আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘আমি যদি কাশ্মীরের কেউ হতাম, আমাকে হয়তো গুলি করে দিত’ অরুন্ধতী রায়

ভালো আছি ‘আমি যদি কাশ্মীরের কেউ হতাম, আমাকে হয়তো গুলি করে দিত’ অরুন্ধতী রায় প্রশ্ন : রাষ্ট্রদ্রোহিতা, প্রতিরোধ আইন বা ইউএপিএ’র মতো বিধানগুলোকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন? এসব আইন এমন এক দেশে প্রচলিত রয়েছে যাকে বৃহত্তম গণতন্ত্র বলতে বলতে বিরক্ত করে ফেলা হচ্ছে। অরুন্ধতী : ভারতের গণতন্ত্র স¤পর্কে আপনার এমন কথা শুনে আমি খুব খুশি। নিঃসন্দেহে এটা মধ্যবিত্তের গণতন্ত্র। কাশ্মির বা ছত্তিশগড়ের মতো জায়গাগুলোতে গণতন্ত্র পাওয়া যায় না। কালোবাজারেও গণতন্ত্র থাকে না।

ইউএপিএ হলো, সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইন বা পোটার নব্য সংস্করণ। এটা করেছে বর্তমান ইউপিএ সরকার। এসব কালাকানুন পুরোপুরি জনগণকে বন্দী রাখার জন্য, এমনকি হত্যার সুযোগ দিচ্ছে সরকারকে। গণতন্ত্রে এ ধরনের কোনো আইনের জায়গা থাকা উচিত নয়। তবে যদ্দিন এই আইনগুলো মনিপুর, নাগাল্যান্ড বা কাশ্মিরের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় কিংবা মুসলিমরা হয় এর টার্গেট, তত দিন মনে হয় না এসব আইন নিয়ে কেউ ভাবে।

ভারত এমন এক রাষ্ট্র যে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত। তবে তা সর্বদাই মুসলিম, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে; কখনো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণ হিন্দুর বিপক্ষে নয়। প্রশ্ন : রাষ্ট্র যদি চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়, সন্ত্রাসের দুষ্টচক্র কিভাবে ভাঙা যাবে? অরুন্ধতী : মনে করি না যে, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অনুচিতÑ এমন উপদেশ কেউ দিচ্ছেন। এমনকি সন্ত্রাসবাদীরা নিজেরাও তা দেয় না। কাজের আইনগত পরিণাম কী দাঁড়াবে, তা পুরো জেনেই তারা যা করার করছে।

তারা তো সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিল করতে বলছে না। যে সিস্টেম অবিচার-অসাম্য তৈরি করে, এর পরিবর্তনের জন্য ওরা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, লড়ছে। তারা নিজেদের সন্ত্রাসবাদী মনে করে না। আপনি তাদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে অভিহিত করলেও আমি নিশ্চিতভাবেই তা মনে করি না, যদিও নিজে ওই মতাদর্শে বিশ্বাসী নই। করপোরেট-রাষ্ট্র যৌথ বেদীমূলে জনগণকে বলি দেয়ার বিরুদ্ধে যে-ই প্রতিরোধ গড়ে তুলুক, তাকেই সন্ত্রাসবাদী তকমা এঁটে দেয়া হচ্ছে।

এখন ২০১২ সালে সন্ত্রাসবাদী শব্দটার সংজ্ঞা কী? আসলে ব্যাপক অসাম্য দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছেÑ প্রতিবাদী জনতা নয়। যা আমরা করছি, তা হলোÑ আমরা বড় বড় করপোরেশনের কাছে নতজানু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ডুবন্ত জাহাজের কাছেও আমরা নতজানু হয়ে আছি। প্রশ্ন : যদি রাষ্ট্রীয় আইন, তৎপর পুলিশ, গোয়েন্দা, এমনকি সশস্ত্রবাহিনীও না থাকে, আমরা কি নৈরাজ্যের কবলে পড়ব না? অরুন্ধতী : আমরা যদি জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্রোধের কারণগুলো দূর না করি তাহলে দেশে নৈরাজ্য নয়, যুদ্ধ বেঁধে যাবে। যখন এমন আইন বানাবেন, যা ধনীর সেবায় নিয়োজিত, যা তাদের স¤পদ কুক্ষিগত রাখা এবং দিন দিন আরো স¤পদ অর্জন করায় সাহায্য করে থাকে, তখন ভিন্ন মত এবং বেআইনি কাজকর্ম সম্মানজনক হয়ে দাঁড়ায়।

