somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আপনই দাগ রেখে গেল

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৩:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আপনই দাগ রেখে গেল
.........শোকাঞ্জলি : আপন মাহমুদ...

দূরের কাশবন যত ঘন, নিকটে তত নয় কেন? হাওয়ায় দুলে দুলে ওঠে ছোট্ট প্রশ্ন। প্রশ্ন গভীর হয়ে ওঠে।

বেশিরভাগ কাশবনই নদীপাড়ে, কেন? কাশবন কি নদীপাড়ে অধ্যাপনা করে? নদীর ওপার থেকে যা আসে, তা কি মাত্রাবৃত্ত হাওয়া? বর্ণমালা শিখেছে, কাশবন? কাশবনের কি ভাষাজ্ঞান ভালো? তাহলে যে ডাক দেয় কাশবন, কাশবন কীভাবে ডাকে, ডাকতে পারে? কাশবন কি ইশকুলে গিয়েছে কখনো? কাশফুল কলেজে পড়েছে? কাশবনের ভেতর দিয়ে পায়ে পায়ে হাঁটা পথ কোথায় চলে গেছে? পথ হাঁটে, না পথিক হেঁটে যায়?

কাশবনের প্রশ্নগুলো, ছোট, ছোট প্রশ্ন। তবু এই প্রশ্ন গভীর হয়ে ওঠে। প্রশ্নগুলো গভীরতর হয়। প্রতিদিন ইশকুলে যেতে যেতে কাশবনের সঙ্গে কথা হয়, কার? কাশবন কি জানে, এই ইশকুল-বালক একদিন হাওয়া ধরতে নদীর ওপার যাবে?

সেই ইশকুল-বালকের সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যাবে রেলব্রিজের সন্ধেটার, দিগন্ত-গমনের রেললাইনের। তার চোখে দেখা হবে দ্রাঘিমাংশের অসংখ্য আকাশ। আকাশ কি অসংখ্য? আকাশ কেনই বা নীলবিস্তারি কার্টিজ পেপারে, একটুখানি জল মিশিয়ে ওয়াশ দিলেই ঘন মেঘ দানা বাঁধবে! এক প্রকার মরমি শূন্যতা ছাড়া আকাশের কোনো দার্শনিক উপস্থিতি আছে? আকাশ কি ঈশ্বরের বিছানা-চাদর? ঈশ্বর কি তবে আকাশে ঘুমায়? ঈশ্বর ঘুমায় কখন? দিনে, না রাতে? ঈশ্বরেরও দার্শনিক উপস্থিতি কী এক ধরনের নীলাভ, শূন্যতায় ভরা অতিদূর স্পেসের বিস্তীর্ণ ক্যানভাস?

খালি প্রশ্ন ছুটে আসে, প্রশ্ন ছুটে যায়। প্রশ্ন ক্রমশ গভীর হয়। প্রশ্ন বুদবুদ হয়ে ফোটে। প্রশ্ন বিচ্ছুরিত হয়। প্রশ্ন ফেটে যায়। আবার প্রশ্ন জন্মায়। প্রশ্ন জন্মায় পাথর শিলায়। প্রশ্ন, পাহাড় হয়ে ওঠে। প্রশ্ন পাদদেশ থেকে হাঁটতে হাঁটতে চূড়ো স্পর্শ করে। ইশকুল-বালককে ডাক দেয় পাহাড়। সেও চূড়োয় উঠে যায়। সেও মেঘ ধরতে যায়। সেও আকাশে হাত বাড়ায়। সন্ধ্যায়, তার হাতের আঙুল ছুঁয়ে ফ্যালে নক্ষত্র-মার্বেল, ছুঁয়ে ফ্যালে চাঁদ, চাঁদ কিম্বা চাঁদনি, চাঁদনিই পূর্ণিমা মুখোপাধ্যায়। ইশকুল-বালক চিরকাল ভালোবাসে নক্ষত্র-মার্বেল আর আদিগন্তের পটে আঁকা পূর্ণিমা মুখোপাধ্যায়কে। পূর্ণিমা তাকে প্রশ্রয় দেয়। এই চাঁদ, চাঁদনি জানে, একরাতে কাউকে না বলে খুব একা একা হারিয়ে যাবে বালক। তাই, এই বালককে দেখে রাখা দরকার।

