আমি কেবলই আমার মতো কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান। ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করার সময়ে তিনি শ্রেণীকক্ষে কখনোই সিলেবাস ধরে পড়াতেন না। জীবন, শিল্প, সমাজ, দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি জ্ঞানের যে বিষয় যেদিন তাঁর মনে আসত সেটা নিয়েই ক্লাসে বক্তব্য দিয়ে যেতেন। ধর্মের ব্যাপারে তাঁর ছিল তীব্র বিরুপতা। যে বিষয়ে যেদিন বলতেন তার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল, সঙ্গে তীব্র উজ্জ্বল মৌলিকতা।
ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীলতার যে কোন বিকৃতি, ভণ্ডামি এবং অন্ধতার ব্যাপারে তাঁর মনোভাব ছিল তিক্ত এবং আক্রমন ছিল নৃশংস।
এসব কারনে ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রেরা পরিকল্পনা করলো উনার নামে অধ্যক্ষের কাছে প্রথমে ক্লাসে সিলেবাস অনুসারে না পড়ানোর অভিযোগ দিবে এবং পরে ধর্মীয় বিরুপতার ব্যাপারে নালিশ জানাবে।
তখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিল জালাল আহমেদ। প্রচণ্ড রাগী, নিয়মনীতিতে আপসহীন, ধর্মানুরাগী, দুষ্টের দমন শিষ্টের লালনে বদ্ধপরিকর, কথা বলতেন ভৈরবের আঞ্চলিক ভাষায়। নিজের রুদ্রমূর্তির পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেকে জালালউদ্দিন ভৈরবী বলে উল্লেখ করতেন।
তৎকালীন আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের সঙ্গে এতই সুসম্পর্ক ছিল যে, সরকারের প্রভাবে নয় বরং উল্টো তাঁর প্রভাবেই ঢাকা কলেজের ব্যাপারে সরকার প্রভাবিত হতো।
১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজ এই শহরের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ। সেই থেকে খ্যাতির চুড়ায় অবস্থান করলেও পঞ্চাশের দশকের শেষপ্রান্তে নটরডেম কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে সাফল্যে ভাঁটা পড়তে শুরু করে। এই বহিরাগত প্রতিদ্বন্ধী নটরডেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ষাটের দশকে জালাল আহমেদের নেতৃত্বে আবারো সাফল্যের চুড়ায় আরোহন করে ঢাকা কলেজ। অবশ্য ঐ সময়েই ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নটরডেমে কলেজের প্রথম ফাদার নোভাক নিহত হয়।
এজন্য নটরডেমের উপর এর কিছুটা বিরুপ প্রভাব পড়ে। একই সময়ে জালাল আহমেদের নেতৃত্বে ঢাকা কলেজ এগিয়ে যেতে থাকে।
একদিন ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের পরিকল্পনামতো একদিন ৭-৮জন ছাত্র কয়েকজন অভিভাবককে সঙ্গে নিয়ে অধ্যক্ষ জালাল আহমেদের কক্ষে হাজির হলো। যথারীতি তাঁরা শওকত ওসমান ক্লাসে সিলেবাসের গল্পকবিতা পড়ান না এই অভিযোগ দিয়ে কথা বলা শুরু করলো। একপর্যায়ে 'শওকত ওসমান ক্লাসে পড়ান না' এটুকু অধ্যক্ষের কানে যেতেই অধ্যক্ষ তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন, " না, শওকত ওসমান তো ছাত্র পড়াইবার জন্য এই কলেজে নাই।
He is the decoration of the college. উনি হইল কলেজের শোভা। হারামজাদারা, প্রত্যেকদিন সকালে উইঠা এমন একজন মানুষরে যে চোখের সামনে দেখতে পারস এই তোগো সাতপুরুষের ভাইগ্য- আবার আইছস নালিশ করতে?" এইকথা বলে এমন ভয়ংকর চেহারা নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে লাগলেন। তাঁর হাতে ধরা পড়ার আতংকে অভিযোগকারী ও তাঁদের অভিভাবকেরা কোথায় যে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেলো আর খুঁজে পাওয়া গেলো না।
গত শতকের ষাটের দশকের ঢাকা কলেজের চিত্র এমনি ছিল। শিক্ষাবান্ধব।
এই তথ্যগুলো সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের 'নিষ্ফলা মাঠের কৃষক' বই থেকে পাওয়া। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।