আমি নিশ্চিত নই যে, মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে গরিব বানানো, তাদের ভূমি ও জীবিকা হরণ করে বড় বড় শহরের দিকে ঠেলে দেয়া, সেখানে তাদের বস্তি গুঁড়িয়ে আবার কোথাও ঠেলে দেয়া ইত্যাদি কতদিন অব্যাহত রাখা যাবে। সৈন্য, পুলিশ ও জেলজুলুমের বলে মানুষের ক্রোধকে টুঁটি চিপে থামিয়ে দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের অনাহারে রেখে, জেল দিয়ে ও হত্যা করে এর নাম দেয়া হবে মানবিক চেহারার বিশ্বায়ন। প্রশ্ন : আপনি কীভাবে আপনার রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করবেন? অরুন্ধতী : নিজের রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করাটা আমার কাছে অর্থহীন প্রসঙ্গ। আমরা যেভাবে নানা পথ স¤পর্কে ভেবেছি সেখান থেকে বের হওয়ার সময় এখন।

আপনি দেশভিত্তিক ভাবনা বাদ দিন, তারপর আপনি বাম-ডান বিচার বাদ দিন। কারণ এখন সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী দেশ হলো কমিউনিস্ট চীন। ফলে এই বিষয়গুলো কোনো না কোনোভাবে উল্টে গেছে। আমার মতে, যা ঘটছে তাতে আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। কিন্তু একটা জিনিস এখানে আমি বলে রাখতে চাই, এখানে অনেক জিনিস ভুলভাবে ঘটছে; কিন্তু আসল দুশ্চিন্তা অন্যখানে ঘটছে, যেখানে সঠিকভাবে ঘটনা ঘটছে, অনেক কিছু অকার্যকর ও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

যেমন, আমাদের এখানে এখনও এমন মানুষ আছে যারা এই গ্রহে সাধারণ জীবনযাপনের রহস্যটা জানেন। মানুষ জানে, ক্রেতাবাদী সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে কেউ কম সুখ ও কম তৃপ্তি নিয়ে বাঁচবেন, এ কথা সত্যি নয়। আপনি যখন কোনো কিছু রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছেন তখন কে আমি এটা মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমার মতে, আপনি যখন কোনো কিছু রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত তখন আপনার রাগ বেশি। কারণ আপনি দেখেন, এই ধ্বংসের ধ্বংস সাধনের এই যজ্ঞ অন্তত ভবিষ্যৎ চিন্তার বীজ হতে পারত।

আমরা এখনও এই রাগ লালন করি। প্রশ্ন : আপনার বইয়ে আপনি গণহত্যা ও প্রগতির মধ্যে একটা জৈবিক স¤পর্কের কথা বলেছেন। অরুন্ধতী : এমন কোনো ধারণার অস্তিত্ব কি আছে যেখানে কোনো সহিংসতার সংস্রব নেই? আজকের প্রগতির ধারণাটি উন্নয়নের পশ্চিমা ধারণাকেই বোঝায়। অবশ্যই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নতর কোনো প্রগতির কথা ভাবা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। এখন অবস্থা এমন যে, আপনি ভোগ না করলে অর্থনীতি ধসে পড়বে আর আপনি যদি ভোগ করেন তবে প্রতিবেশ ধসে পড়বে।

