somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ ভক্সাল কোরাস, এ সঙ অব মেলোডি: বিলেতের স্ন্যাপশট ।। রেজা ঘটক

০৯ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৮:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা দৈনিক জনকণ্ঠের জনপ্রিয় কলাম ‘পলাশ নয়তো কৃষ্ণচূড়া’র লেখক ও অনাবাসী কবি শামীম আজাদের লেখনির সাথে পরিচিত। আমরা বাংলাদেশে ফ্যাশন জার্নালিজমের পথিকৃৎ, দু’দশক বিলেতে পাঁজরলগ্ন করা সাপ্তাহিক সুরমা, জনমত ও পত্রিকার নিয়মিত লেখক সাংবাদিক শামীম আজাদকে চিনি।
দৈনিক প্রথম আলোর কলামে যিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশেল মশলায় তৈরি করেন অভিন্ন এক ক্যানভাস। লন্ডন তথা বহির্বিশ্বে ‘বিজয়ফুল’ নামে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে চিরঞ্জীব রাখার অন্যতম উদ্যোক্তা শামীম আজাদের বাক্য আর শব্দের সুগভীর কর্মএলাকার সাথেও আমরা পরিচিত। বর্তমানে যিনি লন্ডনের 'অ্যাপল্স অ্যান্ড স্নেইক্স' এর আবাসিক কবি ও লেখক।
আবহাওয়া পরম্পরায় একদিন শরীরের বাকল ঝরে গেলে যিনি রাজহংস হয়েছেন অথবা হননি, যাঁর পঙতিমালা দেশের উঠোনে অথবা বিদেশের কফি টেবিলে সূর্যবীজ হলো কিনা জানার পরিবর্তে যিনি নিরন্তর লিখছেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে, নদী ও নৃতত্ত্ব নিয়ে যাঁর গভীর আগ্রহ, লন্ডনের সাপ্তাহিক লন্ডনবাংলা, সুরমা, জনমত সহ বাংলা পত্রিকাগুলো যাঁর ঠিকানা, ক্যামেলিয়ন না হতে পারার দুঃখ যিনি অন্তরে লালন করেন তিনি হলেন নন রেসিডেন্ট বাঙালি কবি ও লেখক শামীম আজাদ।
রোজ সকালে সূর্যের পিঠে সওয়ার হবার সময় যাঁর মনে পড়ে পূর্ব পুরুষের কথা। যার পিঠে রক্ত জবার মত ক্ষত ছিল। দেশান্তরে পাড়ি জমানো তার দুঃসাহসিক সাহসের কথা। রাতে ঘুম ভাঙলে কাঠের সাদা সিঁড়ি ভেঙে নিচের তলায় নেমে ভিক্টেরিয়ান ট্যাপেস্ট্রির সামনে আধো অন্ধকারে ওপরে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে যিনি ভাবেন- ‘ছাদের ওপরে নিশ্চয়ই চিমনীর গা ঘেষে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে আমার মাস্তুল। আর আমি আমার জাহাজে একখণ্ড সবুজ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছি এই লন্ডিনিয়ামে। এসেক্সের গেন্টসহীলে ভ্যালেন্টাইন পার্কের তীরে একটি ছোট্ট বাড়ি।’
যুদ্ধ জয়ে বিশ্বাসী বলে শামীম আজাদ তাঁর নিজের নৌকাটা পুড়িয়ে ব্রিকলিন তীরে গড়ে ওঠা বাংলাটাউনে আরেকটা বাংলাদেশ খুঁজে ফেরেন নিজের কবিতা ও লেখায়। অনাবাসে বাংলা পত্রিকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র্রের বাংলা কর্মকাণ্ড আর লেখা জোখায় যাঁর রঙ ও রূপ আমাদের কাছে হাজারো বৈচিত্র্যে প্রস্ফুটিত তিনি কথা সাহিত্যিক শামীম আজাদ।
