somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িকতার বীজ বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার গণিতঃ সংক্ষেপে আমি যা বুঝলাম...

১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৫:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকা বিশ্ববি্দ্যালয় রিডিং ক্লাবের ৪৩তম গণবক্তৃতার বিষয় ছিল "সাম্প্রদায়িকতার বীজ বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার গণিত" এবং আলোচক ছিলেন ফারুক ওয়াসিফ। আলোচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে নাসরিন খন্দকার লাবণী ম্যাম বক্তৃতার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধিটুকু উপস্থিত সকলের সাথে শেয়ার করছিলেন। প্যাটার্নটা আমি নকল করছি, আমার উপলব্ধিটুকু এখানে সংক্ষেপে শেয়ার করার মাধ্যমে।

১. ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজাগমনের পূর্বে ধর্ম ছিল বিশ্বাস [Faith], বিশ্বাস স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নিতে পারে নানা রুপ। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্বাসী মুসলমানও আরবে আট বাংলাদেশির প্রকাশ্য শিরশ্ছেদ দেখে শিউরে উঠেছেন ও ব্যাথিত হয়েছেন অথচ সৌদি মুসলমানের অধিকাংশ মুসলমান ব্যাপারটায় হয়েছে উল্লসিত। এর কারণ হল ইসলামের কাঠামো বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে এক ধরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশে আর সৌদি আরবে আরেক ধরণের। কিন্তু ধর্ম যখন মতাদর্শ [Ideology] হয়ে ওঠে, তখন সেটা একটা অপরিবর্তনীয় কাঠামো দাঁড় করায় এবং ওই কাঠামোর বাইরে থাকা সব কিছুকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। ধর্মবিশ্বাস বিভিন্ন ধরণের তরজমা তাফসিরের সুযোগ রাখে, কিন্তু ধর্ম-মতাদর্শ একরৈখিক। এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় আফগানিস্তানের তালেবান ও তাদের ছদ্মসমর্থক জাকির নায়েকদের মধ্যে যারা কোরান ও ত্রিপিটকের একরৈখিক ব্যাখ্যা দিয়ে "প্রমাণ করে" [বিশ্বাস প্রমাণ করা যায় না, যেটা প্রমাণ করা যায় সেটা বিশ্বাস না।] বামিয়ানের বৌদ্ধমূর্তি ভাঙা হল মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব এবং এটা করে মুসলমানেরা বৌদ্ধদের উপকার করেছে কারণ বৌদ্ধ ধর্মে মূর্তিপূজা নেই !!! একজন বিশ্বাসী ভাঙাভাঙিতে যাবে না, কারণ সে যেটা মানে সেটা এমনেই মানে, তার কোনো গরজ নাই দুনিয়ার সবাইরে তার বিশ্বাসের ভেতরে ঢোকানোর; গরজ তখনই তৈরি হয় যখন সে বিশ্বাসী থেকে মতাদর্শিক হয়ে ওঠে, অর্থাৎ যখন সে বিশ্বাসকে কাঠামোবদ্ধ করে সেই কাঠামোয় সবাইরে ঢুকাতে চায়। এই পার্থক্যটা আমাদের মনে রাখা উচিত।

২. কিন্তু ইংরেজরা আসার পর ক্যানো বিশ্বাস মতাদর্শে রুপ নিলো? মনে রাখা দরকার, ইংরেজ যে ইউরোপ থেকে এসেছে সে ইউরো্পে ক্রিশ্চান ধর্ম ভাগ হয়ে গিয়েছিল "ক্যাথলিক" ও "প্রটেস্ট্যান্ট" এই দুই মূল বিভাজনে। ক্যাথলিকরা চাইত চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্য, যার সাথে মিল ছিল সেইসময়ের সামন্ত উচ্চবিত্তের গোষ্ঠীবদ্ধতার; প্রটেস্ট্যান্টরা [আক্ষরিক অর্থেইঃ বিদ্রোহীরা] চাইত প্রত্যেকে একা একা দাঁড়াবে ঈশ্বরের সামনে ও চার্চের সর্বব্যাপি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নাই, যার সাথে মিল রয়েছে সেইসময়ের বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের ব্যাক্তিস্বাধীনতার। দ্যাখা যাচ্ছে, ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্ট দ্বন্দ্বটা সামন্ত-বুর্জোয়া দ্বন্দ্বের সাথে সম্পর্কিত। আবার, ইউরোপের একটা "অন্ধকার মধ্যযুগও" ছিল এই দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্বের সাথে সম্পর্কিত। অতএব, যখন ইংরেজরা ইতিহাস লিখল ভারতে তখন তাদেরকে এখানে দ্বন্দ্বরত দুইটি সম্প্রদায় আবিষ্কার করতে হল, আবিষ্কার করতে হল একটি মধ্যযুগ। সেই সম্প্রদায় কারা? হিন্দু ও মুসলমান! মধ্যযুগ কোনটা? "মুসলিম" শাসন! আপনারা একটু খোঁজ নিলে দেখবেন ঔপনিবেশিক আমলে যেসব ইংরেজ বা ইংরেজ-কর্তৃক-মগজ-নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় ইতিহাস লিখেছেন তাঁরা প্রায় ব্যাতিক্রমবিহীনভাবে ইতিহাসের খুব সরলরৈখিক একটা ভাষ্য দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কি সেটা? "প্রাচীনযুগের আর্য শাসন" ছিল ভারতের সোনালি যুগ, "মধ্যযুগের মুসলিম শাসন" ছিল ভারতের অন্ধকার যুগ, আর "ব্রিটিশ ইন্ডিয়া" ভারতের নবজাগরণের যুগ !!! একটা ভালো উদাহরণ স্যার যদুনাথ সরকারের "দা হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল। এই সরলীকৃত ইতিহাস এতই মজে ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে তৈরি হওয়া বাংলার "শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণী", যাঁদের প্রায় সবাই উচ্চবর্ণের হিন্দু ছিলেন, যে সিপাহী যুদ্ধের সময় এরা প্রায় সবাই নির্লজ্জভাবে ইংরেজের প্রশস্তি গেয়েছেন ও সেপাইদের নিন্দা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইরফান হাবিব, রমিলা থাপার প্রমুখ প্রচুর তথ্য উপাত্তের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে "মুসলিম" শাসনে ভারতবর্ষ ততোটা অন্ধকার ছিল না, যতটা ইংরে্জ-নির্মিত ইতিহাসে দ্যাখানো হয়েছে। অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী দাবি করেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে আমরা যা বুঝি যা ইংরেজের আগমনের আগে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঘটেনি।

