somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চমকাবেন না! এরকম ঘটছে...

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মার্কেটের সামনে একটি প্রাইভেট কার এসে থামলো। এলাকার গড়পড়তা আবহাওয়াটাকে হঠা‍ৎ আলোড়িত করে প্রায় একসঙ্গে চারটি দরোজা খুলে মাটিতে অবতরণ করলেন সুবেশী চার তরুণী। দেখতে তারা সবাই ‘খাপসুরত’।

গুলশান এলাকার এই ফার্নিচার মার্কেটে রাজধানীর অভিজাত লোকজনের আনাগোনা। তবে এই চার তরুণীর আভিজাত্য যেন গড়পড়তাদের চেয়েও বেশি। মার্কেটের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলেন তারা।

একটি ফার্নিচার দোকানে ঢুকে সবসেরা পালঙ্কটি পছন্দ করলেন ঊর্বশীরা। খাটটির দাম প্রায় লাখ টাকা। দোকানের ‍মালিক সরাসরি ডিল করলেন তাদের সঙ্গে। এ ধরণের কাস্টমারকে সাধারণ সেল্সম্যান বা ম্যানেজারের হাতে ছাড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়!

এই খাটটি আমরা নিচ্ছি। দামটাও ঠিক আছে। তবে আমাদের আরও কিছু শপিং বাকি; কাজ সেরে আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।

তারা বেড়িয়ে গেলেন। অপরদিকে, দোকান মালিকের চোখ ইশারায় তাদের পেছনে ফেউ (কর্মচারীদের মধ্য থেকে) লেগে গেল। কারণ, এ ধরনের শাঁসালো কাস্টমার মিস করা যায় না। মার্কেটের অন্য কোন দোকানে তারা ঢুকলেন তা জানা থাকা দরকার। যাতে পরে আবার তারা ফিরে আসলে সে মোতাবেক কথার যাদুতে বাগে আনা যায়।

অল্প বয়েসি ফেউ দু’জন কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। জানালো, নাহ্‌! তারা অন্য কোনও দোকানে যাননি। সরাসরি গাড়িতে চড়ে পাশের আরেকটি বড় মার্কেটের দিকে গেছেন।

যাক, তাহলে আশা আছে। ‘ফাঁচুকি টাইপ’ না, ঠাঁট-বাটের কাস্টমার। ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি।

কিছুক্ষণের মধ্যে মালিকের ধারণা সত্য হলো। তারা ফিরে এলেন। এবার দেখা গেল সদ্য কেনা পোশাক, শো-পিস আর ফ্যাশন সামগ্রীতে গাড়ির ঠাঁসাঠাঁসি অবস্থা।

হ্যাঁ, ওই খাটটিই আমরা নেব। তবে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে আপনাদেরকে।

জ্বী ম্যাডাম। আমাদের সে ব্যবস্থা আছে। এ ধরনের আইটেম তো আর প্রাইভেট কারে করে নেওয়া যায় না। হোম ডেলিভারির জন্য আমাদের নিজস্ব ভ্যান আছে।

বিল-ভাউচার লেখা হয়ে গেছে। তরুণীদের মধ্যে নেত্রীগোছেরটি পার্স খুলেছেন। এসময় হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলো—

ওহ, শিট! আ’হ্যাভ জাস্ট ফরগটেন। হোয়াট অ্যা ফানি থিং হ্যাপেন...ড...

ম্যাডাম! অ্যানিথিং রং?

না, মানে... আসলে হয়েছে কী, শপিংটা আমরা একটু বেশিই করে ফেলেছি। সঙ্গে এখন আর ক্যাশ নেই। আমরা আপনার খাটটি মনে হয় নিতে পারছি না। সরি!

নো প্রবলেম ম্যা’ম। ক্রেডিট কার্ড আই মিন ভিসা কার্ড অ্যাকসেপ্ট করি আমরা।

না, মানে কার্ডও সঙ্গে আনিনি। তবে বাসায় ক্যাশ আছে। থাক। সরি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।

তারা বেড়িয়ে পড়তে উদ্যত হলেন।

ম্যাডাম যদি কিছু মনে না করেন, আপনি জিনিস নিয়ে যান। ডেলিভারি দিতে আমার যে লোক যাবে তার কাছে ‍ক্যাশ দিলেই হবে।

বলছেন? ড্রাইভারের কাছে অতগুলো টাকা দিয়ে দেব!

