somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৌদ্ধ মন্দির ও জনপদের আগুনে বাংলাদেশও ছাই হয়ে যেতে পারে ... ফরহাদ মজহার

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
যে সকল দুর্বৃত্ত বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ জনপদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে, তারা সজ্ঞানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্বের গোড়ায় আগুন দিয়েছে। পুড়ে যাওয়া ভগবান বুদ্ধের মূর্তি তথাগতের নয়, বাংলাদেশের নিজেরই ছবি। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবি চোখে লেগে আছে। ছাই হয়ে যাওয়া উপাসনাস্থল, প্রায় ভস্ম হয়ে যাওয়া নানান জিনিসপত্রের পাশে পুড়ে যাওয়া টিনের স্তূপ। ঐসবের মধ্য দিয়ে তথাগতের মূর্তি দূর থেকে মূর্তির গায়ে আগুনে পুড়ে যাবার চিহ্ন, অথচ ওর মধ্যেও দূরে মাথা উঁচু করে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সুপারিগাছ। ভস্মস্তূপ থেকে নতুন ভাবে উপাসনাগৃহ হয়তো আবার বানানো অসম্ভব নয়। পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরগুলোও হয়তো আবার বানানো সম্ভব হবে। কিন্তু যে জায়গাটুকু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে গভীর ক্ষত তৈরী হয়েছে তার নিরাময় আদৌ সম্ভব কি না কে জানে। বাস্তবের আগুন নিভিয়ে ফেলা সহজ, কিন্তু যে আগুন সামাজিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রের ন্যূনতম ভিত্তি পুড়িয়ে ফেলতে চায় তাকে নেভানো কঠিন। কারণ কোথায় কিভাবে এই আগুন ছড়াচ্ছে তা বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। এই আগুন বাংলাদেশকে ছারখার করে ফেলতে পারে। যারা এই ভয়াবহ কর্মটির পরিকল্পনা করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তা বাস্তবায়িত করেছে তারা তাদের কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক পরিণতি কি হতে পারে তা জেনেই এই কাজ করেছে। তাদের কাজের প্রাথমিক ফল হছে কিছু বিষয় প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করা। সেই ফলগুলো আলোচনা করলে এই কাণ্ড যারা সজ্ঞানে ঘটিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আমরা কিছুটা ধরতে পারব।

প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে, এটা প্রমাণ করা যে বাংলাদেশে মুসলমান ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্ম নিরাপদ নয়; যে সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নানান ঐতিহাসিক কারণে শত্রুতা আছে শুধু তারা নয়, এমনকি যাদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠদের কোন ঐতিহাসিক বা সামাজিক শত্রুতা নাই তারাও এই দেশে অরক্ষিত। তাদের কোন নিরাপত্তা নাই। যেকোন সময় তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংখ্যাগুরু ভারতীয় জনগণের কাছে বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে আতং তৈরি করা। বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে ভারতীয় জনগণের চোখে শত্রু হিশাবে চিহ্নিত। ‘জঙ্গি ইসলামের’ সার্বক্ষণিক আতঙ্ক তৈরি তো আছেই, দিল্লি সবসময় প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের অভয় স্থান বাংলাদেশ, ফলে বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। শেখ হাসিনার আমলে উলফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের হস্তান্তর ও দিল্লিকে খুশি করবার সম্ভাব্য সকল আওয়ামী প্রচেষ্টার পরেও ভারতের এই অভিযোগ বন্ধ হয় নি।

সীমান্তে কাঁটাতার এবং পাখির মতো বাংলাদেশীদের হত্যার কোন প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ ভারতে খুবই ক্ষীণ বা নাই বললেই চলে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি এই লক্ষণ থেকেও টের পাওয়া যায়। দিল্লির প্রতি ক্ষতাসীনদের দাসত্ব আছে কিন্তু ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর কোন সক্রিয় ও ফলপ্রসূ প্রয়াস বাংলাদেশে নাই। ভারতের আগামি নির্বাচন যতোই এগিয়ে আসছে ততোই ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে প্রচার তীব্র হচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম আছে যারা ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্কচর্চার চেয়েও দিল্লির নীতি বাস্তবায়ন করে। যার মর্ম হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করা। এই উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে ‘জঙ্গি ইসলামের’ উপস্থিতির কথা তারা সরবে প্রচার করে।

