somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

""ছোট বেলার ভয়ানক ঘটনা""- এখন মনে হয় just ঘটনা /:)

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বাবা চাকরী করেন একটা জুট মিলে উপ সহকারী প্রকৌশলী পদে। প্রতিদিন সকাল ছয়টায় অফিসে যান, দুটোয় বাসায় ফেরেন। সপ্তাহের বৃহস্পতি-শুক্র ছাড়া বাবার সাথে দুপুরের খাবার খাওয়া হতনা।
সেদিনও ছিল বৃহস্পতিবার। স্কুল ছুটি শেষে বাসায় ফিরে পুকুরে দাপাদাপি করছি, বাবা আসার সময় হয়ে আসায় মা উঠে আসার তাগাদা দিলেন। আমরা সব ভাই-বোন বাবাকে বেশ ভয় পেতাম সে সময়, এখন অবশ্য বাবার রাগ অনেক কমে গিয়েছে। গোসল সেরে উঠে আসতেই বাবা ফিরলেন। ফিরেই জিজ্ঞেস করলেন আমাকে ,"তোদের স্কুলের কোন ছাত্রী কি এই কলোনীতে নতুন এসেছে এ মাসে?"
কই, না তো! - আমার চকিত উত্তর।
আমরা এই কলোনীতে আছি তখন প্রায় পনের বছর, কলোনীতে কে আসলো কে গেল এটা মোটামুটি আমাদের জানা থাকতো। আমাদের বাড়িওয়ালা আর আমার বাবা অনেকটা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, মা জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন?
--স্কুলের ইউনিফর্ম পরা এক মেয়েকে দেখলাম সোহেলদের বাসায় ঢুকতে। তুমি একটু দেখে আসো তো কে এলো?
-- হবে হয়তো কেউ স্কুল থেকে কোন কাজে এসেছে, এত মাথা ঘামানোর কি দরকার!!
-- ব্যাপারটা মোটেই অতটা সাধারণ না, গেটের সামনে দেখলাম, আলম, কায়সার আরো কয়েকটা ছেলে পেলে দাঁড়িয়ে, ওদের তো কোনদিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি, তাই।

