আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরাবাস্তব-৪

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! ২০১২ সাল পৃথিবীতে এখন প্রচণ্ড সুখ। কোন হানাহানি রাহাজানি নেই, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নেই, নিউক্লিয়ার ওয়ার নেই। ট্র্যাফিক জ্যাম নেই, মহাযুদ্ধ নেই, মহামারী নেই। প্রত্যেক মানুষের সুখী একটা ছোট পরিবার রয়েছে, নিজের জন্য প্রচুর জায়গা রয়েছে, বাচ্চাদের বড় করবার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষাসামগ্রী রয়েছে, পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে। বস্ত্র বাসস্থান নিরাপত্তা কোন কিছুরই অভাব নেই তাদের।

এই প্রচণ্ড সুখের কারণে কেউ এখন আর চুরি ছিনতাই খুন এগুলো করে না, কারণ তাদের এমনিতেই জীবনযাপনের সব সরঞ্জাম যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে বলে অসৎ পথে উপার্জন করার দরকার হয় না। তাই পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীও নেই পৃথিবীতে। এমনকি সরকার, রাষ্ট্র ইত্যাদিরও দরকার নেই এখন। ২৫১২ সাল মানুষ গত পাঁচশ বছরে কোন ফসল ফলায় নি। কারণ তাদের ফসল ফলানো দরকার ছিল না।

পরিবার পরিকল্পনা মেনে চলে নি, কারণ তারা জানত তাদের জন্য অনেক অনেক খাদ্য মজুদ আছে। এসমস্ত কারণে একসময় পৃথিবীতে খাদ্য সংকট দেখা দিল। প্রথমে হালকাভাবে, পরে প্রকটভাবে। মানুষ পড়ল মহা বিপাকে। এমন সময় কিছু নেতৃত্বগুণসম্পন্ন মানুষ স্থাপন করলেন সরকার।

মানুষ তাদের কাছে নিজেদের অভিযোগ পেশ করল। তারা নিজ বুদ্ধি দিয়ে সেগুলো সমাধান করে দিতে লাগলেন। ২৬১২ সাল প্রবল খাদ্যসংকট দেখা দেবার ফলে মানুষ হানাহানি রাহাজানি ইত্যাদিতে লিপ্ত হল। সরকার এগুলোকে নির্মূল করার চেষ্টা করল, লাভ হল না। উল্টো সরকারের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে গেল।

রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হল। পারস্পরিক বিবাদে মারা পড়া শুরু করল অজস্র মানুষ। ২৭১২ সাল বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করল। দেশ মহাদেশ ইত্যাদিতে বিভক্ত হয়ে গেল পৃথিবী। একেক জায়গায় একেক দল একেক ভাবে দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল।

২৮১২ সাল বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে লাগলেন নিউক্লিয়ার বোমা কিভাবে বানানো যায় তার উপর। এই গবেষণায় প্রথম সফল হল আমেরিকা। তারা শত্রুরাষ্ট্র ইরাকের উপর নিউক্লিয়ার বোমা ফেলল। ধ্বংস হয়ে গেল বিশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বিশাল এক জায়গা। ইরাক তার প্রত্যুত্তর দিল জীবাণু অস্ত্রের মাধ্যমে।

অজ্ঞাত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মুহূর্তেই আমেরিকার পাঁচটি বড় বড় শহর জনশূন্য হয়ে পড়ল। ক্ষেপে উঠল আমেরিকা। তার সাথে যোগ দিল আরও কয়েকটি রাষ্ট্র। একটা মহাযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। ২৯১২ সাল বিশ বছর ব্যাপী স্থায়ী হয় মহাযুদ্ধটি।

পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এতে মারা যায়। পৃথিবীর উপরিভাগ হয়ে যায় বসবাসের অনুপযোগী। তেজস্ক্রিয়তার লেভেল এতই বেশি ছিল যে দিনের পর দিন মানুষ মারা পড়তে থাকে পৃথিবীতে। মাটির নিচে অনেক বড় এক কলোনি বানানো হয়। মানুষ ঢুকে পড়ে সেই কলোনিতে।

