কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! “কাট! কাট!”
প্রখ্যাত অভিনেতা আমিনুল ইসলাম হতভম্ব হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার হাতে ধরা একটা বটি, বটির গায়ে রক্ত। আমিনুল ইসলামের হাতে রক্ত, পায়ে রক্ত, গায়ে রক্ত।
আমিনুল ইসলামের সামনে যে মানুষটা হাত চেপে মাটিতে বসে পড়েছে তার নাম সাব্বির আহমেদ। সাব্বির আহমেদ এই সিনেমার পার্শ্ব-অভিনেতা।
“স্যার এটা আপনি কি করলেন? স্যার আপনি ঠিক আছেন তো?”
আমিনুল ইসলাম শূন্য চোখে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই দৃশ্যে তার কাজ ছিল সাব্বিরের গায়ে বটির কোপ দেবার অভিনয় করা। আসল বটি দেয়া হয়েছিল তার হাতে, বলা হয়েছিল বটিটা সাব্বিরের শরীরের সামনে দিয়ে সাঁই করে নামিয়ে আনতে, পরে কম্পিউটারে এডিট করে এমন দেখানো যাবে যেন মনে হয় আসলেই উনি সাব্বিরের গায়ে কোপ দিয়েছেন।
কিন্তু তিনি একটা ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছেন। তিনি বটি দিয়ে সাব্বিরের শরীরের সামনের বাতাসে নয়, শরীরের উপর সজোরে কোপ মেরে বসেছেন।
সাব্বির হাত চেপে আর্তনাদ করছে। তার জন্য অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিয়েছে।
“স্যার, আর ইউ সিক? অ্যানি প্রবলেম?”
আমিনুল ইসলাম কমবয়সী ডিরেক্টরের দিকে তাকালেন। অনেক কথা মাথায় এল তার। কিন্তু তার মুখ থেকে বেরুলো শুধু একটাই কথা, “নাহ।
কিছু না। আমি সরি। ভেরি সরি”।
***
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল জাহানারা। তার এক হাতে বই, আরেক হাতে কলম।
কামাল স্যারের কাছে ম্যাথ পড়তে প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়েই চলাফেরা করে সে।
এ রাস্তারই পাশে মফিজের চায়ের দোকানে প্রতিদিন আড্ডা দেয় মানিক। এলাকায় সবাই তাকে ডাকে গাঞ্জাখোর মানিক। মানিক দিনে রাতে মিলে বারো ঘণ্টা গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে থাকে। আর বাকি বারো ঘণ্টার মধ্যে দু ঘণ্টা সে এই চায়ের দোকানে বসে বসে বাকিতে চা খায় আর জাহানারার জন্য অপেক্ষা করে।
গাঞ্জাখোর মানিকের আজ মেজাজ খারাপ। আর মানিকের মেজাজ খারাপ মানে খুব খারাপ কিছু। গতকাল সে জাহানারাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। জাহানারা ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
গাঞ্জাখোর মানিকের সাঙ্গ লিটু একটা গোল্ড লিফ বিড়ি ফুঁকছে।
প্রতিবার ভাইয়ের সাথে অপারেশনে আসার আগে তার এমনই হয়। ভাই কিছুদিন পরপরই একেকটা মেয়ের পিছে লাগে আর ছ্যাকা খায়। ছ্যাকা খাবার পর ভাইয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তখন ভাই অপারেশনে বের হয়। আর ভাইয়ের গত পাঁচটা অপারেশনে সাঙ্গ হিসেবে ছিল লিটু।
অপারেশনে থাকার একটাই সুবিধা, ফ্রি তে কয়েকটা গোল্ড লিফ টানা যায় আর ভাইয়ের যন্ত্রে ধর্ষিত মেয়েটাকে নিস্তেজ অবস্থায় কিছুক্ষণ ভোগ করা যায়।
গাঞ্জাখোর মানিকের পাঙ্গ আশ্রফ। আশ্রফ লিটুর মত বিড়ি খায় না, আশ্রফের চলে বাংলা পানীয়। ভাইয়ের সাথে প্রত্যেক অপারেশনের পর আশ্রফ এক বোতল বাংলা পানীয় পায়, এমনিতে তার আর কোন ডিমান্ড নেই, ভাই আর লিটু হারামজাদা যখন মেয়েগুলোর উপর চড়ে বসে তখন আশ্রফ উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।
