somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্যান্টাসী গল্পঃ বই

০৮ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
বইয়ের নামটা দেখে খুব অবাক হল কামাল। “বই”।
এই নামের বই হতে পারে, ধারণা ছিলনা। বইটা পেয়েছে নীলক্ষেতের ফুটপাথে। দোকানটাতে হরেক রকমের বই। কেউ সম্ভবত তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী পুরোটা বেচে দিয়েছে। তারই সব নিয়ে দোকান খুলেছে। সব ধরনের বই-ই আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে, তা নিয়ে যখন চিন্তায় আছে, তখনই বইটা আবিস্কার করল,
`বই’
সাদা মলাটে, কালো কালিতে লেখা। মোটামুটি মোটা একটা বই। ৬১৯ পাতা, বেশ পুরনো মনে হয়। বহুদিন কারো হাতে পড়েনি। মলাট জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। কোন লেখকের নাম নেই। বইয়ের ভেতরেও নেই। এমনকি প্রকাশনী বা সংস্করণ কিছুই নেই। পাতা উল্টে বুঝল গল্পের বই। বেশ অনেকগুলো গল্প আছে ভিতরে কিন্তু কোনো সূচিপত্র নেই। বইয়ের পাতা গুলোও বেশ নরম হয়ে গেছে। শুধুমাত্র নামের আকর্ষণেই বইটা কিনে নিল সে, সাথে টুকটাক আরো বেশ কয়েকটা বইয়ের জন্য মন কেমন কেমন করতে লাগল। কিন্তু আরো নিতে গেলে বাজেট ক্রস করে যাবে। প্রতি মাসের শুরুতে বেতন পেয়ে বই কেনে কামাল। নতুন বই কিনতে গেলে এখন অনেক খরচ, তাই নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান গুলোই ভরসা। আশংকার কথা হলো, পুরনো বইয়ের দোকানগুলো কমে যাচ্ছে।

এতগুলো বই নিয়ে ফিরতে বেশ কষ্ট হবে। কামাল থাকে ওর বড় বোনের বাসায়। বাড্ডা এলাকায় দুলাভাইয়ের পাচতলা বাসা। তার দোতলায় একই সাথে ওরা থাকে।
বইগুলো দেখে লাবণ্য বেশ খুশি হবে।
লাবণ্য কামালের ভাগনী, ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। গল্পের বইয়ের প্রচন্ড ভক্ত। যদিও তার এসব বই পড়া মানা। তার পরও লুকিয়ে পড়া চাই।
কামালের রুম থেকেই সে বইয়ের যোগান পায়। ধরা পড়লেও কামাল কিছু বলে না। শুধু সাবধান করে যেন ওর বাবা না দ্যাখে।
ওর খুশির কথা ভেবেই এতগুলো বই টেনে নেওয়ার কষ্ট ভুলে গেল কামাল। জ্যাম ঠেঙ্গিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল।
বাসায় ফিরতেই লাবণ্য দৌড়ে এল। ও জানত যে কামাল বই কিনতে যাচ্ছে । এত বই দেখতেই খুশি আর ধরে না।
- ইস মামা, এত বই কোনটা রেখে কোনটা পড়ব!!
ওর হাসি মুখটা দেখে কেমন একটা কষ্ট লাগল কামালের। আসলে লাবণ্যর চেহারা বেশি ভালো না। তাই ও কেমন কমপ্লেক্সে ভোগে। বান্ধবিদের সাথে খুব একটা মেশে না।
খুব বেশি বান্ধবি নেই ও বোধ হয়। তাই বই-ই ওর সবচে কাছের বন্ধু। একটা দীঘর্শ্বাস
চেপে কামাল বলল,
- সব গুলোই পড়া যাবে, কিন্তু একবারে একটার বেশি নেওয়া যাবে না এবং অবশ্যই ক্লাসের পড়া ফাকি দেওয়া যাবে না।
কামালের কথা লাবণ্যর কানে গেল বলে মনে হল না, ও বই বাছতে ব্যস্ত।
চারটা বই হাতে নিয়ে বলল,
- এগুলো নিয়ে যাই।
- কি বলছি শুনিস নাই? একবারে একটা।
- একটা পড়তেতো মাত্র একদিনও লাগে না।
- না লাগুক, আমি তো বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি না। শেষ হলেই আবার এসে নিয়ে যাওয়া যাবে।
মুখ বেজার করে ও একটা বই বেছে নিল।
কামাল বলল, ঠিক আছে। বাবা যেন না দ্যাখে।
- দেখবে না। বলে লাবণ্য চলে গেল।