'বিলেতের স্ন্যাপশট' বইতে শামীম আজাদ লন্ডনের প্রবাস জীবনের এমন কিছু ঘটনার সাথে পাঠকের সরাসরি পরিচয় করান যেখানে ডুব দিলে আবিস্কৃত হয় লোভাতুর এক মায়াবী সাহিত্যের ঝকঝকে সঞ্জিবনী সুধা। পাঠক একবার সেই নির্ভেজাল প্রশান্তীময় নির্মেদ অথচ প্রগাঢ় বিশুদ্ধ শব্দমালার বিমুগ্ধ বুনোটের অষ্টমুখী প্রলুব্ধে গভীরভাবে নিমজ্জিত হলে সুধা পান না করে অন্যত্র ঢু মারার অবকাশ নেই।
একুশটি ছোট ছোট রচনায় বিলেতের ঔপনিবেশিক আমলের বিভিন্ন জাতির গন্ধ, স্বাদ ও ছবির কয়েকশো বছরের একেবারে টাটকা ইতিহাস ঘটনা পরম্পরায় অত্যন্ত সুচতুরভাবে লেখক আমাদের কাছে হাজির করেন। শামীম আজাদের গল্প বলার ভঙিটা চমৎকার। পোয়েট্রি সোসাইটির ক্যাফেতে, মাল্টি কালচারাল আর্ট কনর্সটিয়ামের ক্ষয়িষ্ণু দালানে, টমাস বাক্সটন স্কুলে এক গাদা বাঙালি বাচ্চাদের সঙ্গে মাঠে, টয়েনবী হলের ডুমুর গাছের নিচে যেখান থেকে এখনো লর্ড এ্যাটলির পিয়ানো দেখা যায় অথবা লেখকের বাড়ির রান্নঘরে কবি স্টিভেন ওয়াট্সকে আঠারো বছর ধরে তিনি যেভাবে গল্প শোনান, পাঠক যেনো তেমনি মাত্র একুশটি স্ন্যাপশটের নিটোল নিরহঙ্কার নিশ্চিত হাতছানিতে ঘুরে আসেন কয়েক শতাব্দির থাউসেন্ড স্টোরিস-এর জীবন জীবিকা ও কাহিনী চিন্থ থেকে।
আলপস থেকে ধ্বসমান চাঁই চাঁই বরফের কাব্যে পাঠককে এক আশ্চার্য যাদুতে বন্দী করেন কবি শামীম আজাদ। 'এ্ ভক্সাল কোরাস' শুনিয়ে পাঠকের স্নায়ুঝড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে কতো সহজেই বলে ওঠেন মানুষের ব্যানার লাগে বৃদের লাগে না। ফলেই তার পরিচয়। তখন খুব অনায়াসেই পাঠক টের পান যতদূরেই লেখক যাক না কেন সেই পিচ্ছিল ঘাট, নোংরা উঠোন, এঁদো পুকুর-পাড়ের বাঁশ ঝাড় আর ভস্ম হয়ে যাওয়া দীর্ঘ ছায়া কিংবা কৃতি সন্তানের আলোকিত সভা কক্ষ ছাড়িয়ে তিনি হৃদয়ে লালন করেন লাল সবুজ বাংলাদেশ। এখানেই তাঁর আত্মার বাড়ি। মনের মন্দির। পূর্ব লন্ডনের কড স্ট্রিটের কোনায় দাঁড়ানো প্রাচীন বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে তাই তিনি ভাবেন পূর্ব পুরুষের কথা। স্বপ্ন দেখেন সারাবিশ্বে বাংলাদেশের বিজয়ফুল কর্মসূচি একদিন ছড়িয়ে যাবে আর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় নিজ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আগামী প্রজন্মের সন্তানরা শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে গড়ে উঠবে।