আপনি যদি বর্তমান হারে ভোগ করতে থাকেন তবে এটা ঘটবেই। প্রশ্ন : ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমাজের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রপথিকের কাজ করেছে। এখন কি মধ্যবিত্ত শ্রেণী সে ভূমিকা পালন করছে? অরুন্ধতী : স্বাধীনতা আন্দোলনে মধ্যশ্রেণীর ভূমিকা খুব জটিল বিষয়। মধ্যশ্রেণী ও শিল্পপতিরা ব্রিটিশদের জুতার ভেতর ঢুকে অনেক সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু যারা মধ্যবিত্তের ভূমিকাকে কিছু না বলেন তাদের দলেও আমি নই।

আমি মনে করি, ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। কিন্তু সেখানেই সেটা থেমে গেছে । কাশ্মীর থেকে শুরু এবং প্রগতি বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এখন, আমাকে বলতে হবে ভারতের বাতাসে এক ধরনের পচন ধরেছে। অনেক মানুষ সদ্য মধ্যশ্রেণীতে ঢুকেছে।

কারণ দেশের প্রত্যেকটি সংস্থাই গরিবদেও বাদ দিয়ে চলেছে। বোম্বেতে থেকে আপনি যখন অমিতাভ বচ্চনের মতো কারও দিকে তাকান তবে তা বেশ আকর্ষক ব্যাপার। তার প্রথম দিককার অনেক সিনেমায় তিনি বস্তিতে বেড়ে উঠেছিলেন। 'ম্যায় সড়কা কুত্তা হুঁ' ধরনের ব্যাপার। কুলি সিনেমার দিকে তাকান।

ওতে তিনি মুসলিম কুলি, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। দুর্নীতিগ্রস্ত এক মন্ত্রীর সঙ্গে লড়াই হয়, যেখানে মন্ত্রীর হাতে ত্রিশূল আর তার হাতে হাতুড়ি ও শিকল। সেখান থেকে এখনকার প্রেক্ষাপটে আসুন। এখনকার সিনেমায় তিনি শুধু বাংলোতে বাস করেন, সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে বের হন। প্রশ্ন : আপনার কাছে অক্যুপাই আন্দোলন নিয়ে জানতে চাই।

প্রেসিডেন্ট ওবামাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? অরুন্ধতী : তার (ওবামা) বিজয়ের পর মাথার টুপি খুলে বাতাসে উড়িয়ে যারা আনন্দ প্রকাশ করেছে, সেই দলের লোক আমি নই। মনে পড়ছে, প্রবীণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলো হোয়াইট হাউসে কৃষ্ণাঙ্গ লোক দেখতে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। এখন তিনি কী করেছেন সেটা আপনিও দেখেছেনÑ আমি তাকে তিরস্কার করাটাই বোঝাতে চেয়েছি। তিনি কী করছেন? আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে তা এখন ঠেলে দিচ্ছেন পাকিস্তানের দিকে। ড্রোন হামলার ফলে প্রতিদিনই মরছে মানুষ।

এই উপমহাদেশে তিনি আসলে কী করতে চান, সেই বিষয়ে তার নিজের কোনো পরিষ্কার ধারণা আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। এখন যদি বলি জর্জ বুশ যা করে গেছে, ওবামাও তা-ই করছে, তাহলে সবাই তাকে ফ্যাসিবাদীই বলবে। আসলেও তাই, একজন ব্যক্তি দিনের আলোতেই সেই কাজগুলো করে চলেছেন, যা করতে অন্যদের রাতের প্রয়োজন হয়। এরই মধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আলাপ শুরু হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও অস্ত্র নির্মাণ ও রফতানির মধ্য দিয়েই নিজেদের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে চান তিনি।

আর এসবের মূলে আছে মার্কিনিদের নিরাপদ করে তোলার জিগির। প্রশ্ন : আপনি রাষ্ট্রের সহিংসতার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ ব্যক্ত করেন। এবং আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, আপনি সন্ত্রাসের সহিংসতাকে নিন্দার চোখে দেখেন না। মনে হয়, অহিংসার পথকে নিষ্ফল প্রয়াস বলেই মনে করছেন আপনি। অরুন্ধতী : অহিংসা এবং অহিংস আন্দোলন নিয়ে দশ বছর ধরে যদি কেউ লিখে থাকেন, তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ আসলেই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন।