আমার বিশ্বস্ত লোক। কোনো সমস্যা নেই।

নন্‌...না! ঠিক... এভাবে জিনিস নিলে আপনি কী না কি মনে করবেন...

ম্যা’ম প্লিজ আমাদেরকে এভাবে দেখবেন না। দোকানদারি করি বলে অতটা ‘ইয়ে’ আমরা নই...আপনাদের মত কাস্টমার...আমরা চিনি। আপনি এই খাট নিয়ে যান। ক্যাশ ক্যারি করার বিষয়ে চিন্তা করবেন না; ডেলিভারি ভ্যানের সঙ্গে আমার আরও একজন কর্মচারী যাবে।

অনেকটা অনিচ্ছা সত্বেও বিনয়াবতার তরুণীরা শেষটায় রাজি হলেন। তাদের কথাবার্তা আর কার্টসিতে মুগ্ধ দোকান মালিক থেকে নিয়ে চা আনা ‘পিচ্চি’টা পর্যন্ত।

অনেক অনুরোধেও কোল্ড ড্রিংকসের অফারটি অসাধারণ বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে নিজেদের ঠিকানাটা দিয়ে বিদায় নিলেন মনোহারিনীরা।

তদের দিয়ে যাওয়া মগবাজারের একটি ঠিকানার উদ্দেশে দ্রুতই পালঙ্কটি পাঠিয়ে দেওয়া হলো ভ্যান গাড়িতে করে। বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট হাউজের ৯ তলায় নিয়ে খাট সেট করা হলো। বিলাসবহুল অ্যাপর্টমেন্ট। মূল দরোজা দিয়ে প্রবেশের পর অফিস টাইপ ছোট্ট একটি কাউন্টার। তাতে এক নারী বসে আছেন খাতা-কলম হাতে।

তাদেরকে বলা হলো সেখানে অপেক্ষা করার জন্য।

মিনিট যায়, ঘণ্টা যায়, কিন্তু টাকা বুঝিয়ে দিয়ে তাদের বিদায় করার কোনো লক্ষণ নেই। এরমধ্যে দেরি দেখে মালিক ফোন করেছেন। জবাব শুনে বলেছেন, অপেক্ষা করতে। কোনও অভদ্রতা যেন না করা হয়।

যতক্ষণ তারা বসে আছেন, এর মধ্যে অনেক লোকই আসা যাওয়া করেছে ভেতরে। দু’একজন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলেছে। কেউ তাদের দিকে মুখ ফিরে তাকানওনি। তাদের অবস্থা ‘চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে ভেতরে রাস উৎসব’ দেখার মত। কারণ, বাড়ির (অ্যাপার্টমেন্টের) ভেতরটায় বেশ কথাবার্তা আর উৎফুল্ল হাসি-ঠাট্টার ফোয়ারা বইছিল— এটা ওই দুই ‘আদম’ পরিষ্কার টের পাচ্ছিলেন।

যাই হোক, অকারণ বসে বসে ঘণ্টা দুয়েক পার হতেই তারা রিসিপশনিস্ট টাইপ ওই নারীকে একটু তাড়া দিলেন। তিনি ভেতরে গিয়ে খবর নিয়ে এসে বললেন, আরও অপেক্ষা করতে।

বসে থাকা দু’জনের (ভ্যান ড্রাইভার ও দোকান কর্মচারীর) আর সহ্য হচ্ছিল না। এটা কেমন কিসিমের কারবার! নগদ পাওনা নিতে এসে কতক্ষণ আর এভাবে বসে থাকা যায়! তারা একটু চাপ মতো সৃষ্টি করলেন রিসিপশনিস্টের ওপর। তিনি ভেতরে গেলেন। এরপর ওই চার তরুণীর একজন এসে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কী জন্য বসে আছেন?

আমাদের ফর্নিচারের টাকাটা?

টাকা কি আপনাদের কাছে দেওয়ার কথা? অতগুলো টাকা তো দায়িত্ববান কেউ ছাড়া যার তার কাছে দেওয়া যায় না! আপনারা যান। আসল লোক পাঠান।

কিন্তু আমাদের তো আপনাদের সামনেই বলে পাঠালেন মালিক!

