somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রঙীন দোহায় সাদাকালো ক্যানভাস-০২ (আরবদের আহার মজলিসে...)

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতি শুক্রবার এই প্রবাসে আমার জন্য নতুন কিছু নয়। অন্য দিনগুলোর মতো এ দিনটিও কেটে যায় অন্যরকম কোন উচ্ছাস ছাড়াই। স¤প্রতি সপ্তাহখানিক ধরে এতে কিছুটা রং লেগেছে।

জুমার নামাজ পড়তে চলে যাই শহর ছেড়ে। রাজধানী থেকে অনেক দূরে সীমানা পেরিয়ে। পিচঢালা সড়ক ছেড়ে চলে মরুভূমির পাথুরে সড়কে। সেখান থেকে আরও ভেতরে। ছোট একটি মসজিদে।

আরবদের মরুযাপনকেন্দ্র আর তাদের কিছু ক্ষেতখামার দেখাশোনার কাজ করেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। পুরো এলাকাজুড়ে ছাগলদুম্বার খামার। শহর থেকে অনেক দূরের এই বসতিতে জনা পঞ্চাশেক বাংলাদেশী থাকেন। একসাথে তারা জুমার নামাজ পড়তে আসেন। পরস্পরে গল্প করেন।

সবার পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জী। আমার দেখতে বেশ ভালো লাগে। আমি জানি, এই এটুকু আড্ডার প্রাণচাঞ্চল্যের শক্তিতে ওরা ভুলে আছে দেশ ও পরিবার থেকে বিচ্ছেদের বেদনা। রাজধানী দোহার চাকচিক্য থেকে অনেক দূরে ওরা অনেকটা দেশের গাঁওগেরামের পরিবেশে বেশ ভালোই আছেন নিরিবিলি।

এই লোকগুলোর সাথে নামাজ পড়তে আমি চলে আসি প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। এদের হাসিমুখ দেখি, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ওদের আড্ডা-কাইজ্যা দেখি। কয়েকজরকে দেখি, গেঞ্জিকে বুক পর্যন্ত উঠিয়ে দাঁতে কামড়ে পেট বের করে লুঙ্গি বাঁধছে, একেবারে খাটি বাংলার প্রতিচ্ছবি ভেসে আসে আমার প্রবাসআয়নায়।

নামাজ শেষ করে ফেরার পথে এক ‘শেখ’ এর বাড়িতে যেতে হয়। কোন এক অজানা কারণে তিনি আমাকে স্নেহ করেন। তার সাথে আমার কোন চাওয়া পাওয়ার সম্পর্ক নেই। নিতান্ত একজন বেচারা ছাত্র হিসেবে তিনি আমাকে ভিন্ন নজরে দেখেন। তার ওখানে আমি আমন্ত্রিত প্রতি শুক্রবার। কাতারের প্রভাবশালী এবং নামদিামি লোকদের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন।

ওখানে যাওয়ার আদব রপ্ত করতে কয়েক হপ্তা লেগেছে আমার। গেট দিয়ে ঢোকার পর সোজাসুজি খাওয়ার হলঘর, তবুও আমাকে যেতে হয় ডানদিকের মজলিসঘরে। ওখানে কয়েকজন শেখ আর কিছু পারিবারিক লোকজন বসে বসে গল্প করছেন।

একতলা এ ঘরটিতে চারদিকে সোফাবেষ্টিত। ইয়াবড় একটি টিভি এক কোণায়, দেয়ালের একপাশে অনেকগুলো শাহীকেটলি সাজানো থরেথরে। অন্যপাশে কিছু কেতাব আর ক্যালিগ্রাফির ছবি ঝুলছে।

এ মজলিসঘরে ঢোকামাত্র সবাই উঠে দাঁড়িয়ে যাবে। ডান দিক থেকে একে একে সবার সাথে হাত মেলাতে হবে। ওরা একগাদা কুশল বিনিময়ের প্রশ্ন করবে, সবপ্রশ্নের এক উত্তর, আলহামদুলিল্লাহ। একেএকে ডানদিক থেকে নিয়ে বামদিকের সর্বশেষ ব্যক্তি পর্যন্ত ঘুরে আসতে হবে। এ রেওয়াজ ও সম্মান সবার জন্য। আমার মতো নগণ্য কিংবা আরো কোন মহামান্য, যে অতিথিই আসুক।

