somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাগলা নানা

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুক্র বার। স্কুল বন্ধ। তারপরও বাবা র হাকডাকে ভোরে উঠতে হয়। ফজর এর নামাজ এর সময় বাবা বাপজান বলে এমন করে ডাকেন যে না উঠে উপায় থাকে না। লেপের মাঝ থেকে ঘড়ি দেখে শুধু মনে করি আর তিন মিনিট আর এক মিনিট শেষে লেপের উম ছেড়ে উঠতেই হয়। বাবা কে ত ভয় পাইই তারপরও এমন ভালোবাসার ডাক কি উপেক্ষা করা যায়? মসজিদ থেকে নামাজ পরে এসে লেপের মাঝে বই নিয়ে বসি। বইটি বালিশের উপর রেখে লেপ গায়ে জড়িয়ে পড়তে বসি। মাঝে মাঝে বাবা গলা চড়ান, “ পড়া শনা জাচ্ছে না কেন?” জোরে পড় ঘুমাচ্ছ না কি এসব বলে। পড়তে পড়তে যে ঘুমে বই এর ঢুলে পরি সেটা বলাই বাহুল্য। আর বাবা র গলার আওয়াজে চমকে উঠে আজগুবি এক লাইন অ্যায় অ্যায় করে পড়তে থাকি।
সকাল সাড়ে সাতটায় কলেজ ট্রেন বগুড়ার দিকে যায় এর একটু পরেই পদ্ম্রাগ মেইল ট্রেন টি সান্তাহার থেকে ছেড়ে বগুড়া হয়ে আমাদের ছোট্ট স্টেশন দিয়ে লাল্মনিরহাট এর দিকে যায়। বাবা সাড়ে সাতটার আগেই চেম্বারে জান। তার আগে তার সাথে সকালের নাস্তা করতে হয়। এটা তার কড়া হুকুম সকালে আর রাতে সে আমাদের নিয়ে একসাথে খাবেন। আজকের সকালের খাবার এর টেবিলে দেখছি গরম ভাত, বাসায় বানানো ঘী আর লাউশাক আলু দিয়ে চচ্চড়ি। অসাধারন ব্রেকফাস্ট। বাঙ্গালীএর এর চেয়ে ভালো ব্রেকফাস্ট আর কি হতে পারে? খেয়ে দেয়ে আবার বাবা কে দেখিয়ে দেখিয়ে বই নিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়ি। আর বাবা চেম্বারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। বুঝতেই পারছেন মহা ফাকিবাজ আমি।
বাবা চলে যাওয়ার পর বই খোলা রেখেই বালিশের নিচ থেকে গল্পের বই বের করি বা খুটি নাটি জিনিস বের করে আমার জগতে চলে যাই। শুক্র বার মা বাসায় থাকেন। তাই একটু ঈদ ঈদ ভাব থাকে। সারা সপ্তাহ চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুন মা কে কাছেই পাওয়া হয় না। আমার জগতে থাকলেও দরজার ফাক দিয়ে গেটে আমার তৈরি এক বিশেষ ফুটোর দিকে নজর থাকে। হঠাৎ বাবা চলে আসলে খবর আছে। মাঝে মাঝে যে এ ফাকিবাজির কারনে চড় থাপ্পর জুটে যায়। হঠাৎসেই ফুটোয় দেখে বুঝতে পারি কেউ আসছে তাই তারাতারি বাথ্রুমে যাওয়ার ভান করে বারান্দায় আসি। এসেই দেখি গেট ঠেলে পাগলা নানা ঢুকছে। তিনি আমার নানি বাড়ি থেকে আসছেন। প্রতি শীতেই নানি আমাদের জন্য আটা কুটে আর এর সাথে না না রকম জিনিস পাঠান। আর এই নানা যাকে বোঝার বয়স থেকে এমনি দেখছি তিনি সেগুলো ভাড়ে করে নিয়ে আসেন।