পৃথিবীর উপরিভাগের সাথে সংযোগকারী রাস্তাটি সিল মেরে দেয়া হয়। ২৯৩২ সাল মাটির নিচের কলোনিটি অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে খাবার উৎপাদন করা খুবই কষ্টকর। এখন আইন করে সন্তান উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেউ বুড়ো অথর্ব হলে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

মানুষের মনে সুখ নেই। শান্তি নেই। পৃথিবীর উপরে থাকার সময় বিজ্ঞানীরা পরাবাস্তব জগতের সাথে যোগাযোগের মত একটা যন্ত্রের উপর গবেষণা করছিলেন। মানুষকে আবার সুখী ও তৃপ্ত করার মানসিক প্রয়াসে তাদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন তারা আবার প্রজেক্টটায় হাত দেন। ত্রিশ বছর গবেষণা করার পর যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়।

২৯৫২ সাল এক জাপানি বিজ্ঞানীর নামানুসারে যন্ত্রটির নাম দেয়া হয় কাবোদাচো। এই যন্ত্রে আর্কিটেক্টরা খুব সুন্দর একটা পৃথিবীর ডিজাইন করেন, তারপর পরীক্ষামূলকভাবে একজনকে সেই পৃথিবীতে ঘুরে আসতে পাঠানো হয়। সেই পৃথিবীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাকে পাঠানো হয়েছিল সে নিজের সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আবার সেই জগতে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করে। যন্ত্রটি আর কিছুই না, এটায় অনেক বড় একটা হার্ডডিস্ক আছে, যেটায় আর্কিটেক্টদের বানানো পৃথিবীর সব ডাটা থাকে, আর মস্তিষ্কের সাথে সংযোগ দেবার ইন্টারফেস, যেটা দিয়ে একজন টেস্ট সাবজেক্ট ঐ পরাবাস্তবে প্রবেশ করতে পারে। আর আছে একটা বিশাল সি পি উ, যে কিনা এই পরাবাস্তব জগতটিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৩০১২ সাল পৃথিবীর মানুষরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা সবাই ঐ যন্ত্রের মাধ্যমে পরাবাস্তবে প্রবেশ করবে। কারণ সুখ শান্তিহীন এই গর্তের জীবনের তুলনায় সেটা হয়তো স্বর্গ থেকেও বেশি। এভাবে একের পর এক মানুষ ইন্টারফেসের মাধ্যমে পরাবাস্তবের সাথে যুক্ত হতে থাকে। এক সময় বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান পাঁচ বিজ্ঞানী ছাড়া সবাই ঢুকে পড়ে পরাবাস্তবে। বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান লুদভিগ অন্য চার বিজ্ঞানীর দিকে তাকিয়ে ভরাট কণ্ঠে বলেন, “অবশেষে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

আমাদের নেতৃত্বে চমৎকার একটি পরাবাস্তব সৃষ্টি করা হয়েছে। এই জগতে মানুষের কোন কষ্ট থাকবে না, ক্ষোভ থাকবে না। খাদ্য সংকট থাকবে না। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ থাকবে না। সেখানে মানুষ মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকবে”।

অন্যরা হাত নেড়ে তাকে সমর্থন জানায়। লুদভিগ বলেন, “আমাদের দায়িত্ব শেষ। এখন আমাদেরও উচিৎ পরাবাস্তবে ঢুকে অসীম সুখে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়া। আমাদের জন্য পাঁচটা ইন্টারফেস রাখা আছে, এসো আমরা একজন একজন করে ইন্টারফেসে যুক্ত হয়ে পরাবাস্তবে প্রবেশ করি”। সবাই তাকে স্বাগত জানিয়ে নিজেরা নিজেদের ইন্টারফেসট সেট করতে লাগলেন।