অহিংস আন্দোলন তো কোথাও কোনো কাজে আসেনি; বিশেষ করে গান্ধী-প্রদর্শিত অহিংস অন্দোলন। এমনকি 'নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন'ও কোনো কাজে আসেনি। কোনো জঙ্গি আন্দোলনেও কাজে আসেনি। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে মধ্যরাতে হাজার হাজার পুলিশ এসে সারা গ্রাম ঘেরাও করে ফেললে দেখার কেউ নেই। তখন তারা কী করবে? যারা এমনিতেই ক্ষুধার্ত তারা অনশনে যাবে কিভাবে? যাদের হাতে টাকা-পয়সা কিছুই নেই, তারা আয়কর বর্জন করবে কী করে? তারা বিদেশি পণ্য বর্জন করবে কী করে? তাদের তো কিছুই নেই।

আমি অবশ্যই মনে করি, তাদের সহিংসতা হলো সহিংসতারই প্রতিবাদ। সহিংসতার এই চক্রবৃদ্ধি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এ ধরনের সহিংসতার দিকে কোনো সমাজকে ঠেলে দেওয়া অবশ্যই একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যে শক্তিধর সরকার হাজার হাজার প্যারামিলিটারি পাঠাচ্ছে, সেই সরকারের বিরুদ্ধে এই হতদরিদ্র মানুষগুলো শুধু একে-৪৭ আর গ্রেনেড নিয়ে যেরকম শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারছে, সেটাও প্রায় অবিশ্বাস্য। প্রশ্ন : গান্ধী কি এমন কোনো ব্যক্তিত্ব, যাঁকে নিয়ে উপহাস করা যায়? অরুন্ধতী : আমি মনে করি, গান্ধীর এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর কারণে তাঁকেও উপহাসের খোরাক হতে হবে।

আবার কিছু আছে, যেগুলোর কারণে তাঁকে শ্রদ্ধা করা যায়। বিশেষ করে ভোগ এবং সর্বনিু পর্যায়ের সংস্থানে টিকে থাকার ধারণার কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু স¤পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বের বিষয়ে যে কথা তিনি বলেছেন, সেটা লক্ষ করে দেখুন। তিনি বলেছেন, ধনীরা তাঁদের নিজের প্রয়োজনে যতটুকু স¤পদ দরকার ততটুকু ব্যয় করবেন। বাকিটা তাঁদের কাছে থেকে যাবে এবং সেখান থেকে সমাজের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।

' আমি মনে করি, এখানেই উপহাসের কারণটি নিহিত। এ রকম কথায় উপহাস করায় কোনো বাধা আছে বলে মনে করি না। প্রশ্ন : আপনি কেন মনে করে থাকেন, আপনার লেখার স্বকীয়তায়ই রয়েছে বিতর্কিত হওয়ার প্রবণতা? ভারত কেন অরুন্ধতী রায়কে ঘৃণার চোখে দেখতে পছন্দ করে? আপনার প্রতি কেন এত ঘৃণার বার্তা? অনেকেই কেন মনে করেন, আপনার কথার সঙ্গে তাঁরা একমত হতে পারেন না। অরুন্ধতী : আমি মনে করি, আপনার জন্য ভারতের প্রতিনিধিত্ব করাটা অহংবোধের পর্যায়ে আছে। আমি ঠিক এর বিপরীতে আছি।

উড়িষ্যা কিংবা নর্মদা যেখানেই যাই, যাঁরা আমার লেখার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন বলে মনে করেন তাঁরাই মনে করেন আমার লেখার জন্য তাদের বিপদ হতে পারে। তাঁদের মনোভাবের কথা ধরলে বলা যায়, আমার প্রতি কারো কারো ঘৃণা আছে। তবে যদি এমন হতো যে ভারতের সব মানুষই আমাকে ঘৃণা করে, তাহলে বুঝতাম আমি ভুল করছি। কিন্তু রাজনৈতিক লেখক হিসেবে আমি আমার লেখনী চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি একরোখা। সেটাই হলো আসল বিষয়।