জাহানারা দূর থেকে মানিককে দেখছে।
তার পথচলা থেমে গেছে। মানিকের নামে অনেক খারাপ খারাপ কথা শোনা যায়। যদিও তার কোন প্রমাণ নেই। এই গ্রামের মরিয়মের হঠাৎ গ্রামছাড়া হবার ঘটনা বা রানুর হঠাৎ আত্মহত্যার ঘটনায় অনেকেই মানিককে দোষী করে। অনেকেই বলে ঐ মেয়েগুলো মানিকের হাতে ধর্ষিত হয়ে আত্মহনন বা পালিয়ে যাবার পথ বেছে নেয়।
যদিও তার কোন প্রমাণ নেই। মানিকের উপরে এই গ্রামে কেউ কথা বলে না। মানিকের বাবা এই গ্রামের চেয়ারম্যান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কেমন কেমন ভাগিনা।
জাহানারা দাঁড়িয়ে আছে। মানিকের দৃষ্টি তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে।
আকলিমাকে নাকি মানিক বিয়ে করতে চেয়েছিল। আকলিমা শুধু বলেছিল, না। পরদিন থেকে আকলিমাকে আর কোথাও দেখা যায় নি। কেউ তাকে নিয়ে আর কথা বলে না।
গতদিন এই মানিক তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
জবাবে তেমন কিছু বা বললেও বেশ কড়া করে কিছু কথা শুনিয়েছিল তাকে জাহানারা। মানিক শুনে কিছুই বলে নি। শুধু শুনে গেছে।
ওটা কে মানিকের পাশে? জাহানারা উল্টো ঘুরে দৌড় দেবার একটা অতিমানবীয় ইচ্ছা অনেক কষ্টে দমন করে। সে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নারী, আশেপাশে অনেক লোক, নিশ্চয়ই মানিক তাকে কিছু করতে গেলে সবাই বাঁধা দেবে।
নিশ্চয়ই সবার চোখের সামনে মানিক তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
জাহানারা হেঁটে চলে। মানিকের মুখে মৃদু হাসি ফোটে। রক্তে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত ছোটে তার। লুঙ্গির নিচে যন্ত্রটা কেমন অস্থির অবুঝ হয়ে যায়।
জাহানার এখন চায়ের দোকানের সামনে। আশেপাশে অনেক মানুষ। মানিক চায়ের কাপটা মাটিতে ফেলে দেয়। চায়ের কাপের উপর সে উঠে দাঁড়াতেই সশব্দে ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে যায় চায়ের কাপ।
জাহানারা কেঁপে ওঠে।
জাহানারা এগুতে যায়। তার সামনে লিটু। বামে মানিক। ডানে আশ্রফ। পিছনে কেউ না।
জাহানারা পিছন ফিরে দৌড় দেয়। একটা শক্ত হাত তাকে ধরে ফেলে। জাহানারা চিৎকার দিয়ে ওঠে। কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না। চায়ের দোকানদার আপনমনে চায়ের কাপের ভাঙ্গা অংশ টোকায়।
পথচারী নীরবে হেঁটে যায়। সাইকেলধারী আপনমনে সাইকেল চালিয়ে চলে যায়।
জাহানারাকে চ্যাংদোলা করে একটা পরিত্যক্ত ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। মানিক শক্ত হাতে তাকে ধরে বলে, “বিয়া করবি না, না? ভাব বাড়সে তোর? আমারে চিনিস? আইজ আমারে চিনবি তুই, আমি কি জিনিস”।
লিটু জাহানারার মুখ বাঁধে।
আশ্রফ বাঁধে হাত পা। সবার আগে প্যান্ট খোলে মানিক।
জাহানারা ছটফট করে।
জাহানারার আর্তনাদ মানিকের উত্থিত যন্ত্রের আয়তন শতগুণ বাড়িয়ে দেয় যেন। মানিকের রক্তে আগুন ধরে যায়।
মানিক এক টানে ছিঁড়ে ফেলে জাহানারার জামা, একটানে নামিয়ে ফেলে জাহানারার পাজামা। মানিক হামলে পড়ে জাহানারার কিশোরী শরীরের উপর।
অতঃপর...