না, এভাবে আমরা টাকা দিতে পারি না। আপনাদের মালিককে পাঠান।

দু’জনেরই ‘আকাশ থেকে পড়া’র অবস্থা। তাদের অবাক করা চোখমুখ দেখে তরুণীর বাজখাই ধমক গাইডেড মিসাইলের মত ছুটে আসে-
যান যান। বের হন। খামাখা বসে আছেন কেন? ‘লেডি মাস্তান’ গায়ে ধাক্কা দেওয়ার ভঙ্গী করেন।

তারা দু’জন কাঁদবেন না ঝগড়া করবেন না কষে চড় লাগাবেন ওই মেয়ের গালে— ঠিক ফয়সালা করতে পারছিলেন না। এমন চোখ উল্টানো সিন বাংলা সিনেমা তো পরের কথা, খোয়াবেও কল্পনা করা যায় না!

অপমানে তাদের কান গরম হয়ে গেছে বিনা চটকানাতেই। ভবন থেকে রাস্তায় বের হয়ে এসে বসকে ফোন করা হলো।

স্যার... এ তো আজব কারবার! বাপের জন্মে এমন কাণ্ড দেখিনি...

সব শুনে বিভ্রান্ত মালিক তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলে নিজেই চলে এলেন। ওই ভবনের সামনে এসে সব শুনে তার মূর্চ্ছা যাওয়ার দশা।

কিছুটা সামলে তিনি তার লোকদের সেখানে রেখে নিজে উঠে গেলেন ৯ তলায়। এবার তার বসে থাকার পালা। আধা ঘণ্টা পার হয়, কেউ আসে না। রিসিপশনিস্টকে ঢুকেই বলেছেন তার আগমণের হেতু। তার মনে অবশ্য খটকা একটা লেগেছে— বাসাবাড়িতে রিসিপশনিস্ট কেন?

যাহোক, সে চিন্তা করে লাভ নেই। রিসিপশনিস্ট কেন, পারলে মন্ত্রী-মিনিস্টার বা পুলিশের আইজি রাখুক, সেটা তাদের ব্যাপার। আমার কাজ টাকাটা নিয়ে যাওয়া। সেটাই এখন মূল বিষয়। এগুলো ভেবে লাভ নেই। তিনি এবার জোর তাড়া দিলেন রিসিপশনিস্টকে।

গম্ভীর মুখে মহিলা উঠে গেলেন। এবার ভেতর থেকে অন্য একজন এলেন। তিনি কিছুটা বয়স্ক। তবে সাজগোজে তরুণী হয়ে থাকার চেষ্টাটা শতভাগ। দেখে বোঝা যায়— সুন্দরী আর লাস্যময়ী দু’টোই ছিলেন বয়সকালে। না জানি কত শতের রাতের ঘুম হারাম করেছেন...

ভাটার টানে থাকা ‘সুন্দরী’ শুধোলেন, আপনার ব্যাপারটা কী যেন?

আমার দোকান থেকে একটা ফার্নিচার কেনা হয়েছে। টাকাটা দেওয়ার কথা বাসায় এসেই। কিন্তু আমার লোক তিন ঘণ্টা বসে থাকার পরেও টাকাটা দেওয়া হয়নি। ‌আমাকে আসতে বলা হয়েছে। এখন আমি এসেও এক ঘণ্টা ছুঁই ছুঁই। এটা কেমনতরো ব্যাপার বলুন তো আপা? তার কণ্ঠে স্বাভাবিক ক্ষোভ ফুটে ওঠে।

ও তাই বলেন। আপনিই সেই মালিক! দেখে-শুনে তো আপনাকে বুদ্ধিমানই মনে হয়! তা এমন বোকার মত এখনও বসে আছেন কেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন না টাকাটা আপনি পাচ্ছেন না!

এবার মালিক মহাশয়ও ‘আকাশ থেকে পড়া’র ধাক্কাটা অনুভব করেন। ভারচুয়াল ধাক্কাটা সামলে তিনি গলা চড়ালেন, এসব আপনি কি বলছেন! আমার দোকান থেকে খাট নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। ঝামেলা না করে টাকাটা দিয়ে দেন।

এরপর ভেতর থেকে আরও একজন এলেন। তিনিও কিছুটা বয়সী, তবে বেশ রূপসী। সম্ভ্রম জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব।

কী হয়েছে এখানে? গলা চড়িয়ে কে কথা বলছেন?

ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের দিকে নজর পড়লো তার।

ও আপনিই সেই লোক? পাশে এসে অবলীলায় তার ঘাড়ে আলতো করে হাত রাখেন, সেকেন্ডের মধ্যে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ান। বেহায়ার মত বুকটা চেপে ধরেন তার শরীরে। মোহনীয় পরশ (ফার্নিচার মালিকের নিয়ত বদলে যাওয়ার দিকে মোড় নিতে থাকে, অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন)। ‘ভদ্রমহিলা’ মুখে বললেন, আরে ভাই! অত রাগ করছেন কেন? ক’টা টাকার জন্য এমন করছেন? আরও অনেকেই তো এখানে আসে। তারা তো টাকার জন্য এমন করে না! আপনি বরং একটু ঠাণ্ডা হন। ভেতরে আসেন। আমাদের মেয়েদের সঙ্গে একটু মন খুলে কথা বলেন

কেন?

আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না আমরা আসলে কারা, কী করি? সারা জীবন টাকাই কামালেন! একটু ডানে-বায়েও তো তাকাতে হয় লক্ষ্মী ভাই!

আমি আমার টাকা চাই!

টাকার চেয়ে ভাল বিনিময় আমাদের কাছে আছে। আমরা তো মানুষ ঠকিয়ে খাই না, ভাই! নাকি আপনার তাই মনে হয়!

মানে?

মানে সহজ। মিনারেল ওয়াটারের মত পরিষ্কার। আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে যান। পুরো রাত না চাইলে কয়েক ঘণ্টা, বা ঘণ্টা খানেক থাকুন। এখানকার আদর-যত্নে আপনার দেহ-মন ফুরফুরে হয়ে যাবে। আপনি যাকে চান তাকেই... আমি নিশ্চিত আপনার লাখ টাকার চেয়ে বেশি ফায়দা হবে। আপনি আবার আসেত চাইবেন। এটা আপনার জন্য বাম্পার সুযোগ!

মহিলা বলে চলেন, লোকে কষ্ট করে আমাদের ঠিকানা খুঁজে পায়, আর আপনি কপাল গুণে...

আজীবন ‘সঠিক লাইনে চলা’ মালিক সাহেব এতক্ষণে যা যা না বোঝার ছিল তার সবটুকু বুঝে গেছেন। রাগে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। তিনি হিতাহীত জ্ঞান যেটা অনেক আগেই হারানোর কথা তা এবার সত্যি সত্যি হারালেন—


“আমি পাড়ায় যাওয়া ধরনের লোক না! খান...মা...ছিনা... তোর শয়তানি আমি বের করছি! সবগুলোকে পুলিশে দেব...

জবাবে প্রতিপক্ষ কাঁচভাঙ্গা ক্রিস্ট্যাল হাসি হাসেন। হাসতে হাসতেই তিনি ভেতরে চলে যান। সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া ফার্নিচার মালিক খিস্তি ঝাড়তেই থাকেন। এমন সময় হঠা‍ৎই ভেতর থেকে খালি গায়ে ফার্নিচারওয়ালার চেয়েও ঝাঁঝাঁলো খিস্তি ঝাড়তে ঝাড়তে এক দানব ছুটে এল। খোসা ছাড়ানো লিচুর মত চোখ, জিন্সের প্যান্ট পরা, জিপার অর্ধেক খোলা ‘ভদ্রলোকের’ হাতে উদ্ধত পিস্তল। গুলি ভরা তাতে সন্দেহ নাই।

মা-বোন তুলে গালির গুলি ছোটাতে ছোটাতে তিনি প্রশ্ন করেন, “...কুন খান.. পুতে টেকা চায়? কই শালার... পুতে অরে অহনি খালাস কইরা দিমু...অর পাছা দিয়া গুলি...