প্রশ্ন : একজন পাঠক আপনার লেখার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, একজন ষোল বছর বয়সী মেয়ে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে বিষয়টা অবশ্যই ভয়ের, আশঙ্কার। কিন্তু অরুন্ধতী রায় কী করে ওই মেয়েটার বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকার বর্ণনায় বলতে পারলেন মেয়েটাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে, তার মুখে চমৎকার হাসি? অরুন্ধতী : কারণ একজন ষোল বছর বয়সী মেয়ে সিআরপিএফ লোকের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার বাবা-মাকে মেরে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছেথএই চিত্রটাই বরং আমার কাছে অসহনীয়। যখন কেউ দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আমি এর প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি তখন এমনিতেই ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে। কিন্তু ওই মেয়েটার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার চেয়ে মনে হয় এটাই শ্রেয়। প্রশ্ন : আপনার কি কখনো ভারত ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনে হয়েছে? অরুন্ধতী : কখনোই না।

এখানে থেকে যা দেখছি, যা করছি সেটাই আমার চ্যালেঞ্জ, সেটাই বড় সৌন্দর্য, সেটাই আমার কাছে বড় বিস্ময়। কারণ এখানকার মানুষ পৃথিবীর যেকোনো অংশের মানুষের চেয়ে কঠিনতম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য আমি গর্বিত। তাদের আমার সর্বোচ্চ প্রণাম। কারণ আমি তাদেরই কাছের একজন, দেশের একজন।

সিএসপিএ আমাকে জেলে ভরতে চাচ্ছে। আমি সুইজারল্যান্ডে গিয়ে থাকতে রাজি নই। প্রশ্ন : কাশ্মীর নিয়ে আপনার বক্তব্য স্পষ্ট করুন। অরুন্ধতী : কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন রাখার কলাকৌশল জারি আছে। দুটি নিবিড় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ চক্র দিয়ে দিল্লি ও শ্রীনগরের কাশ্মীরকে বাদবাকি দুনিয়া থেকে আলাদা রাখা হচ্ছে।

অথচ দেশের ভেতরে সরকার ও সেনাবাহিনীর জন্য সবকিছুই জায়েজ। ওদিকে কাশ্মীরের সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে ঘুষ, হুমকি, ব্ল্যাকমেইলসহ সতর্কভাবে তৈরি করা একগাদা অকথ্য নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া, যা মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সরকার যখন এভাবে জীবিতদের মুখ বন্ধ রাখতে নেমেছে, তখন মুখ খোলা শুরু করেছে মৃতরা। ভারতের মানবাধিকার কমিশন যখন চক্ষুলজ্জার মুখে পড়ে কাশ্মীরের তিনটি জেলায় ২৭ হাজার অচিহ্নিত কবরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে, ঠিক সে সময় কাশ্মীরে যেতে চাওয়া নিশ্চয়ই ‘বারসামিয়ানে’র বাড়াবাড়ি। কাশ্মীরের অন্যান্য জেলা থেকেও এ রকম হাজার হাজার কবরের খবর আসছে।

যে সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে ভারতের মানবাধিকার-পরিস্থিতির প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য পেশ করা হয়েছে, সে সময় ভারত সরকারকে জ্বালাতন করা ধৃষ্টতাই বটে। সেখানে এ পর্যন্ত ৬৮ থেকে ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনে সশস্ত্র বাহিনীর সেপাইরাও কেবল সন্দেহবশত গুলি করার বৈধতা পেয়েছে। কাশ্মীরে ইরাকের মতো পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইরাকে আমেরিকার রয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার সেনা।