কামালও কাপড় পাল্টে, হাতমুখ ধুয়ে একটা বই নিয়ে বসে পড়ল।
প্রথমে ‘বই’ বইটা পড়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বেশি বড় বলে বাদ দিল।
আপা খেতে ডাকার আগ পযর্ন্ত আর হুশ ছিল না।
খেয়েও আবার বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গেল টেরও পায়নি কামাল।

সকালে লাবণ্যকে খুব শুকনো দেখা গেল।
কামাল জিজ্ঞাসা করল,
- কিরে, ঘুমাসনি রাতে? কান্নাকাটি করছিস নাকি? বইটা খুব কষ্টের?
লাবণ্য মাথা ঝাকাল।
কামাল হেসে দিল,
- তোকে নিয়ে আর পারা যায় না, বই পড়ে কেউ এতো কাদে? যা, গোসল টোসল কোরে দ্যাখ ভাল লাগতে পারে।
- আচ্ছা বলে ও উঠে চলে গেল।
কামাল খেয়ে অফিসে চলে গেল।


অফিস থেকে সেদিনই বলা হল যে ট্রেনিং এর জন্য ভারত যেতে হবে। কামাল সহ আরও চারজন। মেয়াদ দুই মাস আর যেতে হবে এক সপ্তাহের মাথায়।
পরের এক সপ্তাহ প্রস্তুতির জন্য খুব ব্যস্ততার মধ্যে গেল।
যাওয়ার সময় লাবণ্যর মন খুব খারাপ, কিন্তু সেদিনের কেনা বইয়ের বান্ডিল হাতে তুলে দিতেই মেঘ কেটে সূর্য উঠল।
কামালেরও মনটা ভাল হয়ে গেল।

২.
ট্রেনিং ভালই চলছিল। আর বাকি যখন এক সপ্তাহ তখন হঠাৎ খবর এল যে লাবণ্যকে নাকি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেতো কামালের মাথা খারাপের মত অবস্থা। কাজ ট্রেনিং ফেলে সেদিনই ঢাকা ফিরে এল সে।
বাসার অবস্থা বর্ননা করা সম্ভব না। আপা বরাবর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। দুলাভাই থমথমে। লাবন্যর ছোট ভাই অরণ্যর কাছ থেকে জানা গেল শরীর খারাপ লাগছিল বলে লাবণ্য সেদিন কলেজ যায়নি। ঘরেই ছিল সারাদিন। দুপুরে খাওয়ার পর আর রুম থেকে বেরোয়নি সবাই ভেবেছে বোধহয় ঘুমাচ্ছে। সন্ধায় নাস্তা খেতে ডাকতে গিয়ে দ্যাখে যে নেই। নেই তো নেই। কোথাও নেই। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দুপুর থেকে কেউ ঢোকে বা বেরোয়নি। সারা ঘর তোলপাড় করয়ে ফেলা হল। তারপর থানা হাসপাতাল কোনটিই বাদ নেই। সবচে অদ্ভুত হল লাবণ্যর সব কিছুই রয়ে গেছে, ওর মোবাইল হাতব্যাগ, ব্যাগে টাকা সব। বিছানা টেবিল সবই আগের মত, যেটা যেখানে ছিল সবই আছে শুধু লাবণ্য নেই। আত্মীয় স্বজনে বাড়ী ভরে গেছে। নানা জনের নানা মতামতে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল কামালের। এর মধ্যেই দুলাভাই একপাশে টেনে নিয়ে বললেন,
- তোমার সাথে তো লাবন্যর ভালই খাতির ছিল।
- হুমম
- ও কি কখনো কোন ছেলে টেলের সাথে খাতিরের কথা.........................
- নাতো। ওরকম কিছুর কথা কখনো বলেনি। ওর বান্ধবীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে?
- না, আমিতো কাউকে চিনি না। তোমার আপাতো অজ্ঞান হয়েই থাকছে বেশির ভাগ সময়।
- আচ্ছা আমি দেখছি।