এই ধরণের নানান অজুহাতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন প্রকাশ্যেই দাবি করছে যে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবার কারণে বাংলাদেশে ক্ষমতার কোন পরিবর্তন হোক সেটা ভারতের কাম্য হতে পারে না। কারণ এতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতের বিরুদ্ধে সহিংস তৎপরতা আবার চালানো হবে এবং বাংলাদেশের ইসলামি জঙ্গিরা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এর সমাধান হচ্ছে, ক্ষমতার সম্ভাব্য পরিবর্তন প্রতিহত করা। এই সকল যুক্তি দেবার অর্থ হচ্ছে নির্বাচন হোক বা না হোক বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় হস্তক্ষেপের ন্যায্যতা আগেভাগেই প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা কূটনৈতিক বা গোয়েন্দা তৎপরতা যেকোন দিক থেকেই হতে পারে। এ বিষয়ে কিছুটা ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আঞ্চলিক উত্তাপ’ শিরোনামে আগে আলোচনা করেছি। বৌদ্ধ উপাসনালয়, হিন্দু মন্দির ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভাঙচুর করে এবং জ্বালিয়ে দিয়ে তা সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও ইসলামি জঙ্গিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে এই যুক্তিকেই আরো শক্তিশালী করা হয়।

তৃতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইসলাম যে মূলত বর্বরদের ধর্ম তার পক্ষে প্রমাণ হাজির করা। বাংলাদেশীরা নিজেদের যতোই ‘মডারেট’ বলে দাবি করুক যেকোন মুসলমানের মতো হিংস্রতা ও বর্বরতা বাঙালি বা বাংলাদেশীদের স্বভাবেরই অন্তর্গত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মনমানসিকতার কোন পরিবর্তন যেমন হয় নি, বাঙালি ও বাংলাদেশীরা তাদের তিক্ত ইতিহাস থেকেও কোন শিক্ষা নেয় নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আন্তরিক প্রীতি এ ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাচেতনায় কোন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটায় নি। বৌদ্ধ মন্দির ও জনপদ জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি যারা করে, তাদেরকেই এই অপকর্মে নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছে। এই রাজনীতির দোহাই দিয়ে যারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বৌদ্ধ মন্দির ও জনপদ জ্বালানোয় সকলেই অংশগ্রহণ করেছে। তার মানে বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে কে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি করে আর কে ইসলামি রাজনীতি করে তাতে কিছুই আসে যায় না। সব আরশোলাই রাতে বেরিয়ে আসে এবং নিজের স্বভাব প্রদর্শন করে।

চতুর্থ উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের সম্ভাবনা নস্যাৎ করা। বিশেষত যেসব দেশের জনগণ প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আমরা শুনে আসছি বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। কিন্তু তার প্রতিবেশীরা যদি প্রত্যেকেই বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ হয় তাহলে এই ভূকৌশলগত তাৎপর্যের কোন রাজনৈতিক মূল্য যেমন থাকবে না, তেমনি বাংলাদেশের নিজের নিরাপত্তাও এতে ভয়াবহ হুমকির মুখোমুখি হবে।

