চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর দিকে এখন সবার নজর। কারণ আর কিছুই না। চুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে গত ১৩ সেপ্টেম্বর'২০১২ তারিখে। নির্বাচনের তারিখ ২৭ সেপ্টেম্বর'২০১২। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে তার এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর'২০১২।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটি ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরী করে। পাশাপাশি দেশ পরিচালনার জন্য তৈরী করে ভবিষ্যৎ নেতা। ছাত্ররা নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করে। এছাড়া দেশে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। ছাত্র ও শিক্ষার সমস্যা নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই। মূলত ছাত্র সংগঠনকে পুঁজি করে এরা ভবিষ্যৎটা গোছাতে চায়। এসকল সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা আদায়ই এদের মূল লক্ষ্য। এরা অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাত্র সমস্যা নিয়ে টুশব্দটি করতে দিতে চায় না। এরা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করতে চায়। যেকোনো ন্যায্য ও যৌক্তিক আন্দোলন সংগ্রামকে এরা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে ভাবে। আর ব্যবহৃত হয় সরকার দলের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। এসকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত না। আর তাই সাধারণ ছাত্রদের মাঝে এদের তেমন গ্রহণযোগ্যতাও নেই। এ ছাত্র সংগঠনগুলোকে আমরা সবাই চিনি। ছাত্র রাজনীতি(!)র কথা বলতে আমরা শুধু এদেরই বুঝি। এরা হচ্ছে বর্তমান সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, গত বিএনপি-জামাত সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির। গত কয়েক বছর এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবি সমাজ এসকল ছাত্র সংগঠনের আন্তঃদ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব ইত্যাদিকে "ছাত্র রাজনীতি(!)" আখ্যা দিয়ে প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সুপারিশ করে আসছেন। অথচ ছাত্র সমস্যা ও জাতীয় সমস্যা নিয়ে মাঠে সরব থাকা ছাত্র ইউনিয়ন ও অপরাপর বাম ছাত্র সংগঠনগুলোই প্রকৃত ছাত্র রাজনীতির চর্চা করে আসছে। ভোগবাদিতা ও আত্মসর্বস্বতার এই যুগে অনেক সংগ্রাম করে টিকে আছে এই সংগঠনগুলো। এই ছাত্র সংগঠনগুলোই মূলত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধিকার আদায়ে ছাত্রদের শেষ ভরসাস্থল। শাসক শ্রেণি প্রতিবার শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করলেও এ ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে হেরে যায়। মেনে নিতে বাধ্য হয় ছাত্রদের ন্যায্য দাবি। আর তাই শাসক শ্রেণি পথের এই কাঁটা (ছাত্র রাজনীতি) সরিয়ে ফেলতে চায়। মূলত বন্ধ করে দিতে চায় ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্য বাম ছাত্র সংগঠনসমূহের ছাত্র অধিকারভিত্তিক এসকল আন্দোলনকে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবারই ছাত্র রাজনীতির যেকোনো ধরনের সংকটের সমাধান আরো বেশি সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির মধ্যে বলে উল্লেখ করেছে। দেশের প্রায় প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না।
এরই প্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়ন সহ অপরাপর বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্যোগে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসা হচ্ছে। এর মাঝেই কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই ঘোষিত হয়েছে উপরোল্লিখিত চুয়েট ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য চুয়েট কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে চুয়েট ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ ছাত্রদের মনে নানাধরনের কৌতুহল জাগতে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা ধরনের হিসেব নিকেশ। পাশাপাশি সন্দেহও বেড়ে চলেছে। সন্দেহের পরিমাণ বাড়ার একমাত্র কারণ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু ব্যাপারে লুকোচুরি খেলা। যেমন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে কেউ ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ করেনি। নির্বাচনে কতজন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবে, কি প্রক্রিয়ায় আগ্রহীরা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবে, হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া কেমন হবে ইত্যাদিব বিষয়ে এখনো চুয়েট কর্তৃপক্ষ পরিস্কার কিছু বলছে না। তফসিল ঘোষণার দিন হয়তো কর্তৃপক্ষ সব কিছু জানাবে। সেটি না হয় মানা গেলো। কিন্তু কিছু খবর চুয়েটের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেগুলো হলঃ
১) চুয়েট ভিসি নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ছাত্রলীগকে বাগে আনতে নির্বাচনকে ব্যবহার করছে।
২) ছাত্র সংসদের নির্বাচনের রেজাল্ট রেডি করাই আছে। নির্বাচন শেষে তা ঘোষিত হবে মাত্র।
৩) চুয়েট ছাত্রলীগের নেতারা লক্ষ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করছেন পোস্ট কেনার জন্য।
৪) এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছে স্বয়ং প্রশাসন।
ছাত্রলীগের যা ইমেজ সারা দেশে! এসকল খবরকে ছাত্ররা তাই গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছে না। পাশাপাশি নির্বাচনকে সামনে রেখে চুয়েটে ছাত্রলীগের দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে রক্তপাতের আশঙ্কা করছে ছাত্ররা। এবং ছাত্রলীগের বাইরের প্রার্থীদের হুমকি ও নির্যাতনের ভয়তো আছেই। আবার যেকোনো গোলযোগপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন বাতিলের শঙ্কাটাও আছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছাত্রদের সাথে এ দূরত্ব কমিয়ে এনে ছাত্রদের মাঝে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা তাই জরুরী।
এসব কিছুকেই মাথায় রেখে চুয়েটে সাধারণ ছাত্ররা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি পজিটিভ বিষয়। এখন ভালোয় ভালোয় নির্বাচন হয়ে যাওয়া দরকার।
নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে এটি দেশের প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন দিনের সূচনা করবে। সোজা কথা এটি একটি ইতিহাসেরই জন্ম দিবে। আর যদি প্রশাসন কোনো প্রহসন করে তাহলে সেটি একটি "কালো অধ্যায়" বলেই চিহ্নিত হবে। চুয়েটের ছাত্ররা নিশ্চয় কোনো প্রহসনের নির্বাচন মানবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৫২