৩. এর অর্থ আবার এই না যে ইংরেজ আসার আগে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো মারামারি হয় নাই। হয়েছে। কিন্তু সেটা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে হয় নাই। যে কারণে হিন্দু হিন্দুকে মেরেছে বা মুসলমান মুসলমানকে মেরেছে, সেই একই কারণে হিন্দু মুসলমানকে বা মুসলমান হিন্দুকে মেরেছে।

৪. হিন্দুত্ববাদী বঙ্কিম যখন লিখেছেন যে "মুসলমানেরা যুগ যুগ ধরিয়া হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালাইয়াছে" তখন তাঁর কণ্ঠস্বরের সাথে মিল পাওয়া যায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সালমান রুশদির "মুসলমানেরা জাতিগতভাবেই প্রগতিবিমুখ" এই কথার। আবার মুসলমানত্ববাদী শিরাজী যখন স্পেন বিজয় কাব্য লিখে প্রমাণ করেন যে মুসলমানেরা "বীর জাতি" তখন তিনি মনে রাখেন না যে তাঁর বাড়ির পাশের চাষী মুসলমানের সেই বিজয়ে বীরত্বে কিছুই যায় আসে না। মুসলমানদেরকে "অখণ্ড জাতি" বিবেচনায় হিন্দুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আর মুসলমানত্ববাদীর কি অদ্ভূত মিল !!! অথচ এটা কারো মনে পড়ে না সৈয়দ আমীর আলী আর মহেশ গল্পের গফুর দুজনেই মুসলমান হলেও এক আল্লাহয় বিশ্বাস ছাড়া দুজনের মধ্যে কোনো মিলই নেই, কি অর্থনৈতিক জীবনে কি সাংস্কৃতিক জীবনে।

৫. উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক বিনায়ক সাভারকর আর মুসলমানত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উভয়েই কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন ব্যাক্তিজীবনে। আবার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাণমানুষ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন ব্যাক্তিজীবনে ধর্মবিশ্বাসী। লক্ষ্যনীয় যে, ধর্মনিরপেক্ষ সাভারকর ও জিন্নাহ তৈরি করলেন সেই হিংস্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা যা উপমহাদেশকে নিয়ে গ্যাছে পার্টিশনের নৃশংস খুন-ধর্ষণের দিকে, অথচ ধর্মবিশ্বাসী ভাসানী তৈরি করলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিসর যা দরিদ্র হিন্দু মুসলমানের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই ঐক্য এনেছিল !!! আর একটা কথা না বললেই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ সাভারকর-জিন্নাহের সাম্প্রদায়িক অনুসারীদের বড়ো অংশই ছিল "শিক্ষিত মধ্যবিত্ত" আর ধর্মবিশ্বাসী ভাসানীর অনুসারীদের বড়ো অংশই ছিল "অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত"বলা দরকার, যে শিক্ষার মাপকাঠিতে শিক্ষিত অশিক্ষিত ভেদ করতে হচ্ছে, সেটাও কিন্তু ইংরেজের ডিজাইন করা কেরাণী তৈরির শিক্ষা।

৬. যখন মুসলমান বা হিন্দু বলে একটা "অখণ্ড সম্প্রদায়" বোঝানো হয় যারা দুনিয়াব্যাপি ইসলাম বা হিন্দুইজম নামের "অখণ্ড মতাদর্শ" মেনে চলে, তখনই প্রয়োজন হয় "ধর্মনিরপেক্ষতার। কিন্তু যদি আমরা মেনে নেই যে ইসলাম বা সনাতনধর্ম [হিন্দু নামটা ইংরেজ আমলে চালু হয়েছে] হচ্ছে "বিশ্বাস" যার স্থান-কাল-পাত্র ভেদে হাজারটা রুপ থাকতে পারে ও রয়েছে "" তাহলে আর "ধর্মনিরপেক্ষতার" প্রয়োজন হয় না, কারণ তখন মুসলমান বা হিন্দু বলে কোনো "অখণ্ড সম্প্রদায়ই" আর থাকে না।

৭. পাঁচ আর ছয় নম্বর পয়েন্ট থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে "ধর্মনিরপেক্ষতা" ও "সাম্প্রদায়িকতা" আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত ব্যাপার মনে হলেও আদতে একটা আরেকটার পরিপূরক।

এই হল সংক্ষেপে আমি যা বুঝলাম...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১০:২১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×