বাংলাদেশের প্রতি মায়ানমারের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সেটা রোহিঙ্গাদের ‘বাঙ্গাল’ ও ‘কালা’ বলে ডাকা দিয়েই বোঝা যায়। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া ও গণহত্যার যে নারকীয়তা আমরা দেখেছি তার চেয়েও বিপজ্জনক হচ্ছে বাঙালি মুসলমানদের প্রতি মায়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি যারা গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাদের মধ্যেও এই মানসিকতা বিস্মিত করে বটে কিন্তু এটাই বাস্তবতা। দীর্ঘ বছরের সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক নিপীড়ন এর একটা কারণ। তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের অভাব থেকে এই বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু একে বদলানো এখন আরো কঠিন হয়ে পড়বে এবং বলা বাহুল্য বাংলাদেশের ঘটনাবলির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হবে।

বলা বাহুল্য, পাশের দেশ থাইল্যান্ডেও এর মন্দ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। ইতোমধ্যে যেসব প্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া গেছে তাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ করেছেন এবং বাংলাদেশে এই ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে এক দিকে ভারত এবং অন্য দিকে মায়ানমার-থাইল্যান্ডের জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলা অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। শত্রু পরিবেষ্টিত থাকলে বাংলাদেশের মতো একটি ছোট, দুর্বল ও আভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিক থেকে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক ভাবে বিঘিœত হবে, সন্দেহ নাই।

আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যের জনগণের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি করা। বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ-জনপদ জ্বালিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের যে রূপ প্রদর্শিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক অনুমানকেই আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। ভারতে বাংলাদেশীদের খেদিয়ে দেবার আন্দোলন দীর্ঘ দিনের। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে এসেছে অভিযোগ করে আসামে সম্প্রতি বিশাল দাঙ্গা হয়েছে। সেখানে বোড়োরা ভূমিকা রেখেছে। দাঙ্গার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সন্নিহিত রাজ্যগুলোর জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা বুঝতে পারি।

অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাবে বৌদ্ধ উপাসনালয় ও বৌদ্ধ জনপদ জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষতি ভয়াবহ। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা তৈরি, ছড়ানো ও তার ভিত্তিতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরীর ক্ষেত্রে এই ঘটনা বারবারই অজুহাত হয়ে হাজির হবে। হাজির থাকবে।



দুই

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে যারা নিজেদের ভালমানুষ ও ভদ্রলোক বলে মনে করেন তারা এই ঘটনার প্রতিবাদ করছেন। নিজেদের তারা বাংলাদেশের বিবেক হিশাবে হাজির করতে চান। ভাল। আশ্চর্য হবার কিছু নাই যে বিবেকের দংশনে যথারীতি তারা এই ঘটনার জন্য মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই দায়ী করেছেন। বাংলাদেশে অবশ্যই মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম অবশ্যই সঠিক এবং সেই লড়াই তীব্র করাও ন্যায্য। কিন্তু বৌদ্ধ উপাসনালয় ও জনপদ জ্বালিয়ে দেবার এই ন্যক্কারজনক ঘটনার ক্ষেত্রে প্রধান দায় রাষ্ট্র ও সরকারের। রাষ্ট্রের চরিত্র ও সরকারের ভূমিকার কথা প্রথমে না বলে যারা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান, তাদের সঙ্গে একমত হবার কোন কারণ নাই। তা ছাড়া মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এই অঞ্চলের সমস্যা। উপমহাদেশের ইতিহাসের মধ্যে তার উপাদান আছে। শুধু উপমহাদেশ বলি কেন, সমগ্র পৃথিবীতেই সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিশাল একটি সমস্যা। দেশভেদে, সংস্কৃতিভেদে অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনীতির বিকাশ ও সচেতনতার মাত্রা অনুযায়ী উভয়ের প্রকাশের মধ্যে ভেদ-বৈচিত্র্য আছে। সেটা পরের প্রশ্ন। কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কোন কর্মসূচিতে এক কদম রাস্তায় বেরুবার জো নাই, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে যেখানে বিরোধী দলকে কোন কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি যেখানে তেল-গ্যাসের জন্য যারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাদের নির্মম ভাবে পেটাতে সরকারের বাধছে নাÑ সেখানে একের পর এক বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ জনপদ কিছু লোক ‘আল্লাহু আকবর’ হাঁক ছেড়ে জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়ে গেল কিভাবে? সরকার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের বিশাল বাহিনী জনগণ ও বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। অথচ নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের রক্ষা করতে তারা ব্যর্থ হোল কেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিজেদের দোষে? নাকি সরকার চায় নি বলেই সেটা সম্ভব হয় নি।