অনেকদিন থাকার কারণেই বোধহ্টাকলোনীর সব কিছুর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো মা-বাবার। মা আমাদের খাবার দিয়ে সে দুপুরেই গেলেন, গিয়ে দেখেন সোহেলদের বাসা থেকেই এক মেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু স্কুল ইউনিফর্ম পরা না, একেবারে সেজেগুজে। মা এসে বাবাকে জানানোর পর বাবাকে চিন্তিত দেখালো। আমিও যেন একটু রহস্যের গন্ধ পেলাম, তখনও শহরের আলো বাতাসে মন কলুষিত হয়ে যায়নি বলেই হয়তো। এখন রিকশাতে চড়া পশু-পাখি দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে। কোন কিছুই আর মনে আগের মত দাগ কাটতে পারেনা।
যাই হোক, আমার বাবা আমাদের বাড়িওয়ালাকে জানালেন এ ব্যাপারে। উনিও লোক হিসেবে ভালো ছিলেন। উনি সোহেলের বাবা-মাকে জেরা করলে তারা জানালো তাদের কোন আত্মীয় এসছিল, এসে দুপুরে খেয়ে চলে গিয়েছে। স্কুল ইউনিফর্মে আসা আর বেড়ানোর পোশাকে চলে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা তেমন সদুত্তর দিতে পারলোনা। বাবার সন্দেহটা আরো ঘনীভূত হল। তারপরেও এলাকায় কলোনীর মান সম্মানের কথা চিন্তা করে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া বাবা আর কিছু করলেননা। যাই হোক পরের শনিবার স্কুলে গিয়েই দেখলাম সবার মুখে মুখে ঘুরছে টুনির পালানোর খবর, টুনি আমাদের স্কুলেরই মেয়ে ছিলো, তখন ক্লাস এইটে। মেয়েটা খুব ভালো গাইতো। তাই তার পালানোর খবর রাষ্ট্র হতে বেশী সময় লাগলোনা স্কুলে। মেয়েটা নাকি বাসা থেকে টাকা পয়সা চুরি করে কায়সারের সাথে পালিয়েছে। কায়সারের পরিবারের কেউ অবশ্য এ ব্যাপার স্বীকার করেনি।
মানুষের মুখে মুখে ওদের গল্প পুরনো হবার আগেইীক সপ্তাহের মধ্যেই ওরা ফেরত চলে আসলো। যে যার বাসায় ফেরত চলে গেল। পরদিন থেকে টুনি স্কুলেও আসা শুরু করলো। তবে সে কায়সারের সাথে পালানোর কথা অস্বীকার করল। আমার বাবা আমার সুবাদে স্কুলে বেশ পরিচিতই ছিলেন। আমাদের হেডস্যারএর সাথে বাবা কথা বলে মেয়েটিকে ডেকে পাঠালেন অফিস রুমে। বাবা মেয়েকে দেখে নিশ্চিত হলেন এই মেয়েই সপ্তাহ খানেক আগে আমাদের বাসা থেকে পালিয়েছিল। বাবা তাকে কিছুই না বলে আমাদের বাড়িওয়ালাকে সব বললেন, পরদিন সালিশ বসলো। কায়সারের বাবা-মা মেয়েকে টাকা-পয়সা দিয়ে চুপ করাতে চাইলেন, মেয়েরা চুপ থাকলেও আমার বাবা চুপ থাকেননি। অনেক জোরাজুরি করে সালিশের সবাইকে কায়সার আর টুনির বিয়ে করিয়ে দিতে রাজী করালেন। পরদিনই তাদের বিয়ে হয়ে গেল। বিড়ম্বনা শুরু হল আমাদের। আমাদের বাড়িওয়ালার বড় ছেলে আবার ঐ ছেলেদের বন্ধু। সে আমার বাবার ছাত্রও ছিল, আমাদের বাসায় এসে বাবার কাছে পড়তো এস, এস, সি পর্যন্ত। বাসার টিনের চালে কয়েকরাত ধরে ইটের বর্ষণ হলো থেমে থেমে, দরজা খুললেই পালিয়ে যেতো। বাড়িওয়ালাও কিছু করে এদের ধরতে পারলেননা। পরদিন বাড়িওয়ালার ছেলে বলে গেল আমার বাবাকে এক মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিতে, তা না হলে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হবে। বাবা সব শান্তভাবে শুনলেন। এতটা দুঃখী বাবাকে এর আগে কখনো মনে হয়নি আমার। আমরা এর পর বাসা ছেড়ে দিয়েছিলাম, পনের বছরের স্মৃতি, কান্না করেছিলাম খুব। বাড়িওয়ালা আমাদের কিছুতেই বাসা ছাড়তে দিতে চাইলেননা। গ্রাম ছিলো বলেই হয়তোবা আমাদের বাড়িওয়ালা তখনো শহুরে রক্তচোষা ফ্ল্যাট মালিকদের মত হতে পারেননি। বাবা তাকে আসল কারণটা জানালেননা, হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন বলেই। বাবার চোখে পানি দেখিনি ঠিকই, তবে বাবা এর পর থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন, রাগ করাও ছেড়ে দিয়েছিলেন, বোধ করি ভুলে গিয়েছিলেন নিজের জীবনের ছন্দ।
সেই কায়সার এখন টুনিকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে, তাদের ঘরে দুটি সন্তান, কায়সারের বাবা-মাও টুনিকে মাসখানেকের মধ্যেই আপন করে নিতে পেরেছিলেন। সুখের হাওয়া থেকে দূরে ছিলেন বাবা। এরপরও বাবার কোন আফসোস ছিলনা টুনির ব্যাপারে। তিনি দুঃখ পেতেন সেই ছেলের যাকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েও তিনি মানুষ করতে পারেননি।
বাবার অনেক শিক্ষার মধ্যে একটা ছিল, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করো, যদি তা নাও পারো অন্তত কারো ক্ষতি করোনা
আজ অনেক বছর পরে সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি মনে পড়লো।
আমি এখন শহুরে ছেলে। অনেক কিছু শিখেছি। বড্ড বোকা আমার বাবা, আমি অনেক স্মার্ট। কারো ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাইনা আমি। তবে সারাদিন পর ক্লান্ত বিকেলে নিজেকে মাঝে মাঝে কাপুরুষ মনে হয় কেন যেন।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×