পড়ন্ত বিকেল ।সন্ধ্যাটা যেন তাড়াতাড়িই ঘনিয়ে আসছে ।চারিদিক অন্ধকারে ছেঁয়ে যাচ্ছে ।অবশেষে দিনের শেষ ট্রেনটি এসে থামল পরীর গাঁ স্টেশনে । চারপাশ একবার চোখ বুলিয়ে ট্রেন থেকে নামল সাগর ।ঠান্ডা হাওয়ায় ঝাপটা সামলিয়ে গায়ের চাদরটিকে আরো ভালভাবে জঁড়াল । গাছগাছালির মিষ্টি সুবাসে বাতাস খানিকটা ভারি ।যাত্রী কক্ষ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ।যাত্রীকক্ষের সামনের বেঞ্চটিতে শরীর এলিয়ে দিল সাগর । তার পাশেই পুরনো জং ধরা একটি সাইনবোর্ড ।তাতে লিখা "পরীর গাঁ স্টেশন" ।পরীর গাঁ এর স্টেশন এটি ।পরীর গাঁ নামটির পিছনে ছোট্ট কাহিণী রয়েছে ।এই কাল্পনিক কাহিণীটি গ্রামের মানুষের মুখে মুখে আজো অক্ষত আছে ।. . . .
"অনেক বছর আগে পাশের গ্রামের এক রাখাল রোজ তার মনিবের গরু নিয়ে এই গ্রামে আসত ।এই গ্রামটি ছিল তখন জনমানবহীন এক অরণ্য ।রাখাল এখানে ছোট কুটির তৈরি করেছিল । এই কুটিরটিতে সে বিশ্রাম নিত ।মাঝে মাঝে রাতও কাঁটিয়ে দিত ।তেমনি এক রাতে সে এক গাছের গুঁড়ির উপর বসে বাঁজাচ্ছিল ।সে বাঁশির করুণ সুর নিস্তব্দ রাতের বাতাস চিরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল ।দূরের আকাশ থেকে তখন মাটিতে ঘুরতে নেমেছিল কিছু পরী ।বাঁশির করুণ সুর শুনে এক পরী দল থেকে বেরিয়ে আসল ।হঠাত্ রাখালের সামনে এসে দাঁড়াল সে পরী ।চোখে আলোর ঝলকা লাগতেই চোখ মেলে তাকিয়ে বিষম খেল রাখাল ।অসম্ভব রূপবতী ডানাওয়ালী যে মানুষ নয় তার বুঝতে দেরি হল না ।সে অজ্ঞান হয়ে গেল ।যখন জ্ঞান ফিরল ,দেখল পরীটি হাত ধরে পাশে বসে আছে । অবাক লাগল তার ,এখন বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছেনা তার ! সে থেকেই বন্ধুত্ব ।এমন নির্জন রাতে তাদের প্রায়ই দেখা হত ।রাখালের বাঁশির মধুর সুর শুনত ।একদিন কাউকে কিছু না বলে রাখাল পালিয়ে আসে এই অরণ্যে ।এখানে তারা ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করে ।সে থেকেই গ্রামের নাম পরীর গাঁ । গ্রামের মানুষের ধারণা এই কারণেই এই গ্রামের মেয়েরা সুন্দরী হয় !! . .
-"বাবা এসেছ ?" বৃদ্ধের কন্ঠে ঘোর ভাঙল সাগরের ।
- আসসালামুআলাকুম চাচা ,কেমন আছেন ?
- ওয়ালাইকুম আসসালাম ,কত বড় হয়ে গেছ ! আমাকে চিনতে পেরছ তো ?