তবুও যারা বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ জনপদ আগুন দিয়ে পোড়ানোর নিন্দা করছেন ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাদের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য অবশ্যই সংহতি প্রকাশ জরুরি। যারা রাস্তায় প্রতিবাদ জানাতে নামছেন তাদের প্রতি তো অবশ্যই। কিন্তু যারা সন্তর্পণে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকার প্রশ্ন বাদ দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন শুধু সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তাদের সমর্থন করা কঠিন। প্রতিবাদ তো শুধু সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে করলে হবে না, এই লড়াই একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা না করে যারা শুধু বিছিন্ন ভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয় নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন তাদের রাজনীতির সমালোচনা না করলে বৃহত্তর সংহতি ভুল দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূতÑ রাজনীতির দুই প্রধান ধারাকেই জনগণের দুষমন হিশাবে চিহ্নিত করতে হবে ও তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

পরপর তিন দিন বৌদ্ধদের উপাসনালয় ও জনপদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুই জানে না, কিছুই তারা করতে পারে নি, এটা অবিশ্বাস্য। আমরা এখনো জানি না ক্ষমতাসীনদের এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক রাজনৈতিক খেলা আদৌ বন্ধ হয়েছে কি না। অথচ এর বিরুদ্ধে এক অক্ষর প্রতিবাদ না করে শুধু মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার অর্থ প্রকারান্তরে যারা এই তাণ্ডব ঘটিয়েছে তাদের পক্ষাবলম্বন করা। নীরবতার এই রাজনীতি আরো ভয়াবহÑ কারণ, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত নিপীড়ন ও মৌলবাদ বিরোধিতার আড়ালে এতে মূলত অপরাধীদেরই আড়াল করা হয়। পত্রিকায় খবর হচ্ছে প্রথম মিছিলটি বের হয়? উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও রামু প্রেস ক্লাবের সভাপতি নূরুল ইসলাম সেলিম ও উপজেলা মৎস্যজীবী লীগ নেতা আনসারুল হক ভুট্টুর নেতৃত্বে। মিছিলটি রামুর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে চৌমুহনী চত্বরে প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। এতে ঐ দুই আওয়ামী লীগ নেতা বক্তৃতা করেন।

প্রথম আলোর (২ অক্টোবর ২০১২) প্রতিবেদনে ‘জঙ্গি রোহিঙ্গাদের সন্দেহ করা হচ্ছে’ শিরোনাম করে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। অথচ তাদের মূল প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, “রাত সাড়ে নয়টার দিকে ছাত্রলীগের নেতা সাদ্দাম হোসেন ও মৌলভি হাসানের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন লোক মিছিল বের করে। মিছিল শেষে একটি সমাবেশ হয়। এতে রামু নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম ওরফে সেলিম ও মৎস্যজীবী লীগের নেতা আনসারুল হক বক্তব্য দেন। সমাবেশের খবর পেয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজিবুল ইসলাম সেখানে যান। তিনিও বক্তব্য দেন।” প্রথম আলো পুলিশের সন্দেহকে শিরোনাম করেছে অথচ প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে তার কোন মিল নাই।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার। এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হছে দীর্ঘ দিন ধরে। শুধু তা-ই নয়, প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে যখন সাময়িক আশ্রয় চেয়েছে, সেই মানবিক আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা আদিবাসী নয়। এখন তাদের ইসলামি জঙ্গি প্রমাণ করে এবং বৌদ্ধদের বাড়িঘর জ্বালানোর প্রধান হোতা হিশাবে অভিযুক্ত করে মায়ানমারে তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও হত্যার ছুতা তুলে দেওয়া হোল। কসাইয়ের হাতে গরু জবাই করবার ছুরি তুলে দেবার মতো। একই সঙ্গে প্রমাণ করা হোল ইসলাম মূলত বর্বরদের ধর্ম, মুসলমান মাত্রই সাম্প্রদায়িক।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণ করবার জন্য কিছু রোহিঙ্গাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অথচ প্রথম আলো পুলিশের সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে জঙ্গি রোহিঙ্গারা যুক্ত আছে বলে নিজেরা যে খবর ছেপেছে সেই রিপোর্টের ভেতরে রয়েছে ভিন্ন কথা। রিপোর্ট বলছে, “হামলার ঘটনায় গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।” সমাবেশের ব্যাপারে প্রথম আলো নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রাত ১০টার দিকে তিনি লক্ষ করেন, হঠাৎ করে বিভিন্ন যানবাহনে করে শত শত লোক রামুর দিকে আসছে। ওই বহরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও ছিলেন”।