গায়ে তার ঝোলা ধরনের শার্ট তার উপর হাটু পর্যন্ত লম্বা পুরোন সয়েটার খালি পা আর লুঙ্গী উচু করে পরা। তার মুখে টি লম্বাটে ছোখা ধরনের। মাথায় পাতলা হয়ে আসা চুল। খালি পায়ে থাকার কারনে ধুলোর আস্তর পরে আছে ফাটা ফাটা হয়ে আসা চামরা গুলতে। কালচে তামাটে গায়ের রঙ। আসল রঙ কেমন ছিল তা ভাবার কে আছে পৃতিবীতে? বাঙ্গালী নদীর দারে আমার নানা দের পুর্ব্বর্তি বাড়ির পাশে তাদের বাড়ি ছিল শুনেছি। নদী ভাংতে ভাংতে সবই শেষ হয়ে গেচে। আমার নানার বাবা পাশে কিছু জমি কিনে রেখেছিলেন সেখানে চলে আসেন আর তার পাশে এই পাগলা নানা র বাবা দের এক্টুক্র জমি দেন ঘর করার জন্য আর চাষবাসের জন্য দেন কিছু জমি। স ঋণই বোধ হয় তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে শোধ করছে। তাকে পাগলা বলার কারন বছরের কোন এক বিশেষ সময়ে সে উধাও হয়ে যায় এক মাস পর ফিরে আসে। কই যায় কি করে কেউ জানে না। আর মানুষ এর সাথে কথা বলে কম মনে মনে কথা বলে বেশি । একা একা বিড় বিড় করে তাই মানুষ তাকে পাগল বলে।
নানা বাড়িতে যখনি যেতাম তার গায়ে কখনই কাপড় দেখতাম না এক লুঙ্গী ছারা। শীতের সময় একটা চাদোর জরান থাক্ত উদোম গায়ে। আমরা গেলেই সে গুটি গুটি পায়ে এসে আমাদের খোজ খবর নিত। মা কে সু বলে ডাকত। আমার মা তার উপর ভীষন রাগ করত কারন তাকে প্রতি বারই নতুন বাবা পুরোন যা কাপড়ি দেয়া হোক না কেন সে সেটা কাউকে দিয়ে দেবে না হয় হারিয়ে ফেলবে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে কোন উত্তর দেয় না শুধ্য চুপ করে মাটির দিকে অপ্রাধীর মত চেয়ে থাকে।
বুড়ো বয়সে তাকে এখানে ওখানে যাওয়া ছাড়া নানি তাকে আর তেমন কোন কাজ দেন না। তবে প্রতি বেলাতেই অবস্মভাবি ভাবে তার জন্যও ভাতের চাল দেয়া হয়। এই অজপাড়াগায়ে রাত ৮ টা বাজতেই ঘড়ির কাটার শব্দ অন্য শব্দ কে ছাপিয়ে যায়। আমি নানা বাড়িতে গেলে খাটের পাশে যে বাক্সের উপর ঘুমাই তার পাশের জানালার ধারে বারান্দায় খর বিছিয়ে তার উপর কাথা বিছিয়ে নানা বিছানা করে থাকেন। তার ঘর থাকলেও সে কিছুতেই সেখানে ঘুমুবে না। শীত হোক ঝড় হোক সে এখানেই থাকবে। রাতে শুয়ে সে বিড়বিড় করে যেন কারো সাথে কথা বলে কখন নাকি সুরে যে কাদে আর অনেক সময় আপন মনে সুরেলা কন্ঠে পুথি পরে। পড়তে জানে না পুথি তার শুনে শুনে মুখস্ত। নিশুতি রাতে শুয়ে শুয়ে এমন করুন শুরে পুথি পড়া শুনতে শুনতে হারিয়ে যেতাম কোন এক জগতে। সেই ঘোরের মাঝে এক্সময় ঘুমিয়ে পরতাম। ছোট বেলায় নানা বাড়িতে বড় উঠন পেরিয়ে আড়ার পাশে পেশাব করতে যেতে ভয় পেতাম তখন নানা কে ডাক্লেই সে সারা দিত যত রাতি হোক। আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বলত “ভয় নেই আমি আছি” । সত্যি তার দৃড় কন্ঠে আর চোহগুলোতে এমন কিছু ছিল যে নিশুতি রাতের ভয় করা পরিবেশ টা আর থাকত না।