- কেন চিনব না চাচা !বৃদ্ধ হাসলেন ।
এই সেই করিম চাচা ,যাকে নিয়ে ছোটবেলায় বন বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াত সাগর ।বৃদ্ধ হয়ে গেছেন ।মুখে অসংখ্য ভাঁজ পরে গেছে ।খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন ।
- চল বাবা ,গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ।
- চলুন ।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে গরুর গাড়িতে উঠে বসল সাগর ।গরুর গাড়ি ভাঙা রাস্তার উপর দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে যাচ্ছে ।পনের বছরে কত কিছুই না পাল্টে গেছে ।চারপাশে তাকিয়ে বুঝল খানিক আগেই বৃষ্টি এসে সবকিছু ধুঁয়ে গেছে । মাটি ,গাছগাছালি ও বর্ষার ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে লাগছে ।বর্ষায় গ্রামের প্রকৃতিটাই অদ্ভুত লাগে ।বৃষ্টি যেন প্রকৃতিকে এক নেশার জালে মাতিয়ে গেছে ।এই ভর সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই লাইনটি মনে পড়ে গেল -
"বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা ।"
__________________________
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ডায়েরি নিয়ে বসল সাগর ।. ...
"এখন রাত ৯টা ।গ্রাম্য পরিবেশে এখন অনেক রাত ।চারিদিকে নিকষ আঁধার ।জানালা দিয়ে আসা রাতের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা সারাদিনের ক্লান্তিকে যেন ভুলিয়ে দিচ্ছে ।
পনের বছরে বহু কিছু পাল্টে গেছে ।তবুও কেন জানি মনে হয় ,পরীর গাঁর রূপ এখনো পরীর মতোই আছে ।বর্ষা যেন সমস্ত গ্রামকে নতুন রূপ দিয়েছে ।গ্রীষ্মের সকল ক্লান্তিকে যেন ধুঁয়ে দিয়ে দান করেছে স্নিগ্ধতা ।
আহ !প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি নামল আবার ।বৃষ্টির ঝাপটা আসছে জানালা দিয়ে ।সাথে ঠান্ডা হাওয়া ।
রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি অবচেতন মনে বাঁজছে. . .
তুমি যদি দেখা না দাও
কর এমন হেলা ,
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল বেলা ।"
এতটুকু লিখে ডায়েরি বন্ধ করল সাগর ।
-"বাবা ,জানালা বন্ধ করে দিই ?" করিম চাচা পাশে এসে দাঁড়ালেন
-জ্বি চাচা ,দিন্ । জানালা বন্ধ করতে মনে হয় খানিকটা কসরত করতে হয়েছে তাকে প্রচন্ড বেগে বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে ।
-আমি তোমার বিছানা গুছিয়ে দিয়েছি ,শুঁয়ে পর ।আমি নিচে শুব ।কোনো অসুবিধা হলে ডেকো ।
-ঠিক আছে ।
চাদর মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুঁয়ে পরল সাগর । হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেল ।কান্নার ক্ষীণ শব্দ আসছে বাইরে থেকে ।মেয়েলী কান্নার শব্দ ।কে কাঁদছে এত রাতে !
-চাচা ! চাচা ! ঘুমিয়েছেন ?
-"জ্বি ,জ্বি বল বাবা !" হতচকিয়ে উঠে বসলেন ।
-কে কাঁদছে এত রাতে ?
-কই ! -ঐ যে মেয়েলী কান্নার আওয়াজ !
-"ও ,পরী পাগলী কাঁদে ।" খানিকটা দম নিলেন করিম চাচা ।
-পরী ?
-"তোমার মনে নেই ? ছোটবেলায় একবায় যাকে গাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছিলে ।" চাচা হাসলেন ।
মাথায় যেন বাজ পরল ।পরী ! যাকে নিয়ে সারাদিন দুরন্তপনায় মেতে উঠত ।মাঠে মাঠে ছুঁটে বেড়াত ।বয়সে কয়েক বছর ছোট ছিল বলে মাঝে মাঝে চড় থাপ্পর দিয়ে শাসন করত ।যখন মেয়টা কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরত খুব মজা পেত ।কিন্তু আবাক লাগত কখনো নালিশ করেনি !শেষবার যখন গ্রামে এসেছিল পশ্চিমে বাগানে ছোট এক কামরাঙা গাছে উঠেছিল দু'জন ।একটা পাকা কামরাঙা কে আগে নিতে পারে এমন এক ছেলেমানুষি খেলায় তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় ।বেচারির এক হাত ভেঙে যায় ।সেবার তাকে পিতার কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল ।এরপর আর গ্রামে আসা হয়নি ।স্কুল জীবন শেষ হল ,কলেজ জীবন এরপর মেডিকেল ।ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করল অবশেষে ।মাঝখানে ভুলেই গিয়েছিল শৈশবের এই স্মৃতিগুলো । উঠে বসল সাগর ।
-ও তো পাগল ছিলনা ।এমন হলো কিভাবে ?
