somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের বড় হুজুর

১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১০:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের বড় হুজুর। নাম-মোঃ ইসমাইল। হালকা পাতলা গড়নের সুন্দর একজন মানুষ। মাদ্রাসার নাম-তাকিয়া বাজার ওসমানিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসা। সিংহের মত গর্জন করতে করতে ক্লাশের সামনে পায়চারি করতেন আমাদের বড় হুজুর। তখন চারিদিকে বিরাজ করত হীম শীতল পিন পতন নীরবতা। আমরা ছিলাম চার ভাই। বাবা আমাদের সকল ভাইকেই মাদ্রায়ায় পড়িয়েছেন। বাবা ছিলেন গ্রামের সহজ-সরল-সজ্জন-ধর্মভীরু, অতি সাধারণ একজন মানুষ। বাবা প্রায় রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। মুনাজাতে বাবার কান্নার আওয়াজে কত রাতে যে আমার ঘুম ভেঙেছে তার হিসাব নাই। বাবা পরকালের জীবনকে বেশি বেশি স্বরণ করতেন। দোযখের আযাবকে ভীষণ ভয় পেতেন। তাই তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন তার ছেলেরা যেন নিজেদেরকে ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলে। আমি ছিলাম সবার ছোট। বড় ভাই ফারুক, মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করে এখন ওসমানিয়া উচ্চবিদ্যালয় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছে। মেজো ভাই রহিম, ক্লাশ এইট পর্যন্ত পড়ে পড়াকে গুড়বাই জানিয়ে মালায়েশিয়া থেকে সাত বছর থেকে এসে এখন ব্যবসা করছে। সেজো ভাই সৌদি আরব আজ আট বছর প্রবাসী। সে আমার পড়ালেখার প্রধান যোগানদাতা।
ছোটবেলায় দেখেছি ভাইয়েরা মাদ্রাসা থেকে এসে বড় হুজুরের গল্প করতেন। বলাবলি করতেন, আজকে হুজুর কোন ছেলেকে মারতে মারতে প্রস্রাব পায়খানা করিয়ে ছেড়েছেন। আর কোন ছেলেকে দরজা বন্ধ করে মেরে শরীর থেকে রক্ত বের করে দিয়েছেন। তাই এসব কারণে ছোটবেলা থেকে বড় হুজুরের প্রতি আমার এক ধরণের ভয় জন্ম নেয়।
আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। তৃতীয় শ্রেণীর নতুন বই এনেছি কিছুদিন হল। কিন্তু এ বছর বাবা আমাকে আর স্কুলে পাঠাবেন না। একদিন বাবা আমাকে পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে টুপি মাথায় দিয়ে বড় হুজুরের কাছে নিয়ে গেলেন। আমি ভয়ে জুবুথুবু অবস্থায়। দেখলাম বাবা আমাকে সত্যিই মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। এবং হুজুরকে বললেন-‘হুজুর, আমি ছেলেকে জন্ম দিয়েছি ঠিকই; এখন মানুষ করার দায়িত্ব আপনার। আমার ছেলের গোস্ত আপনার আর হাড়্ড়ি আপনার।’ সেদিন বাবার মুখে এ কথা শুনে আরও বেশি ভয় পেলাম মনে মনে। এই শীতের সময়ও আমার শরীর থেকে চিকন ঘাম বের হল। ঘামে আমার পাঞ্জাবী ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।
একদিনে ঘটনা। আমি তখন ক্লাশ এইটে পড়তাম। সেদিন কি এক কারণে আমাদের ক্লাশ টিচার আসতে দেরি করলেন। তাই আমরা সবাই যে যার মত গল্প, চিৎকার, চেচামেছি করছি। আমাদের পাশের রুমের ক্লাশ সেভেনের ছাত্রছাত্রীরাও চড়–ই পাখির মত চিংকার করল। আমাদের চিৎকার বড় হুজুরের কানে গেল। আর বড় হুজুরের কানে যাওয়া মানে তো মস্ত একটা লংকাকান্ড বেধে যাওয়া। হুজুর রেগে যাওয়া মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া। হুজুরের বেতটি ছিল সরিষার তেল মাখিয়ে মোটাতাজা করা। যেদিন হুজুর বেশি রেগে যেতেন সেদিন বেত হাতে নিয়ে তিনি বের হতেন। বের হয়ে প্রথমে তিনি যে কাজটি করতেন তা হল- কোন এক ক্লাশে ঢুকে টেবিলের উপর জোরেজোরে বেত মারতেন। এবং চুপচাপ করে বাঘের মত গম্ভীর হয়ে থাকতেন। এরপর একটা আওয়াজ দিতেন সিংহের মত। তখন চারদিকে বিরাজ করত মাঘ মাসের মাঝ রাতের শীতের নীরবতা। এরপর যে ক্লাশ টার্গেট করতেন, সে ক্লাশে গিয়ে সবাইকে সবাং সবাং মারতে শুরু করতেন। সেদিন আমাদের পাশের পাশের রুমে তিনি মারছেন। মারের শ্যাৎ শ্যাৎ আওয়াজ আসছে আমার কানে। আমি খুব নিজে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য খোদা তাঁয়ালার কাছে প্রার্থনা করতো লাগলাম। মনে মনে বড় খতমের দোয়াও পড়তে লাগলাম। ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ যোয়ালিমীন।’ হঠাৎ আমার মাথায় ফেরেস্তা একটা বুদ্ধি দিল। সব বুদ্ধি যে শয়তানে দে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। অনেক কে-ই বলতে শোনা যায় এই ছেলেটির মাথায় শয়তানি বুদ্ধি ভরা। তা আমার বুঝে আসে না তবে সেদিন আমাকে যে ফেরেস্তারা বুদ্ধি দিয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল-‘যাও পালাও.. পালানোই একমাত্র এই বিপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারে।’ আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আর সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। হাতে সময় খুবই কম। কেননা এখনি দরজা দিয়ে দিয়ে ঢুকবে আমাদের বড় হুজুর মহাশয়। তিনি এখন সিংহ মূর্তি ধারণ করে আছেন। সিংহের সামনে পড়লে হরিণের যে দশা হয় আমারও সে দশা হবে নিশ্চয়। ওনাকে এখন সিংহ হুজুর বললেও ভুল বলা হবে না। এ সময় আমি পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জানালটি খোলা এবংকি গ্রিল ভাঙাও। তাই আর ভাবনা চিন্তা না করে ঔ জানালা দিয়েই এক লাফে ক্লাশ থেকে বের হয়ে এলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছে কোন সিংহ হিংস্র মূর্তি ধারণ করে আমাকে ধাওয়া করছে। আমি দৌড়ছি আর দৌড়ছি.....আর আমার কানে ভেসে আসতে লাগল হুজুরের সবাং সবাং মারের শ্যাৎ শ্যাৎ আওয়াজ।
আমি এখন ঢাকা কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টর্স পড়ছি। অনার্স শেষ শেষ করেছি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। এখন টুকটাক কিছু লেখালেখি করি। গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা এইসব আর কি। অনেকের উৎসাহ পাই ভাল লাগে। অনেকেই আবার ভিন্ন সুরে কথা বলে তাও আমি বুঝতে পারি। তবে এখনও সেদিনের সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা আমার মনে পড়ে। এখন আর মাদ্রাসায় যাওয়া হয় না। বাবা মারা গেছেন সে-ই ১৯৯৮ সালের কোন এক আমাবশ্যা রজনীতে। আমাদের বড় হুজুরও রিটায়ার্ড করেছেন প্রায় এক বছর হল। শুনেছি হুজুর এখনও নিয়মিত মাদ্রাসায় যান। এখনকার প্রিন্সিপাল বড় হুজুরের জন্য একটা রুম বরাদ্ধ দিয়েছেন যেখানে গিয়ে আমাদের হুজুর বসেন। আমাদের বড় হুজুর ছিলেন একজন সত্যিকারে আদর্শ শিক্ষক। আমাদের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠিত প্রিন্সিপাল। অগাধ পান্ডিত্য আর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। একাধারে বাংলা, ইংরেজী, আরবী, হিন্দি, উর্দু, ফারসী ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি সুপন্ডিত ছিলেন। আমাদের দেশে বড় হুজুরের মত এমন আদর্শ শিক্ষকের খুবই অভাব।
বড় হুজুর নামটি এখনো উচ্চারিত হলে আমার গলা শুকিয়ে যায়। ভয় আর ভালবাসা উভয়ই শিহরণ খেলে যায় আমার শরীরে। বড় হুজুর আপনার জন্য রইল অনেক অনেক ভালবাসা। সালাম জানাই আপনার করমকলে। কেননা আপনি আমার মনে ভয় এবং ভালবাসা দু’ই তৈরী করতে পেরেছেন।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই হোটেল এর নাম বাংলা রেস্তেরা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭



অনেক দিন পর আমি আজ এই হোটেলে নাস্তা করেছি। খুব তৃপ্তি করে নাস্তা করেছি। এই হোটেল এর নাম বাংলা রেস্তেরা। ঠিকনা: ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডম ভবেরচর, গজারিয়া, মন্সীগঞ্জ। দুইটি তুন্দুল রুটি আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×