আসনের সামনে কাঁচাখেজুরের ট্রে। একটি ছোটবাটিতে পানি রাখা। এখান থেকে খেজুর নিয়ে খেতে হবে। ওদের কথাবার্তায় হু হ্যা করতে হয়।
কিছুক্ষণ পর মজলিসের সব বড় এবং বয়স্ক লোক একসাথে খাওয়ার ঘরের দিকে যাবেন। ওখানে আরেক এলাহি কারবার। বড় বড় দুটি থালা। এর আয়তন বোঝাতে ট্রাকের বড় বড় চাকার সাইজ বললেও কম হয়।

একটিতে সাদা ভাত। অন্যটিতে রঙীন ভাত। গোলাপি রং। দুটি থালার ঠিক মধ্যখানে বড় বড় মাছের টুকরা। এই মাছের নাম জানা নেই আমার। ছোট ছোট অনেকগুলো থালায় ভাজা মাছ। সামুদ্রিক মাছগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামী ও সুস্বাদু শাহরি মাছ। আট-দশজনের জন্য কমপক্ষে বিশ-পঁিচশটি ইয়াবড় সাইজের মাছ। আমাদের দেশের বড়বড় তেলাপিয়ার আকার। স্বাদে অনন্য। একটি বড় বাটিতে ঝোল আর বড় বড় মাছের কয়েকটি মাথা। চারপাশের অনেকগুলো ছোটছোট বরতনে সালাদ আর হজমশক্তির জন্য দারুণ উপকারী পাতাপল্লব।

খাবারের এ দস্তরখানায় কোথাও পানি নেই। খাওয়ার মধ্যিখানে পানি পানের সুযোগ নেই। গপাগপ গিলছে সবাই। কেউ কেউ শুধু মাছের লোকমা খাচ্ছে। কেউ শুধু মাথা খাচ্ছে। যা খাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পড়ে যাচ্ছে থালার বাইরে। সে এক অবর্ণনীয় দশা।

ঝাল তো দূরের কথা, তেমন কোন মশলাবিহীন এ মাছের আয়োজন শরীরের জন্য দারুণ শক্তিবর্ধক। শুক্রবারের খাবার তাই হয়তো এ নেয়ামতের সম্মানে উৎসর্গিত। আমাদের মাছে ভাতে বাঙালীও এদিন আরবদের কাছে হার মানতে বাধ্য।

বড়রা খেয়ে মজলিসঘরে ফিরে গেলে ছোটরা খেতে বসবে। আমি সামান্য পোলাপান হলেও অতিথি হিসেবে বড়দের সাথে বসতে হয়।

তাদের খাওয়া শেষ হলে ড্রাইভার, খাদেম, প্রহরীরা বসবে। তারপরও যা রয়ে যাবে, তাদিয়ে কয়েকপরিবারকে আপ্যায়ন করা যাবে অনায়াসে।

খাওয়া শেষে ফিরে আসতে হবে মজলিসঘরে। খাদেমরা এবার চা পরিবেশন করবে। ধুমায়িত লাল চা কিংবা আরবের কাহওয়া। এ পদার্থটি ঠিক চা-ও না, আবার কফিও না। কি এক ইয়াক থু স্বাদের। ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসতে চায়। আরবরা ছোট ছোট পেয়ালায় করে তা চুমুক দেয়। দেখে মনে হয়, কাহওয়া পান করা নয়, এটি তামাশার বিষয়।

কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে আসার আগে এবার শুধু মেজবান শেখের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এলেই হবে। বাকি সবার জন্য সালাম দিলেই চলবে। মজলিসঘরের প্রত্যেকের সামনে গিয়ে হাসিমুখে হাত মেলানোর দায়িত্ব থেকে এবার অব্যাহতি নিয়ে বেরিয়ে আসি বাইরে।

আরবসংস্কৃতির খাঁটি পরিবেশে শেখদের সাথে প্রতি শুক্রবারের এ আহার আয়োজন থেকে আমি আরও কিছু শিখছি। সেসব নিয়ে আরেকদিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×