অরণ্যও এ ব্যাপারে কিছু জানে না। লাবণ্যর মোবাইল থেকে ওর বান্ধবীদের ফোন করা হল। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করল যে, লাবণ্যের কারো সাথেই এ ধরণের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য, কারণ ওরকম কিছু হলে অন্তত একজন হলেও তো জানত। তারপর ও ওর রুমে গিয়ে ওর বই খাতা ডায়েরী তন্ন তন্ন করে খোজা হল। কোন চিঠি বা চিরকুট পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না।
ওর পড়ার টেবিলের উপর খুব সুন্দর একটা মেয়ের ছবি। কামাল অরন্যকে জিজ্ঞাসা করল ছবিটা কার?
অরন্য বলল, কেন লাবন্যর।
কামাল অবাক হয়ে বলল লাবন্য এত সুন্দর হল কবে?
- কেন, তুমি জানো না। তোমার এনে দেয়া বই দেখে রুপচর্চা করেই তো ও এত সুন্দর হয়েছিল।
- আমার এনে দেয়া বই? আমি কোনো রুপচর্চার বই এনে দেইনিতো।
- ও তো আমাদের তা ই বলেছিল।
কামাল চিন্তা করেও ভেবে পেল না যে কবে সে লাবণ্যকে রুপচর্চার বই এনে দিয়েছিল।
তবে চিন্তাটা বেশিক্ষন স্থায়ী হল না, আবার লাবণ্যকে খোজাখুজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কিছুতেই কিছু হল না, একটা জলজ্যান্ত মেয়ে উধাও হয়ে গেল। যেখানে যেভাবে সম্ভব খোজ করা হল, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হল,পুলিশ দায়সারা গোছের কিছু কথা বার্তা বলে তাদের খোজাখুজি বন্ধ করে দিল। লাবণ্যকে আর পাওয়া গেল না।

৩.
লাবন্য হারানোর পর প্রায় মাসখানেক পর হয়ে গেল। বাসা থেকে সমস্ত আনন্দ উধাও। কামাল অফিস থেকে বাসায় ফেরে অনেক দেরি করে। তেমন কিছুই করা হয় না এখন। এর মধ্যেই এক ছুটির দিনে দুপুরে শুয়ে আছে এমন সময় দুলাভাই ঘরে এলেন। হাতে একটা বই। এসে বিছানার কোনায় চুপচাপ বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। দেখে কামাল উঠে বসল। তারপর বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
- তোমার বই বোধহয়। লাবন্যের ঘরে পেলাম। বলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
কামাল গিয়ে জড়িয়ে ধরল।দুলাভাই ফুপিয়ে বলতে লাগলেন,
- বই পড়ার জন্য ওকে কত বকেছি। আর বকব না, ও যত ইচ্ছে বই পড়বে। আমি নিজে ওকে গল্পের বই কিনে দেব। ওকে ফিরে আসতে বল..........................
কামাল নিজেও কখন কাদতে শুরু করেছে, তা জানে না। কিই বা বলার আছে!
কামাল অবশ্য এখন বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। বইগুলোর দিকে তাকাতেই লাবন্যর কথা মনে পড়ে। কতবার কল্পনা করেছে যে, কেউ যেন দরজায় উকি দিয়ে বলছে,
- মামা একটা বই নেই।
ও সব বই এগিয়ে দিয়ে বলছে, “একটা কেন সব বই তোর।”
- স-অ-ব
- হুম, শুধু আর হারিয়ে যাবি না, বল?
লাবন্য জবাব দেয় না, আগের মতই বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কল্পনাটা আর সত্যি হয় না।
দুলাভাই চলে যেতে দেখা গেল যে, সেই বইটা, “বই”।

এটাই বোধহয় লাবন্যর পড়া শেষ বই। বইটা দেখে মনে হচ্ছে আগের চেয়ে নতুন হয়ে গেছে। প্রচ্ছদেও নামটা আগে ক্ষয় হওয়া ছিল। এখন বেশ ঝকঝকে। ভিতরে পাতা মনে হল যেন আগের মত নরম নেই। পাতা উল্টে দেখি মোট পাতা ৬৩৫।
মনে হল যেন আগের বার আরও কম ছিল। এসব দেখেই বইটার প্রতি আবার আগ্রহ বোধ করল কামাল।
অনেক দিন পর আবার বই পড়া শুরু করল সে।