মাত্র হাত পাঁচেক দূরে মৃত্যুদূতকে দেখে ফার্নিচারওয়ালার চুলা-গরম মাথা হঠাৎই যেন ডিপফ্রিজ হয়ে যায়। নিজেকে তিনি সাজেশন দেন— এখন করবার মত কাজ একটাই আছে, ‘দৌড়!’ জান বাঁচানো ফরজ আর দৌড়ের ওপর ঔষধ নাই! লিফটের দিকে নয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ইমার্জিন্সি এক্সিট অর্থা‍ৎ জরুরি নির্গমণ পথ দেখিয়ে দিল। চোখের পলকে তিনি সিঁড়ির প্রথম ধাপে চলে এলেন।

“ভাই, এখনকার দুনিয়ার সেরা দৌড়ওয়ালা উসাইন বোল্ট আর কত জোরে দৌড়াতে পারবেন জানি না, তবে আমার সেদিনকার দৌড়ের কাছে তিনি অনেক পেছনে পড়ে যেতেন। তাও আবার ৯তলা সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামার দৌড়! মোটামুটি আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো আমার নাদুস-নুদুস শরীরটা নিয়ে সেদিন আমি আরবী ঘোড়ার চেয়েও তেজে দৌড়েছি। প্রতি পলে মনে হচ্ছিল— এই বুঝি তপ্ত সীসার বুলেট পেছন থেকে মাথা ফুটো করে দিল!” এক নাগারে বলে থামলেন মিজান (ছদ্মনাম) সাহেব। গত সপ্তাহে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গুয়াংঝু (ক্যান্টন) থেকে ঢাকা আসার পথে প্লেনে আমার পাশের সিটে বসেছিলেন তিনি।

উড়োজাহাজ জার্নি সব সময়েই বিরক্তিকর। জাহাজ টেক অফ করার আগে আসন্ন বিরক্তিকর জার্নিটা নিয়ে উদাসী ভাব নিয়ে বসেছিলাম। আমার দু’দিকেই আরও দুই বাংলাদেশি বসেছিলেন। দু’জনই ব্যবসায়ী । বোঝা গেল মাঝখানে আমার আড়াল থাকা সত্ত্বেও কোনো এক অজানা কারণে দুই ‘কুতুব’ পরষ্পরকে সহ্য করতে পারছিলেন না। একজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতেই অপরজন খাপ্পা অবস্থা। পরে তার সঙ্গে আলাপ জমাতে গিয়েই ‍পাওয়া যায় এই ‘আজব বটে গুজব’ নয় টাইপের কাহিনী।

সম্ভবত, আমার সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি পুরো বিষয়টা উগড়ে দেন। অনুরোধ একটাই, ভাই নাম-পরিচয় প্রকাশ করবেন না। শর্ত মেনে ফের প্রশ্ন করি— যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বীরত্বের সঙ্গে পলায়নের সাফল্যেই কাহিনী শেষ করে ফেললেন? যতটুক বুঝতে পারছি, আপনার তো যোগাযোগ খারাপ না! তাদের কিছু করলেন না?

“ভাই, পুলিশে এসপি পর্যায়ে লোক আছে। যোগাযোগ করতেই তিনি বললেন, রমনা থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে। বাদবাকি তিনি দেখবেন। গিয়েছিলাম। ওসি সাহেবও আমার পরিচিত। মাইডিয়ার প্রকৃতির, যাকে বলে ‘ওপেন মাইন্ডেড’ লোক। সব শুনে বললেন, বস, কাম একখান ভুল কইরা ফালাইছেন। আপনার উচিৎ ছিল তাদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে লাখ টাকা উসুল করে আসা। আমি হলে কিন্তু তাই করতাম। মাঝেমধ্যে গা ম্যাজম্যাজ করলে আমরাও যাই বই কি! আপনাদের মত ব্যবসায়ীরা তো হর-হামেশাই যায়!

আমি অধিক শোকে পাথর হয়ে প্রশ্ন করি, তার মানে আপনারা এই কেসটা নিয়ে কিছু করবেন না?