কোত্থেকে এসে বটি হাতে মানিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ। মানিকের যন্ত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, মানিকের হাত পা মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। লিটু পালাবার চেষ্টা করে, বটির কোপে ধড় আলাদা হয়ে যায় লিটুর।
আশ্রফ অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিয়ে বটিধারীর দিকে তেড়ে আসে, বটির এক কোপে উপড়ে আসে তার হলুদ চোখ। বটিধারীর মুখে রক্ত, চোখে রক্ত, হাতে রক্ত, পায়ে রক্ত, সর্বাঙ্গে তিন শয়তানের বিষাক্ত রক্ত।
বটিধারী একটা রক্তাক্ত শাড়ি এগিয়ে দেয় জাহানারার উদ্দেশ্যে। তার দ্রুত হাত মুক্ত করে জাহানারার মুখ, খুলে দেয় জাহানারার হাত পায়ের বাঁধন। জাহানারা উঠে দ্রুত শাড়িটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে, “তুই আমার ভাই।
তুই আমার মায়ের পেটের আপন ভাই”।
***
বিখ্যাত অভিনেতা আমিনুল ইসলামের একমাত্র নাতনী জাহিন তার নানীর উদ্দেশ্যে বলল, “নানু, নানাভাই এই দৃশ্যটা বারবার দেখে কাঁদে কেন?”
জাহিনের নানী রাহনুমা আক্তার উত্তর দিলেন, “এটা তুমি এখন বুঝবে না নানুভাই। এটা তোমার নানাভাইকে অতীতের একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এজন্যেই উনি এটা বারবার দেখেন আর কাঁদেন”।
“নানু, এটা তো একটা পুরনো সিনেমার অংশ মাত্র।
এর পুরোটাই তো অভিনয়। এমনকি ঐ তিনজনের শরীরের যে ক্ষতচিহ্ন সেটা যেমন মেক-আপ, তেমনই ঐ লাল রক্তও তো রক্ত নয়, সিনেমায় ব্যবহার করা একটা কেমিকাল মাত্র। তাহলে এটা দেখে নানাভাইয়ের এত কাঁদার কি আছে?”
“এটা আসলে আমিও জানি না, নানুভাই। তোমার নানাভাই আমায় কখনও বলেন নি”।
“আচ্ছা নানু, এটা কি সত্যি যে নানাভাই ঐ বটিধারীর অভিনয় করতে গিয়ে আসলেই কোপ দিয়ে একজনকে আহত করেছিলেন? এই শটটা নিতে নাকি তার প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছিল?”
“হ্যাঁ নানুভাই, অভিনয় করতে গিয়ে হুট করে উনার অতীতের কোন একটা কথা মনে পড়েছিল।
সেই কারণে হঠাৎ করেই উনি নিজেকে সিনেমার চরিত্র নয়, বাস্তবের চরিত্র ভেবেছিলেন। এবং সে কারণেই উনার মধ্যে রাগের সঞ্চার হয়েছিল এবং উনি পার্শ্ব-অভিনেতার গায়ে বটি চালিয়ে বসেছিলেন”।
“কি সেই ঘটনা, নানু?”
