বিচ্ছেদ............
“ও বাবা, তুমি এভাবে কাঁদছ কেন, বলতো ? তুমি এতটা পাগল কেন?”
কাল রাতে টিভিতে একটি স্থিরচিত্র দেখলাম- বড় একটি হাতের তজনী আর মধ্যমা শক্ত করে ধরে আছে ছোট্ট-কচি একটি হাত। দৃশ্যটি দেখে বুকটা হু হু করে উঠল! আমার জীবনে এ দৃশ্যটি কখনো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আজ থেকে আট বছর আগে আমার হাতটি ঐ বড় হাতের তজনী আর মধ্যমা থেকে ছুটে গেছে। এখন যদিও আমি নিজেই ঐ বড় হাতটির জায়গায় চলে এসেছি দৃশ্যতঃ, কিন্তু মন খুঁজে বেড়ায় আ
মার হাতের চেয়ে বড় যে হাত, তাঁকে-আমার বাবার হাত। আমার বাবাকে সর্বশেষ যখন দেখি, তখন তিনি হাউ-মাউ করে কাঁদছিলেন কাঁচের ওপাশে; পাগলের মত একবার এপাশ, আরেকবার ওপাশে যাচ্ছিলেন। দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল, ২০০৩। পুরো কাঁচের এপাশে আমার কাছে যদিও তাঁর কান্নার শব্দ আসছিল না, কিন্তু তাঁর হাহাকার, বাচ্চা ছেলের প্রিয় খেলনা হারানোর কান্না, তাঁর অস্থিরতা- অদৃশ্য তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে আর আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছিল। কাঁচের এপাশে ইমিগ্রেশন লাইনে দু বছর এগার মাস বয়সী নুবাহকে কোলে নিয়ে আমার হাসব্যান্ড কচি আর আমি সাত মাস বয়সী নূশাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি; আমার পি, এইচডি স্টাডির ফাকে আমি দেশ এসেছি বাচ্চাদের জাপান নিয়ে যেতে ।
যারা আমার বাবা প্রফেসর ডঃ শহীদুল হক কে চিনেন (ফুড টেকনোলজী বিভাগ; বা, ক, বি) তাঁরা জানেন-আমি কি ছিলাম তাঁর ; তাঁর পৃথিবীর কতটা জুড়ে ছিলাম আমি! বাবা-মেয়ের ভালবাসার সে এক কাহিনী! লিখব লিখব করেও লিখতে পারছি না। গুছিয়ে লিখতে হলে নাকি সময়ের দূরত্বে গিয়ে লিখতে হয়! বাবা চলে গেছেন অন্য এক জগতে, পবিত্র মক্কার মাটিতে শুয়ে আছেন আট বছর হয়ে গেল কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আট সেকেন্ডও কাটেনি, সময় থেমে আছে আমার বুকের ভেতরে। তাই এখনও নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারিনি, কবে পারব কে জানে ! কোনদিন কি পারব? আমার বাবার কথা লেখা দরকার। বাবার গল্প বলবে হাজারো বাবা, এমনি হাজারো মানুষের কথা। আমাদের ভালবাসার এই গল্প আলো দেখা “ডিসারব” করে, দারুন ভাবে। কিন্তু কিছুতেই লিখতে পারছিনা। কেন পারছিনা ? বুকের ভেতরের এই ক্ষরণ বন্ধ হবে কবে আর আমি কবে লিখতে পারব বাবাকে নিয়ে! এই ক্ষরণ আদৌ বন্ধ হবে কি কখনও ?
জীবনের প্রয়োজনে যখন আমাকে ছাড়তে হল বাবার আর মেয়েদের ছাড়তে হল আমার, বাবা আঁকড়ে ধরলেন আমার মেয়েদের, তাঁর নাতনীদের। আমার দু-মেয়ের জন্মমুহূর্ত থেকে বাবা আমার মেয়েদের এত ভালবাসা দিয়েছেন, এমনভাবে তাঁর নাতনীদের লালন-পালন করেছেন যে- “মাটিতে রাখেননি যদি পিঁপড়া কাটে ওদের, মাথায় রাখেননি যদি পোকা কামড়ায় তাঁর নাতনীদের।“ মা-ছাড়া দুই নাতনীকে তিনি বুকে রেখেছেন, স্রেফ বুকে। তাই বিচ্ছিন্নতার সেই ১৪ এপ্রিল, ২০০৩ রাতে বিমানবন্দরে কাঁচের ওপাশে ওভাবে আমার বাবার কান্নার কারন বুঝা সম্ভব শুধু আমার বাবা আর আমার, আর কারো নয়। একই সাথে তাঁর পুরো পৃথিবী আঁধার করে দিয়ে তাঁর জীবনের তিন-তিন টি আলো চলে যাচ্ছে, কি করে সহ্য করবেন তিনি! আমার শূন্যতা একদিন তিনি ঘুচিয়েছেন নাতনীদের দিয়ে, মেয়ে আর নাতনীরা যখন একই দিনে একই সঙ্গে চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে তখন এই এত এত শূন্যতা তিনি পূরণ করবেন কি দিয়ে, কাকে দিয়ে? তাঁর মত “কন্যাপাগল” মানুষ থাকবেনটা কি নিয়ে! মাঝে মাঝে মনে হয়, নাকি তিনি ভেবেছিলেন- মেয়ে আর তাঁর নাতনীদের সঙ্গে সেদিনই তাঁর শেষ দেখা! যদি সে রাতে কাঁচের দেয়াল পেড়িয়ে ওপাশে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাতে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতাম- “ ও বাবা, তুমি এভাবে কাঁদছ কেন, বলতো ? তুমি কি পাগল নাকি ? এভাবে কেউ কাঁদে ? মানুষের মেয়ে কি বিদেশে পড়তে যায় না? দরকারে নাতনীরা দূরে যায় না ? এভাবে কেউ কি কাঁদে ? তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? তুমি এতটা পাগল কেন? কেন বাবা, বলতো ?”
With due respect and regards
Prof. Dr. Fatema Hoque Shikha
Department of Fisheries Technology
Bangladesh Agricultural University
Mymensingh-2202
e-mail: [email protected]
(েলখাটা এ বছেরর বাবা িদবেস িলখা)