ওসি সাহেব মুখে যাই বলুন, তাকে নীতিবান অফিসার হিসেবে জানি। আমার কথার জবাবে তিনি হাসেন। হাসি মুখেই বলেন, এই এখন আপনাকে নিয়ে সেখানে যাব। কিন্তু গিয়ে দেখবেন, কিছুই নেই। বা কিছু পেলেও সবকিছু অন্যরকম প্রমাণ করা হবে। দেখবেন এটা পিওর বাসাবাড়ি। আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন, তথাকথিত মহল্লাবাসী (সবই অবশ্য স্থানীয় টেরর), মায় আমাদের পুলিশের লোকজনও তাই বলবে। ওকে, আমি নিজে বা আরও কয়েকজন ঊর্দ্ধতন মিলে, ওপরওয়ালাদের তোয়াক্কা না করে আন্তরিক চেষ্টায় না হয় এদের পাকড়াও করলাম, উচ্ছেদ করলাম এরকম কয়েকটি আখড়া, কিন্তু কিছুদিনেই তারা বেড়িয়ে এসে আবার নয়া জায়গায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শুরু করবে একই ধান্ধা, হয়তো এবারকার ফ্ল্যাটটি হতে পারে আপনারই মহল্লায়, কিংবা একেবারে আপনার ‍বাড়ির লাগোয়া। এবং তাদের প্রটেকশন দেবে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শক্তি। সেই শক্তি এতই শক্তিমান যে, দু-চারটে ওসি তো দূরের কথা, এসপি বা তার ওপরের লেভেলও এদের ফুৎকারে উড়ে যায়।

তাহলে...

ভুলে যান। আমি কেন, আপনার এসপি সাহেবও জানেন, এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা কেসটেসে গিয়ে অহেতুক অর্থনাশ আর খারাপ কিছু লোকের টার্গেট হয়ে যাওয়া ছাড়া সুবিধা তেমন নেই। আমার ‍অভিজ্ঞতায় বলে, বর্তমান বাস্তবতায় এসব নিয়ে চিন্তা বাদ দেন। মনে করেন, চিকিৎসা বাবদে এই টাকা ব্যয় হয়েছে...কিছুদিন আগে মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা করে এক ভদ্রলোক যে কী বিপদে পড়েন, সে ঘটনা তো... থাক আপনাকে বলে আরও মন খারাপ করে দিতে চাই না...”

মিজান সাহেবের বক্তব্য শেষ হতেই আমি চেঁচিয়ে উঠি, নাম কি তেজগাঁও থানার ওসি’র? হে তো ভালয় ভালয় মিঠা কথায় আপনাকে আরেকবার টুপি পড়িয়ে দিয়েছে...দেখি, আমি ঢাকায় নেমে তার সঙ্গে কথা...

ভাই, এটা বেশ কয়েকবছর আগের ঘটনা। এ নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। সেই ওসি সাহেব এখন আর নেই। এছাড়া আমি ফার্নিচার ব্যবসা ছেড়ে এখন এক্সপোর্ট-ইমপোর্টে নেমেছি। দেখছেনই তো বিদেশ আসা-যাওয়া করি। আমি ভুলে গেছি...

না আপনি ভুলেননি! ক’বছর আগের ঘটনা? আপনার দোকানটা কোথায় ছিল? মগবাজারের ওই অ্যাপার্টমেন্ট...

ধরেন ৫ বছর, বা দশ বছর! সময় বলে লাভ নেই। তাতে কোনো হেরফের হবে না। আমার দোকান যে মার্কেটে ছিল, সেটি ছিল একটি সিনেমা হলের পাশে। এখন সেই সিনেমা হলও নেই, মার্কেটও নেই। নয়া অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে সেখানে। আমি জানি এরকম ঘটনা এখনও ঘটছে। এবং আমার মত ঠকে যাওয়া মানুষ চেপে যাচ্ছে। পুলিশ কিছু করতে পারছে না। কারণ, পুলিশ তো আমাদের মাঝ থেকেই আসছে, আর পুলিশ নামের বাঘটিকে বেড়ি পড়িয়ে রেখেছি তো আমরাই। যারা এসবের পৃষ্ঠপোষক— পারলে তাদের কিছু বলেন।

আমি বুঝলাম না তিনি কি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সময় স্থান নিয়ে এমন ধাঁ ধাঁ তৈরি করলেন কি না! কিংবা স্রেফ গুল মারলেন!

ঢাকায় নেমে তার ও আমার এক কমন-ফ্রেন্ডের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। নির্ভরযোগ্য সেই বন্ধু জানালেন, ঘটনা সত্য। তিনিও বললেন, চমকাবেন না! এরকম এখনও ঘটছে...

৩৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×