প্রথম গল্পটা বেশ ভয়ানক কিন্ত বেশ আকর্ষনীয়।
বহু আগের এক শয়তান প্রেতাত্মার কাহিনী এটা। প্রেতাত্মার কাজ ছিল অন্য কোন মানুষের দেহশুদ্ধ দখল করে ফেলা। এভাবে সে বহু মানুষের দেহ দখল করে ফেলেছিল এবং তাদের আত্মাকে কাজে লাগিয়ে নানা কুকর্মের মাধ্যমে ভয়ানক শক্তিশালী হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন এক সাধক তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাকে পুরো ধ্বংস করে ফেললেও তার দখল করা আরেক শরীরে , আরেক আত্মার মধ্য দিয়ে সে আত্মপ্রকাশ করত। শেষ পযর্ন্ত তাকে পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে, তাকে বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ করে যে, এই অবস্থাতেও সে তার শয়তানী চালিয়ে যাবে।
এখানে সমস্যা হলো শয়তান টাকে কিসে আর কিভাবে বন্দী করল সেই পাতাটা ফাঁকা। এক বারেই ফাকা। লোখাগুলো যেন ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে । যাই হোক শয়তানটাকে আটকাতে পারাতেই ভালো লাগল।

দ্বিতীয় গল্পটা এক মহিলার লাইব্রেরীর। মহিলা কোন সম্ভ্রান্ত বংশীয়ই হবে। তবে তিনি প্রেতচর্চা করতেন। তার বাড়িতে একবার আগুন লাগে। লেগে বাড়ির একাংশ পুড়ে যায়। পরে এখানে এক লাইব্রেরী আবিষ্কৃত হয়। সেখানে মহিলা একটা বই খুজে পান যা তার খুব কাজে লাগে। বইতে বর্ণিত অদ্ভুত উপায়ে তিনি প্রেতচর্চা করার চেষ্টা করেন। তাতে তিনি সফল হন কিনা জানা যায় না। কারণ আগেরটার মত এই গল্পটার ও শেষ পাতা ফাকা। গল্পের বর্ণনা নিখুত ছিল। শেষটা না থাকায় কিছুটা বিরক্ত হল কামাল। গল্পটা যে-ই লিখুক খুব সুন্দর লিখেছিল।

পরের গল্পটা এক বাচ্চা মেয়ের। মেয়েটা রুপকথার গল্প পড়তে খুব পছন্দ করত। তার জন্মদিন তার নানীর কাছ থেকে একটা খুব সুন্দও ছবি আঁকা একটা রুপকথার বই উপহার পায়। বইটার গল্পগুলো অসাধারন ছিল। মেয়েটা প্রতিদিন বইটা পড়ত আর নিজেকে গল্পগুলোর নায়িকা হিসাবে কল্পনা করত। একটা ছেলের সাথে তার ভাব ছিল। কামাল ভেবেছিল হয়তো তার সাথে মিল দিয়েই গল্পটা শেষ হবে। কিন্তু এত সুন্দর গল্পটারও শেষটা নেই। এবারও ভয়ানক মেজাজ খারাপ হল কামালের । বিরক্ত হয়ে বইটা রেখে দিল সে। এত চমৎকার তিনটি গল্প অথচ তার শেষ পড়তে পারল না। ছোটগল্প হিসাবে ধরে নিয়ে নিজের মত করে গল্পগুলো শেষ করে মনকে সান্তনা দিল কামাল।

বিকেলে ঘুমিয়ে উঠে আবার বইটা হাতে তুলে নিল সে। বইয়ের গল্পগুলোর লেখনী সত্যিই অসাধারণ।
পরের গল্পটা এক ভ্রমনকারীর। সে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। গল্পটায় প্রাচীন ফ্রান্সের খুব চমৎকার এক বর্ণনা পাওয়া গেলো। লোকটা একটা বইতে ভারতবর্ষের বর্ণনা পড়ে খুব আগ্রহী হয় আসার জন্য। সে আসার জন্য ভারতে এসে জাহাজ থেকে নামার সাথে সাথেই গল্পটা শেষ। এত চমৎকার এক ভ্রমনবৃত্তান্ত আরো থাকলে ভালো লাগত।