সন্ধ্যার পর, বাঁশবাগানের পথ পাড়ি দিয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে সার্কাস দেখতে যাবে, গভীর রাতে বাড়ি ফিরবে, ঘরে ঢুকবে, বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দেবে কিন্তু ঘুমোবে না। ইশকুল-বালক অনিদ্রার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে পৌঁছে যাবে এমন এক মন্ময় ভুবনে, যেখানে তার জীবনের শিরোনাম তরুণ কবি, যেখানে তার স্বপ্ন আর বাস্তবতা এক সুতোয় বাঁধা। সুতোয় টান পড়লেই নড়ে ওঠে স্বপ্ন-বাস্তবতার ঝোপঝাঁড়। রহস্যবনের ধারে প্রতিষ্ঠিত ঘোর মহাবিদ্যালয়। তরুণ কবি সেই মহাবিদ্যালয়ের রেগুলার স্টুডেন্ট। তরুণ কবি ঘোর-বিদ্যালয়ের বারান্দায় একা হেঁটে বেড়ায়। অদূরে, মাঠের শেষে বিদ্যালয়ের অন্য এক বারান্দায় ইটের চুলো বানিয়ে, হাঁড়ি চাপিয়ে ভাত রান্না করে এক পাগলি। তার হাঁড়ির ভেতরে ভাত নয়, ব্যথা ফুটে ওঠে। আহত নক্ষত্রের কণা ফুটে ওঠে। হাড়ির তলায় দুঃখ পুড়ে যায়। সেই পোড়া পোড়া ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ কবি পোড়া ঘ্রাণের কবিতা লিখতে চায়। ঘ্রাণেই তরুণ কবির পাঁজর পুড়ে যায়। ভালোবাসা আগুন হয়ে তরুণ কবিকে পোড়ায়। সে কথা জানে কেউ কেউ, কাশবন, পাহাড়, নীল গগনের বিছানা-চাদর কিংবা বাঁশবাগানের পথ। তারা জানে, তরুণ কবি খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। হয় হারিয়ে যায়, নয় মরে যায়। পৃথিবীর কোনো হাসপাতাল তরুণ কবিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না। কোনো ডাক্তার, কোনো নার্স তাকে বাঁচাতে পারে না। কোনো ওষুধ তার জন্য কাজ করে না। তরুণ কবি মরে যায় হূৎপিণ্ডের রক্তক্ষরণে।

তরুণ কবির কবিবন্ধুরা অটোমেটিক্যালি শববাহকের দায়িত্ব কাঁধে পায়। তারা শহর ছেড়ে প্রান্তরে ছুটে যায়। কবিবন্ধুরা বুঝতে পারে, প্রয়াত বন্ধুর শব হয়তো আজ তাদেরই শব। সেহেতু, নিজেদের শব নিয়ে তারা নিজেরাই ছুটে যায়, নিজের পাঁজরের আগুনে তারা নিজেরাই পুড়ে যায়, নিজের নিঃশ্বাসে তারা নিজেরাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। হয়তো কোনো অশ্রু আসে না তাদের, তাদের চোখে, তবু সমস্ত উচ্ছ্বাস মরে যায়। ক দিনের জন্য ছুটি হয়ে যায় ঘোর মহাবিদ্যালয়। সম্পূর্ণ আকাশ একটি অর্ধনমিত পতাকা হয়ে শূন্যে ভেসে থাকে। কারণ, তরুণ কবি সিরাজুল হাসান মান্না হারিয়ে গেছে। তার শব নিয়ে বন্ধুরা ছুটে গেছে মধুমতির পাড়ে, পহরডাঙায়। আত্মহত্যার পর শামীম কবীর শুয়ে আছে বগুড়ায়। কাজী সোহেল সিলিং ফ্যানে ঝুলে আছে ঝিনাইদহে। সুমন প্রবাহনকে গিলে খায় নিদ্রামগ্ন ট্যাবলেট। রাস্তায়, গাড়ির ধাক্কায় ‘গুডবাই’ বলে পৃথিবীকে শেষবার দেখে নেয় রাকিবুল হক ইবন। যথারীতি বন্ধুরা কাঁধে করে নিয়ে যায় লাশ। লাশ কি বন্ধু? লাশ কি কারও প্রেমিক, লাশ কি কখনো নিউলি ম্যারেড হাজব্যান্ড? লাশ হয়ে যায় তরুণ কবি। তরুণ কবিই কি সব সময় লাশ হতে চায়?