এ নানা যুবক বয়সে আমার নানা র বড় ভাই মানে আমার বড় নানা র সাথে থাকত। বড় নানা ছিল ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার, ব্রিটিশ সরকারের আমলা। তার সাথে থাকতে থাকতেই কি না কে যানে সে কথা বলত শুদ্ধ উচ্চারনে মাঝে মাঝে ইংরেজি বলত দু একটা সেটাও শুদ্ধ উচ্চারনে। আর তার সাহেবি কেতায় পায়ে পাতুলে সকাল বিকাল একেবাএ শব্দ না করে চা খাওয়ার স্টাইল এসবই গ্রামের সাধারন মানুষ দের কাছে পাগলামো মনে হত। নানা কে জিজ্ঞেস করতাম কোথায় কোথায় ঘুরছেন আপনি? এটা তার খুবই পছন্দের একটা প্রশ্ন। সে ঘুরতে খুবই পছন্দ করে আর আমার ঐ নানা র সাথে ভারত বর্ষের অনেক রাজ্যে সে ঘুরেছে। এ প্রশ্ন করতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠত। একটা দম নিয়ে শুরু করত চট্টগ্রাম থেকে থামত কালিম্পং এ। আর শেষ করেই সে কালিম্পং শহরে কি করে পাহাড় পেচিয়ে পেচিয়ে উঠতে হয় তার বর্ননা দিত। তার সে সময় এর গল্প গুলো আমার কাছে খুবই ভ্লো লাগত। তাই নানি বাড়ি গেলেই আমি তার পেছনে লেগে থাকতাম।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই কিন্তু জীবন শিক্ষায় পরিপূর্ন ছিল এ মানুষটির জীবন। সে মাঝে মাঝে গ্রামের এর ওর বাড়িতে গিয়ে তাদের খোজ খবর নিত। কেউ কেউ বিরিক্ত হত কিন্তু তার কোন বিকার ছিলনা। সে এসব তুচ্ছ জিনিস গায়ে মাখত না।
আমার যে নানা র সাথে তিনি ছিলেন সেই নানা র ছেলে মেয়ে রা মানে আমার মামা রা আজ দেশের বড় বড় আম্লে। সময় পেলেই দেশের বাইরে বা ঢাকার বাইরে এখানে সেখানে বেড়াতে যান। কিন্তু তাদের নাড়ির টানে গ্রামে আসা হয়ে ওঠেনা মাঝে মাঝে বাবা তাদের সাথে কথা বলত ফোনে। আস্তে বলত বাড়িতে তখন তার কথা রাস্তার কি অবস্থা? কারন গ্রামের ভাঙ্গা রাস্তায় তাদের গাড়ি ঢোকে না। কোন একবার হয়ত গাড়ির চাকা ডেবে গিয়েছিল সেই ভয় তার এখন কাটেনি। আর গ্রামে ছেলে তার স্ত্রী রা টয়লেট করতে পারে না। বিরাট সমস্যা। হয়ত বছর পাচেক পর একবার আসে কিন্তু বিকাল না হতেই উধাও। আসার আগে আমার নানি তার ভাতিজার জন্য তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নানা কিছু রান্না করেন। কত আয়োজন। আমি মনে মনে খুশিই হই কারন যাদের জন্য এ আয়োজন তারা এসব বেশই খাবে না তাই পরে আমার খয়াটা ভালোই হয়। অনেক মনে করে সে এই পাগলা নানা র সাথে দেখা করেন ছবি তোলেন। সেই সময় নানা হঠাত করেই যেন শিশুর মত কেদে অঠেন। এ কান্না কোন কিছু চাওয়ার নয় শুধু ভালোবাসার। শহর এর আমার মামাত ভাই বোন রা যেন একটু বিরক্ত হয়ে যায়। মামি এক কোনে মুখ কালো করে বসে থাকেন যেন এসেই ভুল করেছেন এই জঙ্গলে। অনেকে নানা কে এক দিকে সরিয়ে দেয় বা রাগা রাগি করে কান্না থামানোর জন্য। কিন্তু কেউ জানে না কত স্মৃতি কত ভালোবাসা র কান্না এটি।
এই পাগলা নানা র মত মানুষ রা নিজেদের উতসর্গ করেছে মানুষ এর জন্য। তাদের উতসর্গের মুল্য হত আমরা বুঝতে পারি না। বা বোঝার মতও নয়। অনেক জটিল এ উতসর্গের ধরন। তার নির্বিকার মুখের দাকে তাকিয়ে কখন দুঃখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেখানে অপার্থিব কিছু সুখের অনুভূতি খেলা করে।
মাঝে মাঝে মনে হয় এ পাগলা নানা র মতও পাগলা হতে পারলে খারাপ হত না।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×