বিজ্ঞানী লুদভিগ লক্ষ্য করলেন তার সহকর্মীদের মধ্যে একজনের মন খুব খারাপ। লুদভিগ তার দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন, “কষ্ট হচ্ছে? মায়া লাগছে? মায়া লাগবে কেন, আমরা তো আমাদের পরিচিত পৃথিবীটাই পরাবাস্তবে ডিজাইন করেছি। ওখানে তো খারাপ লাগার কোন সম্ভাবনাই নেই। তাছাড়া আমাদের আগের স্মৃতিগুলোও তো পরাবাস্তবে ঢোকার সাথে সাথে মুছে যাবে।

তাই আমরা আগে কোথায় ছিলাম এসব কিছু মনেই থাকবে না”। মন খারাপ করে থাকা ঐ বিষণ্ণ বিজ্ঞানী বললেন, “আমরা পরাবাস্তবকে সৃষ্টি করেছি একদম নিখুঁত করে। ওখানে থাকলে কারোই মনে হবে না সে আসলে পরাবাস্তবে আছে, তাই না?” লুদভিগ বললেন, “হ্যাঁ তাই”। বিজ্ঞানী বললেন, “আমরা একটা সুখের পৃথিবী ডিজাইন করেছি। যেখানে কোন কষ্ট নেই, ক্লেদ নেই, গ্লানি নেই।

সবাইকে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান পর্যাপ্ত পরিমাণে দেবার ডিজাইন করেছি আমরা। ঠিক না?” লুদভিগ বললেন, “হ্যাঁ ঠিক”। বিজ্ঞানী বিষণ্ণ চিত্তে বললেন, “আমি পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছি। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে পৃথিবী খুবই সুন্দর ছিল। একদম পারফেক্ট ছিল সেই পৃথিবী।

সেখানে কোন দুঃখ ক্লেশ অভাব ছিল না। ঠিক আমরা যেরকম পৃথিবী ডিজাইন করেছি সেরকম”। লুদভিগ বলতে গেলেন, “কারণ...” বলতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি। তার কেমন যেন মাথা ঘুরতে লাগল। এত পারফেক্ট পৃথিবী তো পরাবাস্তব ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়।

মানুষের স্বভাবই হচ্ছে নিজেকে ধ্বংস করা। সুতরাং অভাব অনটনহীন অপরাধহীন কোন পৃথিবী পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। লুদভিগ অবাক হয়ে হাজার হাজার ইন্টারফেসে সংযুক্ত মানুষের দিকে তাকালেন। কি আশ্চর্য শান্তই না দেখাচ্ছে তাদের! কি সুখই না দেয়া হয়েছে তাদের পরাবাস্তবে! লুদভিগ অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালেন। প্রতিটি লোম দেখা যাচ্ছে।

হাতের রেখাগুলো একদম স্বাভাবিক। পরাবাস্তব কি এতটা পারফেক্ট হয়? তিনি কি বাস্তবে আছেন না পরাবাস্তবে? এই প্রশ্নটা হঠাৎ করেই লুদভিগের পুরো মনোজগৎ অধিকার করে নিল। কি করবেন বুঝতে না পেরে প্রবল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলেন তিনি। বিজ্ঞানী তার দিকে একটি পিস্তল আগিয়ে দিল। “হ্যাঁ, এটাই একমাত্র উপায়, বোঝার যে এ জগতটা বাস্তব না পরাবাস্তব”।

লুদভিগ নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করলেন। তার জগতটা অন্ধকার হয়ে এল। অতঃপর... *** পরাবাস্তব থেকে জেগে উঠলেন শিল্পপতি আবুল হোসেন। এতক্ষণ তিনি টাকার বিনিময়ে পরাবাস্তবে ছিলেন। “দি নবাদচো পরাবাস্তব ট্র্যাভেল এজেন্সি লিমিটেড” প্রতি মিনিটে ৬০ ডলারের বিনিময়ে তাকে পরাবাস্তবে ঘুরে আসার সুযোগ দিয়েছিল।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কেন তিনি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফিরে আসলেন আর কেনই বা পরাবাস্তবের কোন স্মৃতি তার মনে পড়ছে না এটা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না তিনি। (সমাপ্ত) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।