পরের গল্পটা আরো চমৎকার। এক উঠতি নাট্যকারের জীবন সংগ্রামের গল্প। যে কিনা শুরুতে খুব কষ্টে জীবন যাপন করত। তার কষ্টে দাড় করানো নাটক দর্শকরা দেখতে চাইত না। কারণ ওই এলাকার মানুসের রুচি নিম্ন পর্‍যায়ের ছিল। শুদ্ধ নাটকের চেয়ে যাত্রা পালার দিকেই তাদের আগ্রহ বেশী ছিল। নাট্যকার একটা নাটকের বই একদিন খুজে পায়। খুব চমৎকার একটি নাটক। জীবনের সবর্স্ব খরচ করে সে নাটকটি মঞ্চায়ন করে। প্রচুর দর্শক আসে এবার। কিন্তু আবার সেই শেষ দুই পাতা নেই। নাট্যকার কি আনন্দের আতিশয্যে হার্টফেলই করেছিল কিনা কে জানে!

পরের গল্পটা বেশ মজার। এক রাধুনীর গল্প। সে নিত্য নতুন রান্না করে মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করে। যদিও সেসব রান্না বিশেষ জাতের হয় না। সে এক রান্নার বই খুজে পায়। যাতে নিত্য নতুন বেশ কয়েকটা রান্নার রেসিপি দেয়া ছিল। সে ওগুলো রান্না করে এবং এবার তার রান্না বেশ খ্যাতি লাভ করে। দু’তিনটা অদ্ভুত রান্নার রেসিপি গল্পেও ছিল। ভাবলাম বাসার রান্নার ট্রাই করতে হবে। মহিলার ইচ্ছা ছিল শেষ পযর্ন্ত একটা খাবারের দোকান দেবেন। কিন্তু দিতে পারলেন কিনা কে জানে। কারণ শেষ পাতা নেই।

কি আর করা, এভাবে হয়তো বইটা পড়ে শেষ করতে হবে। তবে এখানে একটা ব্যাপার লক্ষনীয় যে, প্রতিটি গল্পই উত্তম পুরুষে বর্ণিত এবং কোন না কোন বইকে নিয়ে। এ জন্যই হয়তো বইটার নাম বই।

এর পরের গল্প গুলোও ভালো। এক গণিতবিদের গল্প আছে, একটা বইয়ের অংক সমাধান করে যে নাম করেছিল। এক যাদু ওয়ালার গল্প আছে, শুরুতে যার শো না জমলেও একটা বই থেকে নির্দেশনা পেয়ে যে বেশ খ্যাতি অর্জন করে, এক রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, হস্তরেখাবিশারদ, বৈজ্ঞানিক এমনকি এক কাজের বুয়ার কাহিনীও আছে। যার কাজ ছিল তার মনিবের ছেলেকে গল্পের বই পড়ে শোনানো। এদের প্রত্যেকের জীবনেই একটা বইয়ের বিশেষ ভূমিকা আছে।

