somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিনে টিকিটে রেল ভ্রমণ

১০ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডানিয়েল লিম্বার্টের দেখলাম দারুণ সাহস। মাঝে মাঝেই এ কাজটি ও করে সম্ভবত। বলা চলে ওর পাল্লায় পড়েই বা ওর অনুরোধ ঠেলে ফেলে দিতে না পেরেই আমিও বে-আইনী কাজে জীবনে প্রথম বারের মতো অংশী হলাম। ওর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিন্তু আমার কাছে মারাত্মক রকমের গুরুত্বপূর্ণ। -কেন? হয়তো এ রকম প্রশ্ন উদয় হতে পারে।আমার চেনা জানা অনেককেই দেখেছি, কোথাও কোন কাগজপত্র জমা দিতে হলে যদি তা সত্যায়ন করার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে ওরা নিজেরাই গ্যাজেটেড অফিসার হয়ে নিজের কাগজপত্র নিজেরাই সত্যায়িত করে জমা দেয়। এদের মধ্যে বেসকারি কলেজের লেকচারার হতে শুরু করে আরও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাও আছেন, আছেন অল্প শিক্ষিতরাও। নিজের শিক্ষার উপর অগাধ বিশ্বাস, অহম এসব থেকেই এ ধরনের বে-আইনি কাজে ওরা নিজেরা জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমি পারলাম না। পারলাম না বলেই আমি ওদের কারো চোখে 'বলদ', কারো চোখে 'আবাল', কারো চোখে 'ভোদাই।' ওদের বক্তব্য, ওরা অন্যায় কিছু করছে না, দুশ্চরিত্র লোকের কাছ থেকে কাগজপত্র সত্যায়ন কিংবা চারিত্রিক সনদ আনার চেয়ে নিজের চারিত্রিক সনদ নিজেরাই তৈরি করে নেয় ওরা। আমি পারি না। আমার কাছে আইন মানাটাই আসল। কে চরিত্রবান কে দুশ্চরিত্র এটা বিচার আমাকে কেউ করতে বলে নি। তাই ওদের ভাষ্যমতে 'দুশ্চরিত্র' গ্যাজেটেড অফিসার দিয়েই আমার এ যাবত সকল কাগজপত্র দরকারের সময় আমি সত্যায়ন করিয়ে নিতে লজ্জা পাই নি। কেননা নিয়ম বলে কথা। সে যাক- যে বিষয় নিয়ে শুরু করেছিলাম:
আপিসের কাজে মাঝে মাঝেই আউট ডোরে যেতে হয় আমাকে। কাজ শেষ করে শান্তিপ্রিয় আইনমান্যকারী অন্য দশ ভাইয়ের (নাগরিকের) মতো আমিও নিয়ম মেনেই গাড়িতে চলাফেরা করি। যেখানে ধূমপান নিষিদ্ধ সেখানে সিগারেট জ্বালাই না। মসজিদে নামাজ পড়াকালীন অন্যভাইকে বিরক্ত করে কথা বলি না। মোদ্দাকথা নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু এ নিয়ম বুঝি এবার ভঙ্গ হলো।
গতকাল অফিসের একটা কাজে এয়ারপোর্ট যেতে হয়েছিলো। এখানের কাজ শেষ করে যেতে হবে কমলাপুর। তো কমলাপুর যেতে হলে বাসেও যাওয়া যায় কিন্তু ড্যানিয়েল লিম্বার্ট বললো, চলুন দাদা ট্রেনে যাই, ভালো লাগবে, তাড়াতাড়ি পৌঁছাতেও পারবো। আমি ওর কথায় খুশি হয়ে উঠলাম। ট্রেনে অনেকদিন উঠা হয় না। সেই কবে শেষবারের মতো ট্রেনে উঠেছিলাম! আমি যখন ওয়াকিং ফর বেটার লাইফে (শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতো এমন একটা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা) তখন অফিসের কাজে সিলেট গিয়েছিলাম প্রোগ্রাম করতে। দারুণ মজা হয়েছিলো সেই ভ্রমণটি। তার আগেও দু'একবার ট্রেনে চড়েছি, ভালো লেগেছিলো। তো, ড্যানিয়েল লিম্বার্টের কথা মতো এয়ারপোর্ট গিয়ে টিকেট কাটতে চাইলে লিম্বার্ট বাধা দিয়ে বললো, এখন টিকেট কাটবেন না, লোকাল ট্রেন তো, একটু পরেই টিটি এসে টিকেট দিয়ে যাবে। আমি ওর কথায় ঠিক আশ্বস্থ হতে পারলাম না। কী জানি, যদি টিকিট নিয়ে টিটি ঝামেলা করে? যদি অপমান করে বলে, আপনাদের মতো শিক্ষিত লোকেরা যদি আইন অমান্য করে বিনা টিকেটে