কারও নাম না জানা, ভুলে যাওয়া, ভুল বলা অথবা ভুল লেখা, একটি বড় ধরনের অপরাধ। নাম না জেনে কারও সাথে কথা বলতে যাওয়াটাও, মাঝে মধ্যে বিপদজনক হতে পারে। মানুষের নাম নিয়ে আমাকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আবার নাম না জানার জন্যেও পড়তে হয়েছে নানান ঝামেলায়। ক্যাডেট কলেজে থাকতে নাম নিয়ে একবার এক বড় ধরনের বিপদে পড়ি।
আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। কলেজের ডাইনিংহলে আমি তিননম্বর টেবিলের টেবিললিডার ছিলাম। টেবিলে আমার পাশে রাগীব আর শামীম বসতো। খাবার সময় ওদের সাথে নানান বিষয়ে গল্প চলতো। একদিন রাগীব আমাকে বলল- “আচ্ছা, সাদাত ভাই।
বলেন তো এক কেজি দুধে কতটুকু দই হয়”? আমি একটু ভেবে চিনতে বললাম, “ওজন মনে হয় একটু কম হবে। কারণ, পানিটা কমে যাবার কথা”।
আমি এবার শামীমকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কী মনে হয়”? শামীম বলল, “ভাই আমার মনে হয় যে ওজনটা একটু বাড়বে। কারণ, দুধটা জমাট বাঁধছে তো তাই”।
সেই সময় ভালো কোনো ব্যাখ্যা না পাবার কারণে, প্রশ্নটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
যাই হোক, রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে, আমরা সবাই একাডেমি ব্লকে অর্থাৎ আমাদের ক্লাসে ফিরে এলাম। আমরা সকালে যেখানে ক্লাস করতাম, রাতে আবার সেখানে আমাদের ক্লাসের পড়া করতে হতো। আমি ক্লাসে এসে দেখি আমার বন্ধু নিয়াজ আমার আগেই ক্লাসে চলে এসেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে, এক কেজি দুধে কতটুকু দই হয়। নিয়াজ বলল- “আসলে ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই”।
আমি বললাম, “এই শোন, আমি কি স্যারকে জিজ্ঞাসা করব”? নিয়াজ বলল, “না স্যারকে বলার দরকার নেই”।
আমি বললাম, “স্যার তো এখানে আমাদের অভিভাবক, আর আমাদের থেকে অনেক বেশি জানেন। জিজ্ঞেস করেই দেখি না”। নিয়াজ বলল, “ঠিক আছে, বলে দেখ, স্যারকে”।
প্রতিদিন রাতে, পড়ালেখার সময় একজন স্যার আমাদের গার্ড হিসেবে থাকতেন।
সেদিন এক নতুন স্যার এসেছিলেন। ঐ স্যারকে আমি আগেও দেখেছিলাম, কিন্তু স্যারের নাম জানতাম না। যাই হোক, তখনও আমার বন্ধুরা এক-এক করে ক্লাসে ঢুকছিল। আমি স্যারকে ক্লাসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্যারের সামনে গেলাম। স্যার আমাকে বললেন, “কিছু বলবা”? আমি বললাম, “জী স্যার”।
স্যার বললেন, “বল। কী বলবা”? আমি বললাম, “স্যার, এক কেজি দুধে কতটুকু দই হয়”? তারপর, স্যার আমাকে জোরে বকা দিয়ে বসলেন। স্যার বললেন, “বেয়াদপ ছেলে। ব্যবসা করতে এসেছো? যাও, জায়গায় গিয়ে বসো। আমার সাথে ফাজলামি।
ফাজিল ছেলে কোথাকার”।
সবাই তাড়াহুড়ো করে যার যার সিটে গিয়ে বসলো। স্যার, রেগে-মেগে অস্থির। আমার বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে শুনছে। আর ভাবছে, সাদাত আবার কী ঝামেলা করলো।
ক্লাসে থমথমে এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো। এদিকে আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি বললাম, আর আমার সাথে এসব কী হচ্ছে। আমার চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা হয়ে গেল। আমার হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু করলো।
স্যার আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, “বসো”।
এরপর স্যার চলে গেলেন। সবার মুখে কৌতূহল। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে যে, আমি কী করেছি। কিন্তু, আমার কথা শুনে কেউই বিশ্বাস করছে না।
কারণ কেউই স্যারের নামটা তখনও জানতো না। এমন সময় আরাফাত আসল ঘটনাটা বুঝতে পারলো। সে স্যারকে আগে থেকেই চিনতো। আরাফাত আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি স্যারের নামটা জানিস”? আমি বললাম, “না, আমি স্যারের নাম জানি না”।
তখন আরাফাত বলল, “জানিস নে বলেই তো এই সমস্যা।
তুই স্যারের নাম জানলে আর এমনটা হতো না। তাও ভালো যে স্যার তোকে মারেনি। স্যারের নামটা হলো, স্বপন কুমার ঘোষ”।
ক্লাসের সবাই হাসাহাসি শুরু করলো। স্যারের নামটা নিয়েই যত সমস্যা হয়েছে।
অবশ্য, সেদিনের ক্লাস শেষে স্যার আমাকে ডেকে অনেক কথা বলেছিলেন। স্যারের সবকথা গুলিই ছিলো উনার পরিবারের নাম প্রসঙ্গে। উনি আমাকে খুব ভালোভাবে বোঝালেন যে, ঘোষ থাকলেই যে তারা দই-মিষ্টি বানায়, আসলে এমন কোনো কথা নেই। আর স্যারকে আমি বলেছিলাম, “স্যার, আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার”।
আরও বলেছিলাম, “স্যার, আপনি এখানে আমার অভিভাবকের মতো, আমি শুধু মাত্র জানবার জন্যেই এই কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে।
আমি অন্য কোনো কিছু মনে নিয়ে আপনাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করিনি”।
স্যার আমার কথা শুনে আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু, তখন আর কিছু বলবার নেই। স্যার, সত্যি অনেক ভালোমানুষ ছিলেন। কলেজজীবনে উনার কাছ থেকে আমরা ছাত্ররা অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।
আশা করি, আমাদের স্যার এখনও ভালো আছেন, সুখে আছেন।
আর স্যারের জায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে হয়তো সেই ছেলেকে কঠিন কোনো শাস্তি দিয়ে বসতাম। এরপর থেকে আমার নীতি হয়েছে, “আগে নাম, তারপর কাম”।
আর এক কেজি দুধে, যেটুকু দই হবে তার ওজন অবশ্যই বেশি হবে। তবে, তা অতি সামান্য।
তার কারণ, তাতে দইয়ের বীজ মেশানো হয়। অর্থাৎ, দই তৈরির ব্যাকটেরিয়া। আর সেই ব্যাকটেরিয়া ঐ দুধের মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
-সমাপ্ত-
মোঃ সাদাত কামাল
ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।