঞ্জাবী, আমার পাঞ্জাবী’ বলে, কাঁদতে কাঁদতে, আমি বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:৪৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×