-সে অনেক কথা ! -বলুন চাচা ।আমি শুনব ।
করিম চাচা গলা খাকঁরি দিয়ে বলা শুরু করলেন ।..........
-মেয়েটার জন্য পাশের গ্রাম থেকে একটা ভাল প্রস্তাব এসেছিল দেখে অল্প বয়েসেই ওর বিয়ে হয়ে যায় ।কিছুদিন সুখেই ছিল ।এক বছর পর ওর কোলে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান ও আসে ।হঠাত্ ওর স্বামী ব্যবসায় মার খায় ।তখন সে পরীকে বাপের বাড়ি থেকে লাখ খানেক টাকা আনার জন্য জোর করতে লাগল । পরী জানে তার বাবার আর্থিক অবস্থা কেমন ! একটুকরো জমি যাতে চাষবাস করে খার ,আর একটুকরোতে মাথা গুঁজে থাকে ।যখন পরী রাজি হত না ,খুব মারধোর করত ।একদিন ঘর থেকে বের করে দেয় ।আর তার কয়েক মাসের বাচ্চাকে ওরা রেখে দেয় ।
-তারপর ?
-তারপর আর কি ? ও চলে আসে ।কিছুদিন কথা বলেনি বোবার মত হয়েছিল ।কিছুই বলেনি কি হয়েছিল ।এরপর পুত্র শোকে পাগল হয়ে যায় ।অনেক ঝাঁড়-ফুঁক করেছিল ।কোনো লাভ হয়নি ।
-শহরে নিয়ে কোনো ডাক্তার দেখায়নি ?
-কিভাবে ?নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ওদের ।ওর বাবা জমিল মিয়া পরের বাড়িতে কামলা খাঁটে ।
-ওহ ! আচ্ছা চাচা আপনি ঘুমিয়ে পড়েন । আবার শুঁয়ে পরল সাগর ।তন্দ্রাভাবটুকু আর নেই ।খুব খারাপ লাগছে তার ।পরীর জন্যে! ...................................................................................................
খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেল সাগরের ।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব ।উঠে বিছানায় বসল । ঘরে এসে ঢুকলেন করিম চাচা ,মুখে মৃদু হাসি । -উঠেছ বাবা ? -জ্বি চাচা । -যাও হাত মুখ ধুঁয়ে আস ।টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছে । -আচ্ছা । নাশতা করে বেরিয়ে পড়ল সাগর ।বাড়ির উঠোন পেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল ।পাশের বাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় ছোটখাট জটলা দেখে দাঁড়াল ।খানিকটা কাছে গিয়ে দেখল একটা মেয়েকে ঘিরেই এই জটলা ।মেয়েটি অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে ।লম্বা উস্কখুষ্ক চুল ।পরনের শাড়িটা নানা জায়গায় ছিঁড়ে গেছে ।বুঝতে বাকি রইল না যে এই সে পরী ! ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল ।পরীর ঠিক সামনে গিয়ে অবাক হল সাগর ।পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে ।কে বলবে এ পাগল !ফরসা মুখ খানিকটা মলিন হয়ে গেছে ।গালের উপর অশ্রুর গাঁঢ় দাগ পরেছে ।তবুও যেন মায়ার এতটুকু কমতি নেই ।চোখগুলো বড়ই শান্ত ,নিচে কালি পরে গেছে ।কালো মণিটির দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই নেশা ধরে যায় । এ তো পরীই ! পরী ছোট একটা পুটলিপে কোলে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করছিল ।কথাগুলো অস্পষ্ট তাই বুঝা গেল না । সাগরকে দেখে জটলার মধ্যে খানিকটা গুন্ঞ্জন উঠেছে ।
এক বৃদ্ধ এগিয়ে আসল ।
-কে তুমি বাবা ?