আর কাশ্মীরে ভারতের রয়েছে সাত লাখ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাকর্মীÑ সেনা, পুলিশ ও মিলিশিয়া। ভারত সরকার সেখানে মূলত যা করছে তা হলো কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছাকে দমন করা। কেন তারা গণভোটে এত ভীত? কেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র জানতেও ভয় পায় জনগণ কী চায়? প্রশ্ন : তবে ভারত যে সন্ত্রাসের শিকারÑ একথা সত্য নয়? অরুন্ধতী : আমরা এখন এমন এক শিখরে পৌঁছেছি, যেখানে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা প্রসারিত করা হয়েছে। হিন্দু মৌলবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির আমলে সন্ত্রাসের অভিযোগ কেবল মুসলিমদের দিকেই তাক করা হতো। কিন্তু এখন সরকার যাদের জালে পুরতে চায়, কেবল ইসলামি সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায় তাদের আঁটানো যাচ্ছে না।

কেননা ইসলামি সন্ত্রাসবাদী হতে হলে তো নিদেনপক্ষে মুসলিম হতে হয়। কিন্তু যখন প্রকান্ড উন্নয়ন প্রকল্প ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরির জন্য ব্যাপক হারে উচ্ছেদ চলছে এবং যখন মানুষ তা রুখে দাঁড়াচ্ছে, তখন তাদেরও বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী। যেহেতু তাদেও ইসলামি সন্ত্রাসী বলা সম্ভব না, সেহেতু তাদের বলা হচ্ছে মাওবাদী। সশস্ত্র প্রতিরোধ তা কাশ্মীরেই হোক আর মাওবাদী ক্যাডারদের দ্বারাই হোক, তা এখন বাস্তবতা। তাই যখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সন্ত্রাসবাদকে প্রধানতম ঘরোয়া হুমকি বলে ঘোষণা করেন, তখন বিভিন্ন রাজ্য সরকার যে কাউকে সন্ত্রাসী তকমা দেওয়ার উপযোগী আইন প্রণয়নে উৎসাহী হয়ে ওঠে।

হয়তো আমাকেও তারা শাসাতে আসবে, যেহেতু আমি তাদের সমালোচনা করে বই লিখেছি। ছত্তিশগড়ে আমি যদি অরুন্ধতী রায় না হতাম, তাহলে জেলে পুরে দিত। কাশ্মীরের কেউ হতাম, আমাকে হয়তো গুলি করে দিত। গুজরাটের সা¤প্রদায়িক নিধনযজ্ঞে দেড় থেকে দুই হাজার মুসলিম কচুকাটা হয়, গণধর্ষিত হয় অজস্র নারী। এসবই ছিল বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী অভিযানের অংশ।

আমি বলতে চাই গণহত্যাকারী হওয়া সত্ত্বেও মোদী বিজয়ী হননি, মুসলিম হত্যার কৃতিত্বের জন্যই তিনি আবার নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মনে প্রশ্ন জাগে, গণতন্ত্র কী? নরেন্দ্র মোদীকে শয়তান ভাবার বিষয় নয় এটা, কেননা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই তো আরও আরও নরেন্দ্র মোদীরা ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাচ্ছে। তারা খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করে যে, জার্মানিতে ইহুদিরা যেমন, ভারতে মুসলিমেরা তেমন। ।

সে সময় যে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করেছেন তিনি এখন গুজরাটের পুলিশ কমিশনার। প্রশ্ন : এক্ষেত্রে মনমোহন সিং-কে কেমন মনে করেন? অরুন্ধতী : ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জীবনে একটি নির্বাচনেও জয়ী হননি। তিনি বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের দেখানো পথ ছাড়া কিছু কল্পনাও করতে পারেন না। আমার ধারণা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাস বইও কখনো পড়ে দেখেননি তিনি। তিনিই কোনো সাবেক উপনিবেশের একমাত্র নেতা, যিনি ক্যামব্রিজে গিয়ে বক্তৃতা করে উপনিবেশবাদকে গণতন্ত্রের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং ব্রিটেনকে ভারতে রেখে যাওয়া নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানগুলো তথা পুলিশ, আমলাতন্ত্র ইত্যাদির জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসেন।

সুতরাং এই ভারত এখনো উপনিবেশবাদী পথেই চলছে, কেবল ইংরেজের জায়গায় শাসন করছে উচ্চবর্ণের লোকেরা। অরুন্ধতী রায়ের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ ভাষান্তর : মনযূরুল হক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।