খুব বৃষ্টি নামে। খুব মেঘ আনাগোনা করে। সঞ্চয় প্রথমকে আমরা আর কোনোদিন খুঁজে পাই না। কী যশোরে, কী বাংলাদেশে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, একদিন আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম আবুল হাসানকে, সুনীল সাইফুল্লাহ, অনন্য, তুষার কিংবা ফাল্গুনী রায়কে। কারণ তারা তরুণ কবি। কারণ তারা একদিন কিংবা অনেক-অনেকদিন বনভূমির মধ্যে নিজেরাও অনেক বনভূমি হয়ে ছিল। আবার তারাই দাবানল হয়ে ছিল। কারণ তারাই প্রেমিক এবং ‘পরাজিত মেঘদল’ হয়ে ছিল। গ্রাম-প্রান্তের আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে এসেছিল সেদিনের ইশকুল-বালক, আজকের তরুণ কবি। গৌরব হারানো গঞ্জের বাজারের ডাকঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে এসেছিল তরুণ কবি, ছোট শহরের গলি দিয়ে হাইওয়েতে হেঁটে এসে পড়েছিল তরুণ কবি। মহানগরীর ভাঁজে ভাঁজে চাপা খেয়ে গুমরে ওঠা তরুণ কবি, ছাপাখানার কালিতে কালিতে বিলীন হয়ে যাওয়া তরুণ কবি, নক্ষত্র-মার্বেল খেলা তরুণ কবি, পূর্ণিমা মুখোপাধ্যায়ের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া ত. ক। ত হচ্ছে তরুণ, ক হচ্ছে কবি।...আয়নায় তাকিয়ে আত্মপ্রতিকৃতির বদলে রাক্ষসের মুখ দেখা তরুণ কবি, অসংখ্য স্বপ্নময় পিরামিড পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়া তরুণ কবির বুকপকেটে জমে যায় দীর্ঘশ্বাস, তখন, তরুণ কবি মরে যায়।

পাখিদের মধ্যে শালিকও একটা পাখি। শালিকেরাও দল বেঁধে ঘোরে, দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। তবু শালিকের নামে মানুষ বলাবলি করে, শালিক নাকি একলা পাখি। দলবদ্ধ থেকেও শালিক নাকি একা হয়ে যায়। একটা একলা শালিক কী করে, কী ভাবে? শালিক কি কোনো তরুণ কবি? তরুণ কবিরাও দলবদ্ধ হয়ে ঘোরে, তরুণ কবিরাও ডানা মেলে ওড়ে, দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যায়, দল বেঁধে শুঁড়িখানায় যায়, পাহাড়ে যায়, প্রান্তিকে যায়; কিন্তু তরুণ কবিও যেহেতু শালিক হয়ে থাকে, তাই তরুণ কবিও দল থেকে হঠাৎছিটকে যখন তখন একলা হয়ে যায়। তরুণ কবি দলছুট হয়ে যায়। তরুণ কবি সম্রাট হয়ে ওঠে, নিরোর কাহিনি তার মুখস্থ, তরুণ কবি আপন পাঁজরের হাড় খুলে বাঁশি বানায়, তরুণ কবির হাড় থেকে বাঁশি শোনা যায়। একদিন তরুণ কবির সাম্রাজ্য-সিংহাসন পুড়ে যায়, কবি পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। ফিনিক্সের ভস্ম থেকে ফিনিক্স জন্মায় বটে, তরুণ কবির ভস্ম থেকে জন্ম নেয় শব্দ, বাক্য, সেই শব্দ-বাক্যই কবিতা হয়ে ওঠে। কিন্তু তরুণ কবি যখন শালিক পাখি, তখন কবি ভিজতে থাকে একা, আদিগন্ত বৃষ্টির মধ্যে সারা দুপুর ভিজতে ভিজতে তরুণ কবি ভেজা শালিক হয়ে যায়। তখন তার মন খারাপ হয়। তখন তার মনের মধ্যে হুহু করে হিঙুল রঙের মেঘ, তখন তার মনের মধ্যে হাহাকার, হাহাকারই বাঁশি হয়ে বাজে। যে বাজায়, তরুণ কবি। যা বাজে তা হাহাকার। ‘হাহাকার তুই কেমন আছিস’ প্রশ্ন করে তরুণ কবি, শালিক ডেকে ওঠে। শালিক পেশাজীবী হতে পছন্দ করে না। তরুণ কবি চাকরি পছন্দ করে না। পেশাকে পায়ে ঠেলে এগুলেই তার স্বাধীনতা কী নিশ্চিত হয়। পেশা, তরুণ কবির কাছে পরাজয়।