-আমি সাগর ।পাশের ওই বাড়িটা আমাদের ।ঢাকা থাকি ,বেঁড়াতে এসেছি ।
-"ও তুমি বড় সাহেবের ছেলে ।সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম ।কত বড় হয়ে গেছ !" বৃদ্ধের মুখে স্মিত হাসি ।
-এস বাবা ,ঘরে এস ।
ঘরে যাওয়ায় ইচ্ছে ছিলনা ।তবু অজানা কারণে সাড়া দিল ।
-"বস বাবা ।" চেয়ার এগিয়ে দিল সাগরকে ।বৃদ্ধ আরেকটি চেয়ার টেনে বসলেন ।
-তুমি এখন কি কর বাবা ?
-এবার ডাক্তারি পাশ করলাম ।
-ভাল ! ভাল !
-চাচা যদি কিছু মনে না কর একটা প্রশ্ন করি ?
-হ্যা অবশ্যই ।
-পরীর ব্যাপারে আমি গতকাল করিমচাচার থেকে শুনেছি
।ওকে ডাক্তার দেখিয়েছেন কোনো ?
বৃদ্ধের চেহারার পরিবর্তন সাগরের চোখ এড়াল না ।হাসির রেখা মুহূর্তেয় যেন মিলিয়ে গেল ।
কম্পিত গলায় বলল ,"না বাবা,সে সামর্থ্য যে আমার নেই । -আর ওর ছেলেটি ? বৃদ্ধ এবার যেন খানিকটা রেগে গেলেন ।
মুখ কুঁচকে জবাব দিলন , -অমানুষটা দুধের বাচ্চাটাকে মা হারা করে রেখেছে ।বলে কিনা ওর প্রতি আমাদের কোন দাবী নেই ।
-ওহ !আপনাকে কিছু কথা বলি চাচা ।
-"হ্যা ,বল বাবা ।" বৃদ্ধ খানিকটা মুষড়ে পরেছেন ।
সাগর বলতে লাগল ,পরী আসলে ঠিক পাগল না ।
বৃদ্ধ বিস্ময়ের সাথে বললেন ,"মানে ?"
-হ্যা ,ও পাগল না ।যতটুকু বুঝলাম ও মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছে ।ও সন্তান হারানোকে মেনে নিতে পারে নি । এখন ও ভাবে ওর সন্তান আজো ওর কাছেই আছে ।তাই ও আপনমনেই বিড়বিড় করে ।ওর সন্তানের সাথে কথা বলে ।যখন ও বুঝতে পারে যে ওর সন্তান ওর কাছে নেই ও কাঁদে । আপনারা সবাই ভাবছেন ও পাগল ।ওর সাথে ও এমনটাই আচরণ করছেন ।ও তাতে ও আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ।
-"তুমি সত্যি বলছ বাবা ?" বৃদ্ধের চোখে বিস্ময় ।আবেগে নরম হয়ে এসেছে ।মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠেছে আর গাল বেঁয়ে কয়েকট ফোঁটা অশ্রু গঁড়াল ।সাগরের হাত ধরে বলল ,"বাবা ,তুমি দেখ !আমার মাকে সারিয়ে তুলতে পার কিনা !!!!!
সাগর আস্বস্তের স্বরে বলল ,"আপনি শান্ত হোন চাচা ।আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব ।আর হ্যা ,আমি ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাই ।যাতে মানসিক চাপটা খানিক কমে ।আমি বিকালে ওকে নিয়ে বেরোব ।
-আচ্ছা ।-এখন আসি চাচা ।... -সে কি ,খালি মুখে !-না চাচা ,আজ না আরেকদিন ।...........................................................................................................................................
