somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাওয়া না পাওয়ার ঈদ

২০ শে অক্টোবর, ২০১২ সকাল ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাতিসংঘ শান্তি মিশন হঠাত করে বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের সোমালিয়া থেকে পালিয়ে আসতে হচ্ছিল। পালিয়ে আসার কথা বলছি এ কারণে যে মিশন শেষ হবার খবর চাউর হতেই বিদ্রোহীরা এয়ার পোর্ট এবং আশে পাশের এলাকা দখল করে নিয়ে ছিল। আমাদের উপর সোমালীদের পূর্ণ আস্থা থাকলেও তারা ঘৃণা করত মার্কিনীদের। ১৯৯৫'র ফেব্রুয়ারিতে US Marine ২য় বারের মত মোগাদিসু বন্দরে নোঙর ফেলার সপ্তা’ দুয়েকার মধ্যেই বহুজাতিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এয়ারপোর্ট। বিমানের বদলে আমরা US Marine এর নিরাপত্তা প্রহরায় একটি ছোট্ট জাহাজে মোগাদিসু ত্যাগ করি। সোমালিয়ায় পরদিন ঈদ। তার মানে বাংলাদেশে ঈদ হতে আরও দু’দিন বাকী। বিদ্রোহিদের বৈরিতা, জীবনের প্রথম সমূদ্র যাত্রার সম্ভাব্য বিপদ, সাঁতার না জানার ভয় সব ছাপিয়ে দেশে ফিরে আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদ করাটাই মুখ্য হয়ে ঊঠেছে। আমাদের সমূদ্র যাত্রা শেষ হবে তাঞ্জানিয়ার দার এস সালামে। সেখান থেকে আকাশ পথে ঢাকা।

সূর্য ওঠার আগেই নোঙ্গর তুললো আমাদের জাহাজ। দার এস সালাম তাঞ্জানিয়ার রাজধানি আর পূর্ব আফ্রিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর। যাত্রা পথে আমাদের ছুঁয়ে যেতে হবে মোম্বাসা, জাঞ্জিবারের মত সব ট্যুরিস্ট স্পট। মোগাদিসুর দক্ষিনে প্রায় দেড়দিনের দূরত্বে (১২০০ কিঃ মিঃ) দার এস সালাম। কাজেই যাত্রা পথে সাগরের বুকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগ পাওয়া গেল, সেই সাথে রইলো স্বজনদের সাথে ঈদ করার সম্ভাবনা। সব মিলিয়ে হঠাত করেই দারুন এক সমুদ্র যাত্রা শুরু হল আমাদের।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্র যাত্রার ভীতি কেটে গেল। কক্সবাজারে দেখা বঙ্গোপসাগরের ঢেঊএর তুলনায় ভারত মহা সাগরকে প্রায় নিস্তরঙ্গ লাগছিল (এই অনুভূতি আমার পরবরতীতে আটলান্টিকের পাড়ে গিয়েও হয়েছে)। নিচের দিকের কেবিনে আমাদের বেশ কয়েকজন সহযাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেও অন্যদের চোখে মুখে ছিল আনন্দের ছাপ। সেদিন আমাদের ৩০ রোজা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাঞ্জানিয়া পৌছাতে পৌছাতে পরদিন সন্ধ্যা। হিসাব অনুযায়ী জাহাজেই আমাদের ঈদ শুরু হবার কথা। অনেকেই চিন্তায় পড়ে গেলেন ঈদের জামাত নিয়ে। জাহাজে ঈদের জামাত হয় কীনা সে বিষয়েও বিস্তর আলোচনা শোনা গেল। আর আমদের অনেকি ভাবছিলাম পর পর দুই দিনে দুই দেশে ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতাও মন্দ হবে না।
মাঝরাতে জাহাজ ভিড়লো মোম্বাসায়। রি ফুয়েলিং কিম্বা অন্য কোন বিষয়। যাত্রীদের নামতে দেওয়া হল না। নেমে খুব একটা লাভও হত না। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি এত রাতে নাইট ক্লাব ছাড়া অন্য কিছু খোলা থাকে না। মোম্বাসার সাফারি পার্ক কিম্বা কুমিরের খামার মাম্বা ভ্যালি তো খলা থাকার প্রশ্নই আসেনা। দুই আড়াই ঘন্টা পর আবার যাত্রা শুরু হল। চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে কাটালাম বাকী রাত।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। দেশে না গেলেও সত্যিকার অর্থেই আজ আমাদের ঈদ। একটা মাস রোজা রেখেছি ঈদের কথা ভেবে, হোক না সে অন্য দেশে অন্য কোথাও। তাই বলে জাহাজে !
ঈদের সকালের যে আলাদা একটা মজা থাকে, তার কোন কিছুই নেই এখানে। ছোট বেলার ঈদের কথা আমি ভুলতে পারি না। প্রতি ঈদের দিনই আমার ছেলে বেলার কথা মনে হয়। আমাদের ৯ জনের সংসার। ছেলেরা সবাই কল পাড়ে ভিড় করছে । আব্বার হাতে মোড়ক খোলা নতুন সাবান, নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য ছুঁয়ে যাচ্ছে যশোর শহরে আমাদের বাসার উঠোন, কল পাড়। আমরা ছোটরা শীত উপেক্ষা করে ধোয়া ওঠা গরম পানির হাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। কে, কার আগে গোসল করবে সেই প্রতিযোগিতা। ( আমার শৈশবে বেশির ভাগ ঈদই হত শীত কালে। ১৯৭১ এ ঈদ হয়ে ছিল ২১ এ নভেম্বর, তার মাত্র সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি ৮ বছরের হলাম) ।