ট্রেনে উঠে তাহলে দেশের বাকি লোকেরা কী করবে? আমি তো কোন জবাব দিতে পারবো না। হায় আল্লাহ! আমি এখন কি করি? এদিকে ওর তাড়া খেয়ে ট্রেনে তো উঠলাম, কিন্তু বুক আমার দুরু দুরু করে কাঁপছে। হায় আল্লাহ! তুমি আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাও, বলে মনে মনে প্রার্থনা করছি। এদিকে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এয়ারপোর্ট পার হলাম বিনা বাধায়। তারপর ধীরে ধীরে কাকলী বনানী স্টেশন। টিটি এলেন না। ট্রেন থেমে আছে, অনেকক্ষণ। কী ব্যাপার ভাই! বিষয় কি? সহযাত্রী এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই লিম্বার্ট বললো সিমেনার শুটিং চলছে। সত্যি তাই- ট্রেনের যাত্রীরা সব গলা বের করে দেখতে শুরু করলো। ওদের চেহারা দেখে বুঝলাম, বেশ মজা পাচ্ছে। কিন্তু আমার ভেতরে ভয়। ভয় এ জন্য যে, যদি টিটি এসে টিকিট চায়, আর আমি দিতে না পারি, তবে অবস্থা কী হবে! জানি, টিকিট না থাকলে জরিমানা হবে, জরিমানা দিতে না পারলে জেল হবে। পকেটে টাকা আছে তিনহাজারের উপরে। সুতরাং জরিমানা দিতে পারলে জেল অন্তত হবে না। কিন্তু তারপরেও ভয় কাটাতে পারছি না। লিম্বার্টকে দেখলাম, হাপুস নয়নে শুটিং দেখছে। আমি ওরে তাড়া দিলাম, দাদা চলেন, নেমে বাসে চলে যাই। কিন্তু ও হেসে বললো, এইতো চলে এসেছি। আর বড়জোর আধাঘন্টা লাগবে। ওর কথা শুনে নামতে পারলাম না। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে ট্রেন কাওরান বাজার ছেড়ে এলো কিন্তু টিটি সাহেবের খবর নেই। বুক কাঁপছে। দুরু দুরু মনে বসে আছি, এমন সময় রেল রাস্তার পাড় ঘেঁষে অসংখ্য বস্তি চোখে পড়লো। বস্তি দেখে ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে পড়লো-, আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বি অট্টেলিকার সারি আবার দেখেছি তারেই ছায়াতে গৃহহীন নরনারী। মনটাকে অন্য খাবে প্রবাহিত করতে বেশ কিছু বস্তির ছবি তুললাম। ট্রেন চলে এলো খিলগাঁও। আমি আর পারলাম না। খিলগাঁও এসে পৌঁছুতেই লিম্বার্টকে তাড়া দিলাম- ’ভাই, আমি আর পারছি না, ভয় করছে, ইজ্জতের ভয়। এখন নেমে পড়ুন। আমার তাড়া খেয়ে লিম্বার্ট নেমে এলো আমার সাথে। নামলাম খিলগাঁও। ট্রেন থেকে নামতেই বড় একটা বোঝা নেমে গেলো মাথার উপর থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একটা। তারপর প্রায় চার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এলাম কমলাপুর। টিকিট কাটা হলো না। টিকেটের পয়সা দান করলাম কয়েকজন অন্ধ ভিক্ষুককে।

আমি পারলাম না। আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন ভীতু নাগরিক হিসেবেই। পাঠক হয়তো আমাকে আরও কোন বিশেষণে ভূষিত করতে পারেন। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। বাংলাদেশে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করেন। তাদের কতজন টিকেট কেটে ট্রেনে উঠেন তা আমার জানা নেই। শুনেছি ট্রেনে নাকি ব্যাপক অনিময় আর দুর্নীতি। কিন্তু আমার মনে হলো, এদেশে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ আমাদের জনগণ। কেননা, তারা দুর্নীতিকে আশ্রয় প্রশয় দিয়ে যাচ্ছেন। আগে নাগরিক ঠিক হতে হবে। নইলে আইন যতোই প্রণয়ন হোক, কাজ হবে না।
আমার এ লেখা কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকলে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×