পড়ন্ত বিকাল ।আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে ।পুকুরপাড়ে এসে বসল সাগর ,পাশে পরী ।হাতে সেই ছোট পুটলি ।তখনো সে আপনমনে বিড়বিড় করছিল পুটলিটার সাথে ।সাগর এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল ।কতই বা বয়স হয়েছে ওর !পরীর মত সুন্দর মুখটিতে হাসির রেখা ফুটার আগেই মিলিয়...ে গেল ! যে করেই হোক ,এই হাসি ফিরিয়ে দিবে ।আপনমনেই প্রতিজ্ঞা করল সাগর !পরী হঠাত্ সাগরের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল ।নারীর সহজাত লজ্জা ।আবার আকাশ ভেঙে আচমকা বৃষ্টি নামল ।পরী দৌড়ে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল ।
-"কি হল পরী ?চল বৃষ্টিতে ভিজি ।" কাছে গিয়ে দাঁড়াল সাগর ।
-"না ,বাবুর ঠান্ডা লেগে যাবে ।" চোখে আতঙ্ক ।সাগর অবাক হল ।মুখে শুধু বলল ,ঠিক আছে ।
সেদিন সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরল ওরা ।
রাতের বেলা সবে খাওয়া দাওয়া করে ডায়েরীটা খুলল সাগর ।হঠাত্ কান্নার শব্দে সজাগ হল । পরী আবার কাঁদছে ।তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েই পরীদের ঘরের দিকে ছুটল ।হারিকেন জ্বলছে ছোট্ট ঘরটাতে ।চারপাশে বাঁশের বেড়া আর উপরে ছন দিয়ে তৈরি চালা ।ভাঙা একটা পাটিতে বসে কাঁদছে পরী ।সাগর পাশে গিয়ে বসল ।সাগরকে দেখে ও খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে ।কান্না থামাল ।
-"পরী !" সাগর ডাকল ।
পরী খানিকটা নড়েচড়ে বসল ।আবার ঢুঁকরে কেঁদে উঠল ,আর বলতে লাগল " ওরা আমার বাবুকে দিলনা ।ওদের পায়ে পরেছি ।লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে ।তবু আমার দুধের বাচ্চাটাকে ওরা আমার কোল থেকে কেঁড়ে নিয়েছে ।"... রাত বাঁড়ছে ।পরীর কান্না রাতের বুক চিরে নীরব পরিবেশে আলোড়ন তুলে যেন বহুদূরে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ।প্রকৃতিও যেন তার শোকে কাঁদছে । আবার ঝমঝময়ি বৃষ্টি নামল ! !
এক মাস পর. . . . .
পরী প্রকৃতিস্হ হয়েছে অনেকখানি ।সাগরের প্রতিদিনের সান্নিধ্যতা ,প্রতি মুর্হূতের সহানুভূতি তাকে সুস্হ করে তুলেছে ।তবু আজো সে কাঁদে তার সন্তানের জন্যে ।সাগর চেষ্টা করে তাকে তার অতীত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে যা তাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে ।এই একমাসের সান্নিধ্যতায় সাগরের মনে ও পরিবর্তন এসেছে ।সে পরীকে অনুভব করছে প্রতি মুর্হুতে ।পরীর কষ্ট ও তাকে স্পর্শ করছে ।এ কি প্রেম !এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল সাগরের মনে ।পরীদের বাড়ি থেকে খানিকটা পশ্চিমে গেলেই বাগান ।নানারকম বৃক্ষরাজিতে ভরা ।এর মধ্যে হরেক রকমের ফলের গাছ ।এমনি একটি গাছের নিচে বসে আছে পরী ।পাশে সাগর ।পরীর শূন্য দৃষ্টি আকাশের দিকে ।সাগর কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করল ।
তারপর পরীকে একটা গাছ দেখিয়ে বলল ,-ঐ গাছটির কথা তোমার মনে আছে ?পরী তাকলো ।
-কেন ?
-ছোটবেলায় তোমাকে যেটা থেকে ধাক্কা দিয়েছিলাম !পরী হাসল ।
-"হ্যা মনে আছে ।পাকা কামরাঙার জন্যে ।
দু'জনে হাসল ।আবার আনমনা হয়ে গেল পরী ।
সাগর তা লক্ষ্য করে বলল ,-তোমার হাসিটা অনেক দামী ।
পরী অবাক হয়ে বলল ,কেন ?