মন খারাপ করা সকালটা হঠাত করেই বদলে যেতে লাগল একটু একটু করে। ভারত মহা সাগরে একটা চমতকার সূর্যোদয় দেখে মন ভাল হয়ে গেল অনেকটাই। আকাশে মেঘ আর সাগরে কুয়াশা না থাকায় সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ। ব্রেক ফাস্টের সময় জাহাজের কয়াপ্টেন এলেন ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে। ভদ্রলোক তাঞ্জানীয় মুসলমান। জাহাজে জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে দেশে ঈদ করতে পারেন নি গত দুই বছর। এবার যদিও দেশে ফিরছেন ঈদের দিন, তবে বৌ বাচ্চার কাছে কাছে পৌছাতে পৌছাতে মাঝ রাত হয়ে যাবে।

আমরা যখন জাঞ্জিবার পার হচ্ছি সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আফ্রিকার ট্যুরিস্ট স্পট গুলির অন্যতম জাঞ্জিবার আইল্যান্ড। জাহাজ থেকে অপরূপ লাগছিল দ্বীপ দেশটিকে।। পেছনে কিলিমাঞ্জারো পাহাড় দ্বীপের সবুজ বনানী আর সামনের নীল সমুদ্র এই দ্বীপটিকে করে তুলেছে অনন্য। যারা পাহাড়, সমুদ্র, সাফারি পার্ক পছন্দ করেন। সারফিং করে কিম্বা মাছ ধরে অবসাদ কাটাতে চান তাদের জন্য আদর্শ হলিডে স্পট জাঞ্জিবার।
দার এস সালাম পৌছাতে পৌছাতে তাঞ্জানিয়ায় ঈদের উৎসব প্রায় শেষ। রাত বেজে গিয়েছে ৯টা। আমাদের দুর্ভোগেরও শুরু তখন থেকেই। তাঞ্জানিয়া আমাদের মতই উন্নয়নশীল দেশ। বিদ্যুৎ এর যাওয়া আসা তাদের নিত্যকার সমস্যা। লোডশেডিং এর কারণে প্রায় কিছু না দেখেই সমুদ্র বন্দর থেকে বাসে চরে এয়ারপোর্ট এলাম। এয়ারপোর্টে নিয়মিত যাত্রীর ভীড়, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদি কারণে আমাদেরকে সারারাত এয়ারপোর্টে কাটাতে হল। লাঊঞ্জে নয়। এয়ারপোর্ট বিল্ডিং এর লাগোয়া দুটি ছোট্ট ঘরে শ’দেড়েক লোক কিভাবে কাটিয়েছিলাম এত দিন পর মনে করতে পারছি না। তবে খুব একটা গায়ে লাগেনি একটি কারণে। ভোর ৬টায় ছাড়বে আমাদের প্লেন তার পরে ৬ ঘন্টায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে তখন বিকেল ৩টা। ঈদের অর্ধেকটাই বাকী। তাড়া হুড়োয় যদিও উপহার কেনা হয়নি কারো জন্যেই, তবুওতো ঈদের দিন ঘরে ফেরা! এয়ারপোর্টে প্রিয়জনের মুখই বা উপহার হিসাবে কম কী?
এসব চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটলো আমাদের। সকাল ৫টায় খবর এল প্লেন ছাড়তে দেরি হবে। একটু দমে গেলেও হতাশ হলামনা আমরা। প্রবাস জীবনে দীর্ঘ দিন অভ্যস্ত হবার আগ পর্যন্ত বাঙালিরা ছোট খাটো সময়ের হেরফেরে বিচলিত হয় না। ৭টা বেজে গেল, প্লেন এলো না। এ সংক্রান্ত খবরও পাওয়া গেলনা। ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করতে থাকলো আমাদের কে। উতকন্ঠিত হয়ে পড়লাম আমরা সবাই। ৮টার সময় জানাগেল চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলে পড়েছে আমাদের ফ্লাইট স্কেজ্যুল। আমাদের ফেরার কথা জাতিসংঘের ভাড়া করা বিমানে। চুক্তি অনুযায়ী লেবাননের বিমান এসেছিল আমাদের জন্যে। সন্ত্রাসবাদীদের সাথে লেবানন সরকারের আঁতাতের অজুহাতে বিমানটিকে অবতঅরণ করতে দেওয়া হয়নি।

আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়তে লাগলাম। সোমালিয়া ছাড়ার আগে শেষবারের মত ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। Zia International Airport এ অপেক্ষা করছে আমার স্ত্রী দীপা। আমার মত অবস্থা আরও অনেকেরই। বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা করা হচ্ছিল পরিস্থিতি অনুকুলে আনার। সমস্যার সমাধান হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত প্লেন ছাড়ল বিকেল সাড়ে তিনটায়। বাংলাদেশে ততক্ষ্ণে সন্ধ্যা নেমে গেছে।

আমরা ঢাকায় পৌছলাম রাত একটায়। ঢাকা শহরে তখন ঈদ বুড়িয়ে গেছে। দীপার মত অনেকেঈ এয়ারপোর্ট থেকে ফিরেছে চোখের পানি মুছতে মুছতে। দেড়টার দিকে বাসায় পৌছে দেখি বাতি জ্বলছে আমাদের ঘরে। আমাকে দেখার পর দীপার কান্না ভেজা চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও বিষাদ থেকে ধীরে ধীরে ফুটে ঊঠলো আনন্দ উচ্ছাস। এতদিন পরও হাসি কান্নায় মাখামাখি সেই মুখটাকেই মনে হয় ঈদের সেরা উপহার।




সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ ভোর ৫:৩৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×