প্রবল দেশপ্রেম আর অদ্ভুত গল্পের ফেরিওয়ালী শামীম আজাদ আমাদেরকে নিয়ে যান উনবিংশ শতাব্দির লন্ডনের রাস্তায়। যখন সেখানে বাতিওলার তেলের বাতি আর ঘোড়ার গাড়ির শব্দের মধ্যে কাঠ কয়লা পোড়া চিমনীর ধোঁয়া সারাণ ঢেকে রাখতো মেঘের আকাশ। সূর্যজলের তখন বড়ই আকাল। তুষারের তৃণে আর বরফের ব্যরিকেডে মানুষের সার্বণিক সঙ্গী তখন ভারী কোট, হ্যাট আর ছাতা। জমকালো ঝাড়বাতির উষ্ণতার মধ্যে স্ট্রবেরী ব্লসমের মতোই জন্ম হল তখন মহারানী ভিক্টোরিয়ার। ব্রিটিশ রাজবাড়ির গম্ভীর আকাশ চিরে চলে­া আলোর বিরতিহীন আতশবাজী। একইদিনে পূর্ব লন্ডনের এক অন্ধকার ঘরে পিতৃহীন সম্বলহীন স্যাঁতসেতে ঘরে জন্ম হল হেনরির। কিন্তু জন্ম সময়েই মা’র মৃত্যু হল আর হেনরির স্থান হল এতিমখানায়। পাঠক হিসেবে আমরা অনায়াসে গিলতে থাকি পার্ল কিং হেনরি ক্রফট আর তাঁর স্ত্রী পার্লি ক্যুইন রানী ভিক্টোরিয়ার গল্প।
কবি শামীম আজাদ সারা বিশ্বের প্রবাসী প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’র চেতনা ও বিজয়ের গৌরবকে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টায় তাঁর বিজয়ফুল কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি দেশের ভূমি দস্যুদের কথা ভেবে, অপরাধীদের জমাট সিন্ডিকেট পাথরের কথা ভেবে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে এখানকার নেতা নেত্রী পুলিশ প্রশাসন ও দেশের আক্রান্ত অবকাঠামোর কথা ভেবে যখন বেদনায় নীল হয়ে ওঠেন, তখন পাঠকের হৃদয়ও যেনো তবিত হয় অদ্ভুত এক বালির পর্দায় কেবল এই সব শকুনদের পাপ দেখে দেখে যেনো এখানে সব কিছু নষ্টদের অধিকারে গেছে। সবখানেই যেনোবা দুর্বৃত্তের দংশন। কিন্তু পাঠক আমরাও কবি শামীম আজাদের মতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আশ্বাসকে বিশ্বাস করতে চাই। আশাবাদি মানুষ হিসেবে আমরাও দেখতে চাই সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে না। বাংলাদেশ মাথা উচু করে দাঁড়াবে একদিন। লাল সবুজের বিজয়ফুল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে একদিন। কবি শামীম আজাদের বিলেতের স্ন্যাপশট যেনো ভক্সাল থেকে যাবার সময় টানেলের ভেতরে গ্রাফিতির পাশে লেখা রয়্যাল ডালটনের কয়েকটি পংক্তি-
`Where does it start, the long river? In the morning it’s blue… When it’s overcast it’s brown like tea… At sunset red and orange like there’s a fire… And at night, it’s black as black coffee…’

বিলেটে স্প্যাপশট ।। শামীম আজাদ।। প্রকাশক : আহমেদ মাহমুদুল হক।। মাওলা ব্রাদার্স প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৪১৬।। ফেব্রুয়ারি ২০১০।। প্রচ্ছদ : ফার্গল কোর্বেট ও সজীব আজাদ দাম : ১২০ টাকা ।। আইএসবিএন : ৯৮৪-৭০১৫৬-০১৭৩-৭



গাবতলা, মগবাজার, ঢাকা
৩০ মার্চ ২০১০। ১৬ চৈত্র ১৪১৬




সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×