৪.
পড়তে পড়তে একদম শেষ গল্পে চলে এল কামাল। ততক্ষনে রাত অনেক হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়তে গিয়েও কি মনে করে শুরুটা একটু পড়ল কামাল । গল্পটা একটা কিশোরী মেয়ের। যে কিনা গল্পের বই পাগল এবং যার মামা তাকে বই এনে দেয় পড়ার জন্য। মেয়েটির মামা একদিন অনেকগুলো বই আনে। মেয়েটা তিন চারটা বই নিতে চায় তার মধ্যে কিন্তু মামা নিষেধ করে বলে মাত্র একটা বই নিতে। পড়ে চমকে উঠল কামাল। লাবন্যের কথা মনে পড়ে গেল। ওকি এই গল্পটা পড়েই কোন পাগলামি করেছে নাকি? মুহুর্তেই ঘুম পালিয়ে গেল। পুরো গল্পটা পড়ে জমে গেল সে। সংক্ষেপে কাহিনীটা এরকমঃ
মেয়টার মামা অফিসের কাজে বিদেশ যাওয়ার সময় মেয়েটাকে অনেকগুলো বই দিয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে রুপচর্চার একটা বই ছিল। মেয়েটার চেহারা একটু খারাপ ছিল। ফলে সে অন্য সবার সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করত। এজন্য সে মনে মনে অনেক কষ্ট পেত। কিন্তু কাউকে কিছু বলত না। বই পড়তে খুব ভালবাসত বলে বইয়ের মধ্যেই সে নিজের আনন্দ খুজে নিত। যদিও রুপচর্চার ব্যপারে খুব একটা আগ্রহী ছিল না কিন্তু বইটাতে প্রাচীন রুপচর্চার অনেক অদ্ভুত পদ্ধতি লেখা ছিল। মেয়েটা সেগুলো কাজে লাগতে শুরু করে এবং অবাক হয়ে লক্ষ করে যে সে আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে যাচ্ছে।
এমনকি ক্লাসের যে সব ছেলে তাকে পাত্তা দিত না তারাও এখন সুযোগ পেলেই আড়চোখে তার দিকে তাকায়। কিন্তু মেয়েটা তখন খুব অহংকারী হয়ে গেছে। সে ছেলে গুলোকে পাত্তা তো দিতই না বরং তাদেরকে নানাভাবে অপছন্দ করতে লাগল। কিন্তু এত কিছুর পরও মেয়েটা একটা ছেলেকে পছন্দ করত। কারণ যখন মেয়েটার চেহারা খারাপ ছিল তখন শুধু মাত্র এই ছেলেটাই মেয়েটার সাথে ভালো ব্যবহার করত, কথা বলত। কিন্তু এখন মেয়েটার আকস্মিক পরিবর্তন এবং অন্যদের ভীড়ে কাছে ঘেষতে পারে না। মেয়েটা ঠিক করে সে তার পছন্দের কথা ছেলেটাকে বলবে। এজন্য সে ঐ বইটার সর্বশেষ যে রুপচর্চাটা ছিল সেটা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ এটাই নাকি ঐ বইয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। মেয়েটা রুপচর্চা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেটাকে বলতে পারে কিনা তা জানা গেল না কারণ শেষ পাতা নেই।
এযে, পুরো লাবন্যর কাহিনী। এ গল্প এখানে এল কি করে
বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কামাল। আস্তে করে অনেকটা হঠাৎই ওর কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে এল। লাবন্য আর কোথাও যায়নি। এই বইটাই ওকে দখল করে নিয়েছে। শুরুর গল্পের শয়তানটাকে সম্ভবত সাধকটা এই বইতেই আটকে তার লাইব্রেরীতে রেখে দিয়েছিল। পরে আগুন লেগে বইটা আবার আলোর মুখ দ্যাখে এবং শয়তানটা আবার তার শয়তানী শুরু করে। বই থেকে মুক্ত হতে না পারলেও তার শয়তানী ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ যে টাইপের বই পছন্দ করে বা কারো যে বই দরকার বইটা তার কাছে সেই টাইপের বই হিসাবেই আবির্ভূত হয় এবং বইতে যা লেখা আছে তা পুরোটা করা হয়ে গেলেই বইটা লোকটার শরীর দখল নিয়ে নেয় এবং দরকারের সময় কাজে লাগায়। একারনেই প্রথম গল্পের মহিলা প্রেতচর্চা পুরণ করার পরই উধাও হয়ো যায়। এজন্যই গল্পের শেষটুক নেই । একইভাবে বাচ্চা মেয়েটা রুপকথার গল্প পড়ে শেষ করার পর, ভ্রমণ কারী লোকটা ভারত আসার পর কিংবা রাধুনী মহিলাটা শেষ রান্নাটা করার পর সকলেই উধাও । এদের আত্মাকে ব্যবহার করেই বইটা আজ ও টিকে আছে। এরই ধারাবাহিকতায় এর সর্বশেষ শিকার লাবণ্য । ও শেষ রুপচর্চাটার করার পরই ওকেও দখল করে বইটা। সম্ভবত এর আগে বহুদিন বইটা কোনো শিকার পাচ্ছিল না । এজন্য তার মলাট ক্ষয়ে পাতা নরম হয়ে গিয়েছিল । লাবণ্য কে ব্যবহার করে আবার সে তার পুরনো চেহার ফিরিয়ে আনে। কামাল নিজে বই পাগল। তাই ওর কাছে একটা গল্পের বই হিসাবেই ধরা দিয়েছে সে। হঠাৎ এই চিন্তা মাথার আসতেই শিরদাড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল । ওতো বইটার সব গল্প পড়ে ফেলেছে । তাহলে এখনকি কামালও শয়তানটার দখলে? সেটাইতো হওয়ার কথা । শয়তানটা কি ওকেও গায়েব করে ফেলবে? দ্রুত নিজের শরীর চেক করল কামাল , আয়নার সামনে গিয়ে দেখল সব ঠিক আছে কিনা। সবইতো আছে, তাহলে? তাহলে কি ওর ধারণা ভুল? ভুল ঠিক যা-ই হোক, এখনও যেহেতু কিছু হয়নি কিছু হওয়ার আগেই কিছু করতে হবে। বইটাকে ধ্বংস করতে হবে। ভয়ানক রাগে বইটাকে ছিড়তে লাগল ও। বইটাকে ছিড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে আগুন ধরিয়ে দিল । আপা বোধ হয় বাথরুমে যেতে উঠেছিলেন । আগুন দেখে দৌড়ে এলেন । হাতে পানির মগ ছিল দ্রুত আগুন নিভিয়ে দিলেন । কামাল চিৎকার করল, ‘নিভিও না, নিভিও না। লাবণ্যকে এই বইটাই খেয়েছে। ধ্বংস কর এটাকে।’
চিৎকারে দুলাভাই অরণ্য সবই ছুটে এল । কামাল হিস্টিরিয়া রোগীর মত চেচাতে লাগল। ওরা জোর করে ধরে রাখল। আপা আরো পানি এনে বইটাকে নিভিয়ে দিল । এত কিছুর পরও ওর কিছু হল না বলে খুব অবাক হল কামাল। তাহলে কি ওর অনুমান মিথ্যা?