কোথায় যেন বিয়ে হয়ে যায় যুঁথিকার। কোথায় যেন সংসার করতে যায় ঊর্মিমালা। কোথায় যেন যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে বছরের পর বছর গার্হস্থ্য-কয়েদে পিষ্টে যায় সুমনা। ওরা, যে যার মতোই জানে, তরুণ কবির সঙ্গে আর দেখা হবে না। তরুণ কবিকে তাদের মনে থেকে যায়; কিন্তু তরুণ কবি আর মনে করতে পারে না, কোথায় কী ঘটেছিল একদিন, এক পলকেই। কোথায় কার চোখ দেখে মনে হয়েছিল, তার চোখই ল্যুভ মিউজিয়াম, কার চোখ? কার বুকে দূতাবাস, কোন দেশের? কার বুকে ভিসা পাওয়া যাবে, অপাপবিদ্ধ মায়াবী ঘরবারান্দার? খালি, খালি খালি লাগে। একলা-ফেকলা লাগে। শালিক শালিক লাগে। একদিন, শালিকটা মরে পড়ে থাকে গলির মোড়ের দোকানের পেছনে। একদিন মনে হয়, এ জীবনে একবার কঙ্কনাকে শুধু মন ভরে দেখা পেতে চাই। অনেক প্রশ্ন আছে, কঙ্কনা ছাড়া কেউ উত্তর জানে না; কিন্তু প্রশ্নগুলো করবার আগেই, মোদ্দা কথা, কঙ্কনা বা সুপর্ণার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই একদিন হাসপাতালের বিছানায় তরুণ কবি টুপ করে মরে যায়।

পেশা অপছন্দকারী, নেশায় প্রগলভ, শালিক বা তরুণ কবিকে কোনো গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার পোছে না, পোছার বিষয় নয় সরকারের, কে তরুণ কবি, সে বেঁচে থাকলে বেঁচে আছে কেন, বেঁচে না মরে গেছে কী না। সরকারি দল, বিরোধী দল, বামপন্থী দল, ডানপন্থী দল যত কর্মসূচি দিয়েছে, সেখানে তরুণ কবির কোনো স্থান নেই। বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, বণিক সমিতি, করপোরেটক্রেসি রেলিং বা ব্রোকার হাউসেও তরুণ কবির কোনো নাম নেই। ফলে, আমাদের তরুণ কবি আপন মাহমুদ যখন মরে যায়, হাসপাতাল তাকে গ্রহণ করতে চায় না। জীবিকাখানার উপরলারাও তাকে প্রফিটেবল ভাবতে পারে না। আপন মাহমুদ আলগোছে চলে যায় কাশবনের দিকে, যে কাশবন তাকে ইশকুল-বালক বলে ডাকত। আপন চলে যায় সন্ধ্যার বাঁশবাগানের দিকে, ওখানকার পাখিরা তাকে মনে রেখেছে। তার জন্য কিচিরমিচির সভায় শোকপ্রস্তাব করে তারা প্রতিটি সন্ধ্যায়। আপন মাহমুদ হারিয়ে গিয়ে তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার সঙ্গে আড্ডা জমাতে যায়। আপনই আমাদের মনের মধ্যে গোপনে একটা দাগ রেখে যায়। জানি না, হারিয়ে যাওয়া তরুণ কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের সঙ্গে আপনের দেখা হবে কি না। বিষ্ণু নাকি এখনো বেঁচে আছে, অন্য গাঁয়ে, অন্য ভুঁইয়ে। ফেসবুকে বিষ্ণুর ছবি দেখা যায়। ফেসবুকে, ব্লগে আপনের ছবি আপলোড হয়। আপনকে আমরা ভুলতে পারব না এ কারণে যে, খুব ভালো কবিতার হাত ছিল ওর। ‘সকালের দাড়ি কমা’ থেকে ‘মা ও প্রজাপতির ডানা’র ঝাপটানি লিখে গেছে আপন মাহমুদ। ওর সঙ্গিনী বীথিকে আমরা কী বলে সান্ত্বনা দেব? আর বীথিও সেই সাহসী একজন, যে এক তরুণ কবিকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছিল। বীথিকে আমরা কীভাবে ফেরত দিই, ওর আপনকে? মফস্বলের ম্রিয়মাণ উঠোনে দাঁড়ানো আপনের বাবা-মা ও ভাই-বোনকে আমরা কী দেব আজ?

আপনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা এই যে, কাছে-দূরে যেখানেই থাকি, ও আমাদের খুব আপন ছিল। বরং আমরাই ওকে দেখে রাখতে পারিনি। কারণ, আমরা প্রায়শই ভুলে যাই যে, তরুণ কবি আসলে কী চায়, কী প্রার্থনা করে? কী তার পিপাসার্ত অলিখিত ভাষা? খুব ভালো করে কখনোই জানা হয় না তরুণ কবিকে, কেন সে নক্ষত্রের দেনা নিয়েছে মাথায়? এভুবনে আমরা তরুণ কবির নামে কোনো মনুমেন্ট হতে দেখিনি কখনো, দেখিনি কোনো স্থাপনা। সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যায় কোলাহল করে ওঠে নাগরিক পানশালা। বড় জোর পানশালার একটি টেবিলে জ্বলে ওঠে তার শব-বাহক বন্ধুদের চোখ, বন্ধুদের জ্বলন্ত চোখের ভেতরে আত্মগোপন করে থাকে অকাল প্রয়াত মানব সন্তান, সভ্যতার তরুণ কবি। আপনও কি আজ সন্ধ্যায় জ্বলে উঠবে না বন্ধুদের চোখে? বন্ধুরা বেঁচে থাকবে। তারা তাদের চোখ দিয়ে কত কিছু দেখে যাবে দুনিয়ার। শুধু হারানো কবিবন্ধুকে আর খুঁজে পাবে না। আমরা আর কোনোদিনই খুঁজে পাব না আত্মনিমজ্জিত সেই মুখ, যেমুখ আপনের, যে কীনা বিষণ্নতাগ্রস্থ পৃথিবীর খুব বিপন্ন সত্বা, আমাদের তরুণ কবিবন্ধু!

আপন, তুই কেমন আছিস বন্ধু? আপন, তোকে আমাদের হারিয়ে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হলো না। আপন, তোকে নিয়ে স্মৃতিচারণের ইচ্ছাটাকে ভালো লাগছে না। আপন, তোর কবিতাগুলো পড়ব। তোর কবিতার ভেতর দিয়েই তোকে আবার, বারবার ধরব। আপন, তোর একটা লাভ হলো এই, তুই কখনো বুড়ো হবি না। বার্ধক্য তোকে কখনো ছুঁয়ে ফেলবে, এই সুযোগ তুই নিজেই রাখলি না। তোর সঙ্গে তো আর কথা হবে না, তোর কবিতার সঙ্গে আমরা কথা বলব। ‘রজনীগন্ধা কেন সবজি নয়’ তোর এই জিজ্ঞাসা আমাদেরও জিজ্ঞাসা হয়ে থাকল।

আবারও জিজ্ঞাসা, মানে প্রশ্ন। ছোট প্রশ্ন বাড়তে বাড়তে বড় প্রশ্ন হয়। প্রশ্ন গভীরতর হয়। আমরা কাশফুলকে প্রশ্ন করি। পাহাড়কে প্রশ্ন করি। মরুভূমিকে প্রশ্ন করি। প্রশ্ন করি পাতা ঝরে যাওয়া একটা গাছকে, ও গাছভাই, তোমার পাতাগুলো কোথায়? পাতাগুলো ডানা মেলে উড়ে গেছে, পাতাগুলো পাখি হয়ে গেছে। পাখি সব মেঘ হয়ে যায়, মেঘ কিছুদূর উড়তে উড়তেই তুমুল ঝরে যায়। তখন আমরা সেই মেঘকে বলি, পরাজিত মেঘ। তবে কি আপন মাহমুদ পরাজিত মেঘ হয়ে গেছে?

ওর কবিতার খাতাগুলো কে ছুঁয়ে দেখবে এখন? রেখে যাওয়া ওর,পোশাক-আশাক আর কেউ কি পরবে কখনো, ওর জুতো-স্যান্ডেল? ওর কাঁধের ব্যাগটা কে কাঁধে নেবে? ও আমাদের তরুণ কবি, আপন, ওর তাকানোটা আর কে তাকাবে? ওর হাঁটাটা আর কে হাঁটবে? ওর হাসিটা আর কে হাসবে? ওর বেঁচে থাকা তো ওই বেঁচে থাকল না। ওর ভালোবাসাটা আর কে ভালোবাসব?
.................................................
দৈনিক ইত্তেফাক : ২১/০৯/২০১২
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৩:১৫
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×