তাহলে রোহিঙ্গা এল কোত্থেকে?

সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন ছিল “রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠিত হয় জামাআতুল আরাকান”। এই তথ্যের উৎস হচ্ছে পুলিশ। এই তথ্য কোন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য নয়, কিম্বা কারো বিরুদ্ধে অভযোগ আনার পর আদালতে প্রমাণিত হওয়া সত্য নয়। পুলিশ কিছু যুবককে সন্দেহ করে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করবার জন্য “রিমান্ডে” নেওয়া হয়। রিমান্ডে তারা এইসব স্বীকার করে। রিমান্ডে কিভাবে তথ্য আদায় করা হয় আমরা তা জানি। অত্যচার-নির্যাতন ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কোন স্বীকারোক্তি আদায় করলে আইনের চোখে তা গ্রহণীয় নয়। কিন্তু রিমান্ডে নিয়ে আদায় করা এই তথ্যের ভিত্তিতে প্রথম আলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে “মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংগঠিত করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে জামাআতুল আরাকান। এ কারণে সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘জামাআতুল আরাকান’।

কক্সবাজারে গ্রেপ্তার হওয়া চার জঙ্গি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব কথা বলেছেন বলে পুলিশ সূত্র জানায়”।

সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখের প্রথম আলোতে জানানো হয়, “আত্-তাহরীদ নামের মাসিক পত্রিকাও ছিল ‘জামাআতুল আরাকানের’। সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে পত্রিকাটি গোপন প্রেসে ছাপিয়ে সংগঠনের সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে বিক্রি ও বিতরণ করা হতো। আর তাতে সদস্যদের উজ্জীবিত করার জন্য আলকায়েদাসহ বিদেশী জঙ্গিদের লেখা ও সাক্ষাৎকার বাংলায় অনুবাদ করে ছাপানো হয়”। (দেখুন, ‘জামাআতুল আরাকানের মুখপত্রে পাকিস্তানি জঙ্গিদের লেখা’)

অর্থাৎ রোহিঙ্গারা শুধু জঙ্গি নয়, এমনকি আলকায়েদার সঙ্গেও যুক্ত। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই ভাবে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রচারণা চালানো হয়েছে। বাকি আছে বৌদ্ধ উপাসনালয় ও বৌদ্ধ জনপদ পুড়িয়ে ফেলবার পেছনে আলকায়েদার হাত আবিষ্কার করা।

সেই কারণে বলি, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যারা স্থানীয় মিত্র সেই সব গণমাধ্যমের ভূমিকার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ না জানিয়ে তাদেরই রাজনীতি বহন করে যে প্রতিবাদ, তার চেয়ে নিকৃষ্ট প্রহসন আর কিছুই হতে পারে না।

আসুন, আমরা সঠিক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে আমরা যেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়ে বাংলাদেশকে ছারখার না করি।

[email protected]

(নয়া দিগন্ত, ০৪/১০/২০১২)
Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×