‘একটি বাঙ্গালী বালককে অন্তর্ঘাতী প্রচেষ্টা চালাবার অপরাধে ১৯৭১ এর জুন মাসে রাজশাহী জেলার রোহমপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোম্পানী সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে মেজর ‘আর’ তার বুকের দিকে স্টেনগান তাক করে বলেন,’এই তোমার শেষ সুযোগ,স্বীকার না করলে বুলেট দিয়ে তোমার শরীর এফোড় ওফোড় করে দেয়া হবে। ‘ এই কথায় সে নতজানু হয়ে বসলো, মাটিতে মাথা ঠেকালো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি এখন মরতে চাই। আমার দেশের মাটির পবিত্র ছোঁয়া পেয়ে আমার রক্ত ধন্য হোক।
তবেই তো আমার দেশ তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে। ‘
পড়ছিলাম পাকিস্তানী অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক এর একটা বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’। এই অংশটুকু পড়ে একটা শিহরন বয়ে গেল রক্তের মধ্যে। আমরা কি এই সূর্য সন্তানদেরই বংশধর? বিশ্বাস হতে চায় না তো।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠছি,ক্লাসে যাচ্ছি,বিকেলে রুমে ফিরছি,খাচ্ছি-দাচ্ছি,পড়াশোনা করছি,আড্ডা দিচ্ছি।
জীবনটা কতই না সুন্দর,কতইনা সহজ। কিন্তু এই জীবনটাকে সহজ করতে যারা নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ভিজিয়ে গেছেন এই দেশের মাটিকে আমরা তাদের আজ চিনিই না। এই বীরের কথা আমাকে জানতে হচ্ছে ভার্সিটি জীবনের শেষ বর্ষে এসে,তাও নিজের পাঠ্যসূচির কোনো বই থেকে নয়। যাদের জন্য এই দেশ,তাদের কথা সংরক্ষনের জনগনকে জানানোর কোনো আয়োজনই নেই আমাদের। জাতি হিসেবে কতটা অকৃতজ্ঞ আমরা!
প্রায় ৪০ বছর আগে স্বাধীনতার পর আমরা প্রথমবার নিজেদের মত করে আমাদের এই প্রানপ্রিয় দেশটাকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
আমাদের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটিকে চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না,কিন্তু অটুট দেশপ্রেম ছিলো। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারনে নিজেদের মধ্যে বিভাজনই দেশের জন্য কাল হয়ে দাড়ালো। যারা স্বাধীনতাকে অর্জন করে এনেছিল,দেশটাকে ভালোবাসতো যারা, তাদের সরিয়ে দিয়ে দেশটাকে শাসন করলো অন্যরা। তারা দেশের ইতিহাসকে পাল্টেছে, দেশের আদর্শকে তছনছ করেছে, দেশটাকে সাম্প্রদায়িকতার রাস্তায় তুলে দিয়েছে। দেশের এইসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কাহিনীকে সংগ্রহ ও সংরক্ষন এর জন্য যে অর্থ ব্যয় করার কথা তা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছে।
এইসব ইতিহাস সংগ্রহ করে দেশের তরুন প্রজন্মের সামনে যদি না আনা হয় তাবে হয়তো আর মাত্র পঞ্চাশ বছর পর এই বীরদের ইতিহাস বলার মত কেউ বেঁচে থাকবে না। ভাবুন তো যে শিশুটি কখনো না জানলোই না তার পূর্বপুরুষেরা এতটা অকুতোভয় ছিলো,স্টেনগানের সামনে মাথা উচু করে তার দেশপ্রেমের ঘোষনা দেওয়ার সাহস রাখতো, তার দেশপ্রেম জন্মাবে কিভাবে?তখন এর দায় কারা নেবে? আমরা কি পারবো সেই দায় এড়াতে?
এখন প্রশ্ন হলো এই ইতিহাস সংগ্রহের দায়িত্ব কি শুধু দেশের মুক্তিযুদ্ধ মন্তনালয়ের?অবশ্যই না,এই ইতিহাস তুলে আনার দায়িত্ব আমাদেরও। দরকার হলে সেই পল্লীসাহিত্য সংগ্রহের মত যেতে হবে একেবারে তৃণমুল পর্যায়ে। তবু হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না আমাদের বীরত্বের ইতিহাসকে।
আমি বিশ্বাস করি বাঙ্গালীমাত্রই বিপ্লবী।
যে দেশ ফ্রিডম ফাইটারদের জন্ম দিয়েছিলো সেই দেশের নতুন প্রজন্মের রক্তে বিপ্লবের রক্ত থাকতে বাধ্য। জন্মগতভাবেই আমরা লাখো বিল্পবী মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের দেহে। তবে সেই রক্তকে চিনতে হবে,জাগাতে হবে। জাগানোর রসদ দিয়ে যেতে হবে আগামী প্রজন্মকে। তবেই না তারা দেশকে নিয়ে ভাববে,দেশের জন্য কাজ করবে।
তরুন প্রজন্মের কেউ যখন মুক্তিযুদ্ধের কোনো বই পড়া শেষ করে অথবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরী কোনো সিনেমা দেখা শেষ করে তখন তাকে বলতে শোনা যায়,’ইশ! আমার জন্ম যদি সে সময় হতো,তবে আমিও দেশের জন্য যুদ্ধ করতাম। ‘ তাদের এই কথাই তাদের ভেতরের বিপ্লবী সত্তাটার বেড়িয়ে আসার প্রয়াস। যা পর্যাপ্ত রসদের অভাবে বেড়িয়ে আসতে পারছে না,যাকে বের করে আনতে হবে। এই রসদ,বীরত্ব,গৌরবের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। তবেই না তারা নতুন মুক্তিযুদ্ধে মাথা উচু করে লড়তে পারবে,ছিলিয়ে আনতে পারবে অলিম্পিকের প্রথম স্বর্ণপদক,বিশ্বকাপ,অস্কার,হয়তো আরেকটা নোবেল পুরস্কার।
মুক্তিযুদ্ধের আরো ছবি সহ নোটের লিঙ্ক~ http://tinyurl.com/c3negtx ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।