দুলাভাই জোর করে একটা ঘুমের অষুধ খাইয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পরই চোখে তন্দ্রা নেমে আসলো। সেই মূহুর্তে পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারলো কামাল। কাউকে দখল করার সাথেই বইটা কাজে লাগায় না। কাজে লাগায় যখন ওটার দরকার হয় তখন। যেমন লাবন্যকে ব্যবহার করে ওটা আরো বেশি ঝকঝকে হয়েছে। তাই আপাতত বইটার কাউকে দরকার ছিল না। কিন্তু এখন বইটা পুড়ে গেছে। নিজেকে ঠিক করতে কামালকে তার দরকার হবে। কামাল প্রাণপনে জেগে থাকতে চাইল, কিন্তু ঘুম ওকে গ্রাস করে নিল।



পরিশিষ্ট
১০ বছর পরের কথা। নীলক্ষেতের এক দোকানীর কাছে অরন্য তার বাসার সব বই বিক্রি করে দিল। বাবার মতই বইয়ের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া একমাত্র বোন এবং মামা রহস্যজনকভাবে নিখোজ হওয়ার পর থেকে বই গুলোতে ধূলো জমা ছাড়া আর কোন কাজ হচ্ছে না। দোকানী বেশ সস্তায় অনেক গুলো বই পেয়ে খুব খুশি। সেদিনই সে তার দোকানে বইগুলো তুলে ফেলল।
বিকেলে তার দোকানে এল এক হাসিখুশি তরুনী। বুয়েটে আর্কিটেকচার থেকে সদ্য পাশ করেছে। প্রাচীন আমলের আর্টের উপর একটা বই দরকার তার। একটা বিল্ডিংয়ের কাজ পেয়েছে। সেখানকার সবকিছু প্রাচীন আমলের আর্ট দিয়ে সাজাতে হবে। পুরো নীলক্ষেত চষে ফেলেও যখন এধরনের বই না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল সে। হঠাৎই রাস্তার ধারের দোকানটাতে এই ধরনের বইটা পেল। কী যে খুশি হল! যদিও বইটা খুব পুরনো এবং বাইন্ডিং ও বেশ আলগা হয়ে গেছে কিন্তু কিনে নিল সে। এই প্রজেক্টটা ঠিক মত করে দিতে পারলে আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
মেয়েটা ভাবছে নিজের ক্যারিয়ারটাকেই বুঝি কিনে নিয়ে যাচ্ছে সে।
আসলে কি তাই?

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৩ বিকাল ৩:২৩
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×