“এটা আমি জানি না, নানুভাই। আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার নানাভাই আমাকে কখনও বলেন নি”।
***
মন্টু সাইকেলে চড়ে বাজারে যাচ্ছিল।
হঠাৎ সে দেখল, রাস্তার মাঝখানে জাহানারা বুবু দাঁড়িয়ে আছে।
মন্টুর সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। জাহানারা বুবুকে দেখলে তার কি যেন হয়, সে নিজেও জানে না। বুবুকে একদিন সে পুকুরে গোসল করতে দেখেছিল, তারপর দু’রাত সে ঘুমাতে পারে নি একদম। জাহানারা বুবুর কাছে যখন সে মাঝে মাঝে পড়া বুঝতে যায় তখন বুবু মাঝে মাঝে তার ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, মন্টুর যে কি ভালো লাগে তখন!
কিন্তু জাহানারা বুবু দাঁড়িয়ে আছে কেন? আর সামনে ওটা কে? মন্টু হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করে, এলাকার সবচেয়ে বড় খবিশের বাচ্চা চেয়ারম্যানের ছেলে গাঞ্জাখোর মানিক চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বুবুর দিকে তাকিয়ে আছে।
গাঞ্জাখোরের পাশে আরও দুটো শয়তান ঘুরঘুর করছে। একটার নাম লিটু, আরেকটা আশ্রফ। মানিকের সব অপকর্মের সঙ্গী।
জাহানারা বুবুকে ওরা তুলে নিয়ে যাচ্ছে! কেউ কিচ্ছু বলছে না! ক্লাস ফাইভে পড়া মন্টু হঠাৎ আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু কেউ তার দিকে ভ্রূক্ষেপ করল না।
সবাই যেন অন্ধ, সবাই যেন বধির।
মন্টু দৌড়ে গেল চায়ের দোকানীর কাছে। দোকানী বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই আবার আইছস?”
“চাচা দেখেন শয়তানগুলা জাহানারা বুবুরে ধইরা নিয়া গেছে!”
“জাহানারা আবার তোর বুবু হইল কবে?”
“চাচা ওরা বুবুরে মাইরা ফালাইব!”
“যা যা নিজের কামে যা। নদীতে নাইমা কুমিরের সাথে যুদ্ধ কইরা লাভ নাই। তুই গেলে ওরা তোরেও মাইরা ফালাইব”।
অতঃপর মন্টু নিজেই চায়ের দোকান থেকে একটা বটি ছিনিয়ে নিয়ে পরিত্যক্ত ঘরটির দিকে রওনা হয়। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সে শুনতে পায় মেয়েলি কণ্ঠের গভীর আর্তনাদ, রাগে রি রি করে ওঠে তার সারা দেহ। মন্টুর মধ্যে কাজ করতে থাকে গভীর প্রতিশোধলিপ্সা, জিঘাংসা, দ্বিধা, আশংকা এবং প্রাণের ভয়।
শেষ পর্যন্ত ভয় জয়ী হয়। মন্টু সজোরে বটিটা পুকুরে নিক্ষেপ করে সাইকেল চালিয়ে বাসায় চলে আসে।
বাসায় এসে গভীরভাবে কাঁদতে থাকে সে। তার কান্নায় শামিল হয় সুনীল আকাশ। বৃষ্টি নামে।
এইরকম ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই পরদিন জাহানারা নামক অভিমানী তরুণীটির লাশ পুকুরের পাড়ে উলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া যায়। থানা পুলিশ আসে, চলেও যায়।
গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যায় জাহানারার পরিবার।
কিন্তু ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া আমিনুল ইসলাম (মন্টু)র মন থেকে জাহানারা মরে না। জাহানারা বেঁচে থাকে। সমাজের আনাচে কানাচে আরও অনেক জাহানারা আরও অনেক মন্টুর হৃদয়ে বেঁচে থাকে। আরও অনেক মন্টুরা গভীর রাতে জাহানারাকে স্মরণ করে বোন হারানো কষ্ট অনুভব করে, তাদের হৃদয়ে ঘটে রক্তক্ষরণ।
স্বয়ং স্রষ্টা ছাড়া, সে কষ্টের হিসাব রাখা, কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।