-কারণ ,দুর্লভ সব কিছুই মূল্যবান হয় ।আর তোমার হাসিটাও দুর্লভ !পরী মুচকি হেসে আবার চুপ হয়ে গেল ।
-কি ভাবছ পরী ?
-না কিছুনা ।
-তোমার বাবুর কথা ?
এবার পরীর গাল বেঁয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ।
-"কাঁদবেনা একদম !" সাগরের কন্ঠে শাসন ।
-ওরা এমন করতে পারল !
-ভুলে যাও ওসব কালো স্মৃতি ।কেন কষ্টকে লালন করছ ?
-ভুলে যাব ?যাকে আমার রক্তে মাংসে রাতের পর রাত , দিনের পর দিন আমার মাঝে তিল তিল করে গড়েছি তাকে ভুলে যাব !"
সাগর এ কথার জবাব দিল না ।এর উত্তর ও তার কাছে নেই ।
-এখন দুঃখকে সঙ্গী করেই কি জীবন কাঁটিয়ে দিবে ?
পরী অশ্রুমাখা চোখে সাগরের দিকে তাকাল ।
-কষ্ট কপালে নিয়েই যে জন্মেছি ।এ আমার ভাগ্য ।
-কেন ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছ ।হয়ত তোমার ছেলে একদিন ফিরে আসবে ।যেদিন সে তার মাকে বুঝতে পারবে সেদিন তাকে আটকিয়ে রাখতে পারবে না ।
সাগর পরীর একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল ।আর আশ্বাসের সুরে বলল ,
-"ভয় নেই ।তোমার জীবনে সঙ্গী হয়ে থাকব সবসময় ,ছাঁয়ার মত ।
-"আমার সাথে জড়িয়ে কেন নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে চাও !" পরী কেঁপে উঠল ।
-না ,এতে আমার জীবনটাই শুধু সুন্দর হবে না ,আরেকটা জীবনেরও শুরু হবে নতুন করে ।
আকাশের এতক্ষণ জমে থাকা মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে নামল অঝরধাঁরায় ।প্রকৃতির কষ্ট প্রকাশ পায় এই বৃষ্টিতে ।প্রকৃতির সকল কষ্ট যেন আকাশে কালো মেঘ হয়ে জমা হয় ।এরপর প্রকূতির কান্না হয়ে বৃষ্টি নামে ।প্রকৃতি হালকা হয় ।সতেশ হয়ে উঠে চারপাশ ।আনন্দ হিল্লোল বয়ে যায় গাছ-গাছালিতে ,পাতায় পাতায় ।
সাগর উঠে খানিকটা সামনে গেল ।আবার পিছন ফিরে পরীকে উদ্দেশ্য করে গাইতে লাগল ,
"এসো কর স্নান নবধারা জলে,
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।"
পরী স্মিত হেসে এগিয়ে আসল আর চোখ বন্ধ করে বরণ করে নিল বৃষ্টিকে ।বর্ষার এই বৃষ্টির সাথে যেন তার কষ্টগুলো ধুঁয়ে যায় !
সকালটা র্নিমেঘ ছিল ।গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় মিষ্টি রোদ ।ভেজা ঘাসে আর পাতায় তার আলো ঝিলমিল করছে ।
পরী আজ নতুন শাড়ি পরেছে ।লম্বা চুলগুলোতে বেণি করেছে ।কপালের কালো টিপটি তার সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ।কাজলের হালকা ছাঁয়া পড়েছে মায়াবী চোখগুলোতে ।ওরা দু'জন রেল লাইল ধরে হাঁটতে লাগল ।সব কিছু পেছনে ফেলে ,সামনের দিকে ।হয়ত ওরা খুঁজে নিবে তাদের নতুন স্টেশন ,যেখান থেকে ওরা শুরু করবে ওদের নতুন জীবনের যাত্রা । . . . .